মাসখানেকের উপর হয়ে গেল, চলছে গ্রীষ্মের দহনবেলা। এখন মাথার উপরে সূর্য, রক্তচক্ষু পিতার মতো, শাসনে উদ্যত। অচিরেই ধেয়ে আসবে বর্ষার মেঘ, স্নেহময়ী মাতার মতো, শান্ত ও সজল। সেই মা-ই তার পর ধারণ করবে পিতার চেয়েও রুদ্ররূপ। গত এক বছর ধরে আমাদের দম্ভ ও নীচতার জন্য প্রহার করবে ঝড়-তুফানে। জীর্ণতার বিনাশ হবে তারই ধারাজলে। এরই মধ্যে আমরা, রৌদ্র ও মেঘের সন্তানেরা, খেলে বেড়াব, ছুটে পালাব, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, বাবা-মায়ের স্নেহ শাসনে বড় হব। উপভোগ করব সুস্থ সবল শরীর আর আনন্দময় মন। এই তো জীবনের মূল কথা। অস্তিত্বের উৎসবিন্দু।
কিন্তু আজকের এই যান্ত্রিক স্বাচ্ছন্দ্যের যুগে, এই কথাগুলিই কত অলীক, আমাদের কাছে কত অচেনা। প্রকৃতির সন্তান আমরা। কিন্তু সেই প্রকৃতির কাছে যেতে আজ আমাদের বহুতলবাসী বাতানুকূল মন আন্তরিক ভাবে নারাজ! এখন প্রশ্ন হল, এই অনীহা কি আমাদের পক্ষে ক্ষতিকর নয়? শারীরবিজ্ঞান মানলে, স্বীকার করতেই হবে যে, প্রকৃতির সংস্পর্শে যেতে আমাদের এই যে অনাগ্রহ, তা আমাদের দেহ ও মনের পক্ষে অতীব হানিকারক।
এই কথাটুকু স্মরণ করিয়েই লেখাটির সূত্রপাত। আমি কবি— রৌদ্র মেঘের গুপ্তচর, তাদের হয়ে একটি গেরিলা সওয়াল করব, দয়া করে শুনুন সর্বজন।
সওয়ালকারী হিসেবে আমার বায়োডেটা সংক্ষেপে এই— আমার জন্ম ঈশানের পুঞ্জ মেঘের দেশে, অসমের বরাক উপত্যকায়, বড়ও হয়েছি সেইখানে। বাঙালিপ্রধান ওই ভূখণ্ডে, বঙ্গীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যশালী শহর শিলচরে।
বিপুল মেঘ-বৃষ্টির মুক্তাঞ্চল এই বরাক উপত্যকা। এর খুব কাছেই চেরাপুঞ্জি, পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের রেকর্ডধারী জনপদ— মেঘালয়ের পাইন-ছাওয়া পাহাড়ের কোলে। সেই উপত্যকার বালক আমি। গ্রীষ্মে-বর্ষায় বাড়ি থেকে দু’কিলোমিটার দূরে, বরাক নদীর পাড়ের এক স্কুলে, রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হেঁটে যাওয়া ও ফিরে আসা ছিল আমার নিত্যকার রুটিন। তার পর বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে তেরছা বৃষ্টির মাঠের ছর্রা কেটে ফুটবল খেলা ছিল আমার বালকজীবনের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। আর ভালবাসতাম সাঁতার। সেই দুরন্ত বাল্যকাল জুড়ে আমি নিরন্তর পুকুর-নদীতে সাঁতার কেটেছি, মাঠে মাঠে খেলে বেড়িয়েছি, সাইকেলে চড়ে দূরদূরান্তে পাহাড়ে-টিলায়, চা-বাগানে ঘুরেছি। তার পর কলেজের পাট চুকিয়ে একুশ বছর বয়সে কলকাতা চলে আসার পরও চার বছরের হস্টেল-জীবনে এক উঠতি কবি হিসেবে মর্যাদা অর্জনের জন্য আমার দিবানিশি বোহেমিয়ান দৌরাত্ম্যের কোনও ঘাটতি ছিল না। তার পর চাকরি— তিরিশ বছর ধরে পাঁচটি জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রশাসনের কাজ, তারও ব্যস্ততা ছিল যথেষ্ট। তার পর স্বেচ্ছাবসর, এবং শহরের প্রিয় ঘাঁটিগুলিতে দিনভর ঘুরে বেড়ানোর অবাধ স্বাধীনতা।
এই অবিরাম আউটডোর-প্রিয় অ্যাক্টিভ জীবনযাপনের নিট ফল এই যে, আমার এই ৭৬ বৎসর ব্যাপী জীবনের, এ যাবৎ ওষুধপত্রের খরচা বড়জোর দশ হাজার টাকা। তার একটু কমও হতে পারে। কারণ আমার কখনও রোগব্যাধি বিশেষ হয়নি, ক্বচিৎ-কদাচিৎ সর্দি-কাশি বা বদহজম ছাড়া। সে সবের জন্য ট্যাবলেট বা সিরাপ কেনার খরচ আর কত! যদি এ সব কথা ঘনাদার গল্প বলে মনে হয়, তা হলে আমার বচ্ছরকার মেডিকেল চেক-আপের রিপোর্টগুলিতে চোখ বোলানোর অনুরোধ রইল। দেখবেন লিপিড প্রোফাইল, বিলিরুবিন, ক্রিয়েটিনিন, ইউরিক অ্যাসিড, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-ডি ইত্যাদি যাবতীয় ভীতিপ্রদ সূচকের রিডিং-এ একেবারে পিয়ানোর রিডের মতো নির্ভুল ধ্বনি!
আপনি হয়তো ভাবছেন, হঠাৎ রোববারের সকালে এ কোন পাগলা জগাই বাড়ির দরজায় এসে মনোহর আইচের মতো পেশি আস্ফালন শুরু করল! ভয় পাবেন না। আচ্ছা নিজের কথা অল্প ক্ষণের সরিয়ে রেখে, এ বিষয়ে বরং একটা মজার গল্প বলি। হলিউডের এক সেলিব্রিটি জিম ইনস্ট্রাক্টর, যিনি বহু বিখ্যাত চিত্রতারকার ফিটনেস-প্রশিক্ষক, তিনি এক বার এক সাংবাদিকের একটি প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
নিরীহ প্রশ্নটি ছিল এই, “স্যর, হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক অ্যাবাউট ডায়িং?”
শুনে আঁতকে উঠেছিলেন সেই ব্যায়ামবীর। উত্তর দিয়েছিলেন, “ওহ নো! আই কান্ট অ্যাফোর্ড টু ডাই। দ্যাট উইল রুইন মাই ইমেজ!”
এখন কথা হল, মৃত্যু যেমন অবধারিত, তেমন স্বাস্থ্যও তো চির-উল্লসিত! আমার এত ক্ষণের এই নির্লজ্জ আত্মপ্রচারের উদ্দেশ্য শুধু মাত্র একটি কথা বোঝানো, কথাটি হল, প্রকৃতিলগ্ন জীবনেই মানুষ যে দুর্দম প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, তার শক্তি ও আনন্দের কোনও তুলনা নেই। এই প্রফুল্লতাই তো জীবন!
প্রকৃতির সমস্ত তত্ত্ব দিয়ে মানুষের শরীরটাও তৈরি, তবু মানুষ প্রকৃতির কাছে যেতে ভুলে যাচ্ছে। তার সমস্যা অনুভূত হলে, সে চিকিৎসকের কাছে যায়, ডায়েটিশিয়ান বা নিউট্রিশনিস্টের কাছে যায়, ব্যায়ামবিদ বা যোগগুরুরও দ্বারস্থ হয়— শুধু প্রকৃতির কাছে তার যাওয়া হয় না। জীবনযাপনে প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তার কথা তার মনেও পড়ে না কখনও।
ফলে প্রকৃতিতে টিকে থাকার পক্ষে তাকে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়তে হয়।
বহু কাল আগেই আমি পেয়েছিলাম এক অমূল্য প্রবচন— ‘টু কিপ ইয়োরসেল্ফ হেলদি ইজ় ইয়োর হাম্বল ট্রিবিউট টু দ্য কসমস’। সেই থেকেই প্রবচনটি আমার জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে আছে।
*****
মেঘের কথা বলব, অথচ তার ভিতর একটুখানি ‘মেঘদূত’ কাব্যের কথা বলব না, তা কি হয়? বিপুল প্রলোভন সামলে আমি মাত্র দু’-চারটি কথা বলছি। আমার প্রথম কথাটি রয়েছে মেঘদূতের প্রথম শ্লোকটিতেই— ‘জনকতনয়াস্নানপুণ্যোদকেষু’। যা বুদ্ধদেব বসুর সুললিত অনুবাদে ‘এবং জলধারা জনকতনয়ার স্নানের স্মৃতি মেখে পুণ্য’। ‘এক কর্মে অমনোযোগী যক্ষ কুবেরের শাপগ্রস্ত হয়ে রামগিরি আশ্রমে বসতি করল। সেই স্থান স্নিগ্ধচ্ছায়াতরুময় এবং তথাকার জল জনকতনয়ার স্নানহেতু পবিত্র।’ (অনুবাদ: রাজশেখর বসু)। এই শেষোক্ত অপূর্ব চিত্রকল্পটি, অর্থাৎ জনকতনয়ার স্নানহেতু পবিত্র জলধারার চিত্রকল্পটি, আমার মনে এমন এক অপার্থিব শুদ্ধতার সুর তোলে, যা মোটেই ‘মেঘদূত’ কাব্যটির বাদী সুর নয়। শৃঙ্গাররসের কবি কালিদাসকে কেউই নৈতিকতা বা আধ্যাত্মিকতার অপবাদ দেবেন না। অথচ তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যের প্রথম শ্লোকেই বেজে উঠল সেই আধ্যাত্মিকতার সুর, পরবর্তী কালে যে সুরের এক মহাকবি হবেন তাঁরই এক প্রধান ভাবশিষ্য রবীন্দ্রনাথ। আমি কী তফাত পাই এই দুই গুরু-শিষ্যের ভিতর? সেটি এই যে, কালিদাসের কাব্যে জনকতনয়ার শরীর স্নান করে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাব্যে স্নান করে জনকতনয়ার আত্মা। তা হলে কালিদাসের কলমে কী করে বেজে উঠল এই সুর? আবারও চলে আসে এক গুরুর কথা, যিনি কালিদাসেরই সর্বপ্রধান গুরু— আদিকবি বাল্মীকি। তাঁর মহাকাব্য রামায়ণের শুরুতেই রয়েছে এই অনির্বচনীয় শ্লোকটি—
“অকর্দমমিদং তীর্থং ভরদ্বাজ নিশাময়।/ রমণীয়াং প্রসন্নাম্বু সন্মনুষ্যমনো যথা॥”
বালকাণ্ডে বাল্মীকি তমসা নদীর তীরে এলেন ও শিষ্য ভরদ্বাজকে বললেন, “দেখো ভরদ্বাজ, এই তীর্থ (ঘাট) কেমন কর্দমশূন্য রমণীয়, এর জল সচ্চরিত্র মনুষ্যের মনের তুল্য স্বচ্ছ।” এই শ্লোকটিতেই আমরা মানুষের সৌন্দর্যবোধ ও নীতিবোধের মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্কের একটি আদি চিত্রকল্প পাই।
যাই হোক, ‘মেঘদূত’ নির্বাসিত যক্ষের বিরহী প্রেমের এক অতুলনীয় কাব্য, এবং বুদ্ধদেব বসু তাঁর অনুবাদগ্রন্থের অসামান্য ভূমিকাটিতে যথার্থই বলেছেন, “আমরা নিঃসংশয়ে বলতে পারি যে শুধুমাত্র যৌন প্রণয়কে অবলম্বন করে এমন সর্বাঙ্গসুন্দর দীর্ঘ কবিতা পৃথিবীতে আর রচিত হয়নি।”
*****
এই প্রেমের কাব্যের কথা ভাবলেই আমার কিছু মজার কথা মনে পড়ে যায়। অনেক পণ্ডিতই মনে করেন যে, প্রেম বস্তুটা মানুষের মজ্জাগত কোনও আবেগ নয়। নেহাত প্রেমের গল্প শোনে বলেই লোকে প্রেমে পড়ে। লেখক সি এস লুইস তো স্পষ্টই বলেছেন যে, রোম্যান্টিক প্রেম দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপের সভাকবিদের আবিষ্কার। তার আগে এ জিনিস মানবসমাজে ছিল না। এর সপক্ষে তিনি যুক্তিও দিয়েছেন— কই হোমার-ভার্জিল সবটা পড়ে দেখো, কোনও পুরুষ বা নারী তো কোথাও কারও প্রেমে পড়েনি!
তাঁর প্রতিপক্ষরা অবশ্য বাঁকা হেসে জবাব দিয়েছিলেন, “লুইস ভায়া, তুমি আগে একটু বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের ‘সংস অব সলোমন’ পড়ে দেখো। অমন মিলন-ব্যাকুল বিরহী প্রেমের কাব্য কোথাও খুঁজে পাবে না। বাইবেল কি দ্বাদশ শতাব্দীর রচিত বই, ভায়া?”
যাই হোক, আমরা বেদ-উপনিষদের দেশের লোক। প্রেমের ব্লাডলাইন খুঁজে গিয়ে ওই সামান্য আটশো-হাজার বছরের তর্ক আমাদের কাছে নস্যি। আমরা বরং পশ্চিমেই চোখ রাখি আপাতত, শুনি সেখানকার দু’-চার জন আধুনিক লেখক কী বলছেন প্রেমের বিষয়ে।
গঁকুরদের জার্নালে পাই, তুর্গেনিয়েভ রাশিয়া ফিরে আসবেন, তাঁর ফেয়ারওয়েলে একটি ডিনার পার্টিতে জমায়েত হয়েছেন কয়েক জন লেখক। কথা উঠেছে প্রেম নিয়ে, বিশেষত কাব্যে-উপন্যাসে যে প্রেমের বর্ণনা, তা নিয়ে। এমিল জ়োলা জোরালো মত দিচ্ছেন এই বলে যে, প্রেম কোনও বিশেষ আবেগই নয়, এবং প্রেমের যে তীব্রতা আমরা অনুভব করি, তা আসলে শুধুমাত্র যৌন মিলনের আকর্ষণ। তুর্গেনিয়েভ এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন যে, প্রেম অবশ্যই মানবমনের একটি বিশেষ বর্ণময় আবেগ এবং এই আবেগ অনুভবের তুল্য অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে আর কিছু নেই। যে মানুষ বা মানুষীই এক বার প্রেমে পড়েছে, তারই মনে হয়েছে, সে যেন দ্বিতীয় বার জন্মলাভ করল। প্রেমের এমন এক গভীর মনোভার (হেভিনেস অব দ্য হার্ট) আছে যা মানবিক স্তরেরই নয়, যা অপার্থিব। তিনি আরও বলেন যে, তিনি প্রথম যে-মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন, তার চোখ দুটিতে এমন এক দৃষ্টি দেখেছিলেন যা সম্পূর্ণ অনির্দেশ্য, যে-দৃষ্টির সঙ্গে এই জড়জগতের কোনও সম্পর্ক নেই। এর পর গঁকুর বলছেন, “দুঃখের বিষয় হল, জ়োলা কিংবা আমি অথবা এমনকি ফ্লব্যের— যে প্রেম নিয়ে বিস্তার বাগাড়ম্বর করে, আমরা কেউই প্রেম বিষয়ে কথা বলার যোগ্য নই, কারণ আমরা কেউই কখনও সিরিয়াসলি প্রেমে পড়িনি। এই যোগ্যতা কেবলমাত্র তুর্গেনিয়েভেরই আছে।
কথা হল, প্রেম বিষয়ে আপনি-আমি কোন দলে? জ়োলার দলে? না তুর্গেনিয়েভের দলে? আমি তো নিঃসন্দেহে, জন্ম-জন্মান্তরে তুর্গেনিয়েভের দলে; কিন্তু আপনি? ভাবুন, উন্মুক্ত প্রান্তরে মেঘ ও রৌদ্রের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবুন, না হলে উত্তর খুঁজে পাবেন না। কারণ ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম আপনার মনের জানলাগুলো ব্লক করে দিয়েছে। শুনে নিন এই গানটি— ‘তোমরা যে বলো দিবসরজনী ভালোবাসা ভালোবাসা— সখি ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়...’
ছবি: কুনাল বর্মণ।
*****
এখনও একা একা দিনভর শহরে ঘোরার অভ্যেসটা ছাড়িনি। সপ্তাহে অন্তত দুটো দিন, ঘুরে বেড়াই উত্তর থেকে দক্ষিণ— মেট্রোয় চড়ে, সিঁড়ি ভেঙে, পায়ে হেঁটে; গ্রন্থাগারে, সিনেমাহলে, বইয়ের দোকানে, অ্যাকাডেমিতে ছবির প্রদর্শনী দেখে, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে; শুধু একা একা ঘুরে বেড়ানোর নেশায়, রোদে- জলে শরীরটাকে ফিট রাখার নেশায়। কিন্তু বয়স হয়েছে। মাঝেমধ্যে দুপুর রোদে হাঁটতে হাঁটতে ভয় হয় মনে। যদি হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাই রাস্তায়, অজ্ঞান হয়ে যাই, তা হলে কী হবে?
আমি প্রায়ই এই সম্ভাব্য দৃশ্যটা কল্পনা করি। ভরদুপুরে, ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখতে এসে, নিউ এম্পায়ার সিনেমা হলের সামনের রাস্তায় আমি হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছি, অজ্ঞান হয়ে গেছি। পথের ধারে এক চিপ্স-বিক্রেতার পায়ের কাছে একটু দোমড়ানো ভঙ্গিতে পড়ে আছে আমার অসহায় নিশ্চল শরীরটা। অমনি চার পাশে উদ্বিগ্ন বিভিন্ন পথচারীদের একটা ছোট্ট জটলা তৈরি হয়েছে, ছুটে এসেছে কয়েকটি হকার ছেলে, এক জন হাঁক দিচ্ছে, ‘হেই আবদুল! জলের বোতলটা নিয়ে আয়। আঙ্কেল সেন্সলেস হয়ে গেছে।’ তারাই হাত লাগিয়ে শুশ্রূষা করতে শুরু করে আমাকে। আর বাকি ভিড়টা আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে।
আমি প্রতি বারই, এই কাল্পনিক দৃশ্যে, অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থেকেও খুব স্পষ্ট চোখে দেখি— সকলের আগে যে লোকটি নির্বিকার মুখে ভিড় ছেড়ে সরে গেল, সেই লোকটাই আমি।
*****
শেষ কথাটি বলি। এক জন কবি কবিতা লেখেন তাঁর বোধ, মনন আর কল্পনাশক্তি দিয়ে। কিন্তু এখন তো এআই-চ্যাটবট কবিতা লিখে দিচ্ছে পকেট-ভর্তি ডেটা আর টুকলিবাজি দিয়ে। তা হলে প্রকৃত কবিতার কী হবে? এ বিষয়ে নানা উদ্বিগ্ন কথাবার্তা কানে আসে। যদিও আমি সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি থেকে শতহস্ত দূরে থাকি বলে নিত্যকার বিতর্কের আঁচ টের পাই না। কিন্তু খবর তো রাখি, উদ্বেগেও থাকি। যদিও এ প্রসঙ্গে আমার উদ্বেগটা একটু অন্য রকম, সেটা বলি। কিছু দিন আগে কাগজে পড়লাম একটি চ্যাটবট— চ্যাটজিপিটি ৩.৫— শেক্সপিয়র ও এলিয়টের অনুকরণে কবিতা লিখেছে, যা নাকি সেই মহাকবিদের কবিতার থেকেও ভাল। কারণ সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী একটা ‘জেনারেল রিডারশিপ সার্ভে’ করে জানা গেছে, চ্যাটবটটির কবিতা নাকি ‘মোর স্ট্রেট ফরওয়ার্ড অ্যান্ড অ্যাকসেসিব্ল দ্যান দ্য প্রমিনেন্ট পোয়েট্স’, (দ্য টেলিগ্রাফ, ১৮-১১-২০২৪)
ভাবুন, কী অদ্ভুত অজ্ঞতা ও কী ঘনায়মান সর্বনাশের বার্তা! এবং লক্ষ করুন, এই সর্বনাশের মূলে কিন্তু চ্যাটবটটির নকল কবিতা নয়, এই সর্বনাশের মূলে রয়েছে সেই কবিতার ‘গুণগ্রাহী’ পাঠক— সেই সমীক্ষার অন্তর্গত ‘জেনারেল রিডারশিপ’, যারা চাল ও কাঁকরের তফাত বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছেন, প্রকৃত কবিতা ও তার যান্ত্রিক প্যারডির মধ্যে তফাত বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছেন। সম্ভবত ডিজিটাল-ভার্চুয়াল এর প্রভাবে তাঁদের কাব্যবোধ লুপ্ত হয়ে গেছে।
‘শিরে কৈল সর্পাঘাত, তাগা বাঁধব কোথা?’— আমার উদ্বেগ এই ক্রমবর্ধমান পাঠকশ্রেণিকে নিয়ে। চ্যাটবটকে নিয়ে আদৌ নয়।
চ্যাটবট চলে অ্যালগরিদমে। আর মানবমনীষা চলে বহুদর্শী ভাবুক অন্তর্দৃষ্টির মহাজাগতিক ছন্দে। সেই মনীষা এখন অ্যালগি-আক্রান্ত। দুর্ভাবনার কথা বইকি!
তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে, সেই ভাবের জগতে ফিরে যেতে চাই, কারণ সেটি মানুষের একান্ত আপন জগৎ, তার প্রেম ও করুণার জগৎ। এবং সম্ভবত মানবমনে এই ভাবের জগৎটির সৃষ্টি করার জন্যই এই অনন্ত বিশ্বলোকের সৃষ্টি। আজকের এই যন্ত্রমেধার সঙ্কটেও সেই ভাবের জগতেই আমরা খুঁজে পাব সঠিক সমাধান। আসুন সেই ভাবের জগতেই আমরা নিঃশব্দে প্রবেশ করি। বাংলার একটি গ্রামের আলপথে। একটি ভাবুক বালকের পিছু-পিছু।
গ্রামের নাম কামারপুকুর, আলাভোলা বালকটির নাম গদাই। এমনিতে সে চঞ্চল, হাসিখুশি। কিন্তু মাঝে মধ্যে সে মনের গভীর ভাবের ভিতর ডুবে যায়। এমনই সময়ে এক দিন গদাইয়ের জীবনে এক গভীরতর ভাবের আবেশ দেখা দিল। তার নিজের জবানিতেই শোনা যাক সেই কথা— “সেটা জ্যৈষ্ঠ কি আষাঢ় মাস হবে। আমার তখন ছয় কি সাত বছর বয়স। একদিন সকালবেলা টেকোয় মুড়ি নিয়ে মাঠের আল দিয়ে খেতে খেতে যাচ্ছি। আকাশের একখানা সুন্দর জলভরা মেঘ উঠেচে, তাই দেখচি ও যাচ্চি। দেখতে দেখতে মেঘখানা আকাশ প্রায় ছেয়ে ফেলেচে। এমন সময় এক ঝাঁক সাদা দুধের মতো বক ঐ কালো মেঘের কোল দিয়ে উড়ে যেতে লাগল। সে এমন এক বাহার হল! দেখতে দেখতে অপূর্ব ভাবে তন্ময় হয়ে এমন একটা অবস্থা হল যে, আর হুঁশ রইল না! পড়ে গেলুম, মুড়িগুলি আলের ধারে ছড়িয়ে গেল। কতক্ষণ ওই ভাবে পড়েছিলুম বলতে পারি না। লোকে দেখতে পেয়ে ধরাধরি করে বাড়ী নিয়ে এসেছিল। সেই প্রথম ভাবে বেহুঁশ হয়ে যাই।”
জলভরা কালো মেঘের কোলে উড়ন্ত বকের পাঁতি দেখে সেই প্রথম বালক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবমূর্ছা! কী অনির্বচনীয় দৃশ্য! কালো মেঘের কোলে সৌন্দর্য দর্শন করলেন বালক ঠাকুর, সেই সৌন্দর্যের এমনই তীব্রতা যে ভাবের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এই দৃশ্যটিই কি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের হৃদয়-সম্পর্কের সত্যটি আমাদের চিনিয়ে দেয় না?
ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। তাঁর অনুসরণে বলি, আমাদের চৈতন্য হোক। ডিজিটাল-ভার্চুয়ালকে ছাড়িয়ে আমাদের মেঘ ও রৌদ্রের চৈতন্য হোক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)