Advertisement
E-Paper

গভীর জলের তিমি, তাই সবচেয়ে ক্ষমতাবান

তাঁদের কথায় আমেরিকা বেরিয়ে আসতে পারে প্যারিস চুক্তি ছেড়ে। তাঁদের সুরে সুর না মেলালে শেষ হয়ে যায় রাজনীতিকের কেরিয়ার। অমিতাভ গুপ্ত তাঁদের কথায় আমেরিকা বেরিয়ে আসতে পারে প্যারিস চুক্তি ছেড়ে। তাঁদের সুরে সুর না মেলালে শেষ হয়ে যায় রাজনীতিকের কেরিয়ার। অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৭ ১১:৩০
কিংমেকার: ডেভিড কোখ ও চার্লস কোখ।

কিংমেকার: ডেভিড কোখ ও চার্লস কোখ।

গভীর জলে থাকবে, কখনও ভেসে উঠবে না। মনে রাখবে, তিমিও যখন জলের ওপর মাথা তোলে, একমাত্র তখনই তাকে হারপুনে গেঁথে ফেলা যায়।’ উত্তরাধিকারী চার পুত্রকে এ হেন উপদেশ দিয়েছিলেন যে পিতা, তাঁর বিচক্ষণতা প্রশ্নাতীত। অবশ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ থেকে উত্তর প্রান্ত অবধি পেট্রোলিয়াম সাম্রাজ্য বিস্তার করা যে সে লোকের কাজ নয়। ফ্রেড কোখ সে কাজটাই করেছিলেন। দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের পেট্রোলিয়ামের বাজার কার্যত ফ্রেড ইন্ডাস্ট্রিজ-এরই একচেটিয়া দখলে। ১৯৬৭ সালে প্রয়াত ফ্রেড ব্যবসা দিয়ে যান চার ছেলের হাতে। বাকি দুই ভাইয়ের হিস্যা কিনে নিয়ে ফ্রেড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মালিক হন চার্লস আর ডেভিড কোখ। আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাবান দুই নাগরিক।

এতই ক্ষমতাবান, যে তাঁদের আপত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসতে পারে প্যারিস চুক্তি থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য বিশ্বের ১৯৫টি দেশ একসঙ্গে যে চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল, এ মাসের গোড়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানালেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই চুক্তিতে থাকবে না। তার পর থেকেই আমেরিকা জু়ড়ে আরম্ভ হয়েছে তুমুল তর্ক— সিদ্ধান্তটি আসলে ট্রাম্পের, নাকি কোখ ব্রাদার্সের আপত্তি শিরোধার্য করা ছাড়া তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না? গোটা দেশেই যেখানে প্যারিস চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসা নিয়ে আপত্তি; ডিজনি থেকে জেনারেল ইলেকট্রিক, ‘ফরচুন ১০০’-র তালিকায় থাকা বাঘা বাঘা সংস্থাগুলি যেখানে প্যারিস চুক্তি মেনে চলার পক্ষপাতী; ক্যালিফোর্নিয়ার মতো রাজ্য যেখানে স্বাধীন ভাবে প্যারিস চুক্তি মান্য করার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে; স্বয়ং ইভাঙ্কা ট্রাম্প যেখানে বাবাকে বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন— সেখানেও ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর কেন? কেন তাঁর ক্যাবিনেটে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স থেকে সিনিয়র স্ট্র্যাটেজিস্ট স্টিফেন ব্যানন, পরিবেশের বড়কর্তা স্কট প্রিট, সেনেটের পরিবেশ কমিটির হোতা জেমস ইনহোফ, হাউস সায়েন্স কমিটির প্রধান ল্যামার স্মিথ, এনার্জি সেক্রেটারি রিক পেরি— প্রত্যেকেই খ্যাত জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁদের দৃঢ় অবিশ্বাস ও তুমুল অবজ্ঞার জন্য?

মার্কিন মিডিয়া বলছে, এই প্রশ্নের সবচেয়ে বড় উত্তর হলেন চার্লস আর ডেভিড কোখ। ধনীতম মার্কিন নাগরিকদের তালিকায় বিল গেটস আর ওয়ারেন বাফেট-এর পরেই তাঁদের নাম। আলাস্কা থেকে মিনেসোটা বা টেক্সাস, গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের তৈল সংশোধনাগার। মাটির নীচ দিয়ে চার হাজার মাইলেরও বেশি লম্বা তেল পরিবাহী পাইপ চলে গিয়েছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। পেট্রোলিয়ামের ব্যবসায় তাঁদের স্বার্থ এতটাই গভীর যে সেই স্বার্থ রক্ষা করতে কোনও বাধার কাছেই নতিস্বীকার করতে রাজি নন তাঁরা। জলের মতো ডলার খরচ করতেও আপত্তি নেই। পরিবেশবাদীদের হিসেব বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাতে এমন কিছু না হয় যাতে পেট্রোলিয়ামের ব্যবসার গায়ে আঁচ পড়বে, তা নিশ্চিত করতে কোখ ভাইরা যে পরিমাণ ডলার খরচ করেছেন, তা বেনজির।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

জলের নীচে থাকার পিতৃ-আজ্ঞা অমান্য করেননি চার্লস আর ডেভিড কোখ। বছর কয়েক আগেও এই দুই ভাইয়ের নাম জানতেন না বেশির ভাগ মার্কিন নাগরিক। মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেন না, প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে হাজির হতেও ঘোর অনীহা। পরিহাস করে নিজেরাই বলেন, ‘কোখ ইন্ডাস্ট্রিজ হল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংস্থা, লোকে যার নাম শোনেনি!’ তাঁরা রাজনীতির কলকাঠি নেড়েছেন অলক্ষে। বারাক ওবামার সবচেয়ে ব়়ড় শত্রুর স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এই দুই ভাই। ‘অ্যামেরিকানস ফর প্রসপারিটি’ নামে একটি অসরকারি সংস্থা চলে কোখদের টাকায়। তার মূল কাজ, যে সিদ্ধান্তে কোখদের ব্যবসার ক্ষতি, তার বিরোধিতা করে চলা। সংস্থাটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে ওবামার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ তৈরি করেছিল।

এবং, রিপালবিকানদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ২০১০ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় খরচ করার ক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থার ওপর কার্যত আর কোনও বাধানিষেধ নেই। দেশ জুড়ে রিপাবলিকান রাজনীতিকদের পিছনে ঢেলে ডলার খরচ করেন কোখ ভাইরা। শর্ত একটাই— জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করা যাবে না। দু-এক জন রিপাবলিকান রাজনীতিক এই নিয়ম অমান্য করেছিলেন। দেশের রাজনীতির ইতিহাসের ফুটনোটেও এখন তাঁদের ঠাঁই হয় না। ‘অ্যামেরিকানস ফর প্রসপারিটি’-র এক কর্তা জানিয়েছিলেন, তাঁরা ‘সিরিয়াস মানি’ খরচ করবেন— নিজেদের মতকে রাজনীতির মূলধারায় ঠাঁই করে দিতে, আর বিরুদ্ধ মতের শ্বাসরোধ করতে।

প্রমাণ চাই? ‘অ্যামেরিকানস ফর প্রসপারিটি’ একটা শপথ তৈরি করেছিল রাজনীতিকদের জন্য— ‘নো ক্লাইমেট ট্যাক্স প্লেজ’। তার মোদ্দা কথা, পরিবেশের নামে মার্কিন অর্থনীতির ওপর কোনও বাধানিষেধ তৈরি করা যাবে না। ২০১০ সালের নির্বাচনের আগে যাঁরা সেই শপথে সই করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ১৬৫ জন রিপাবলিকান নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁদের সিংহভাগই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। মিশিগানের ফ্রেড আপটন যেমন এক কালে ছিলেন ঘোর পরিবেশপন্থী। কিন্তু, ২০১০ সালের নির্বাচনের প্রচারের খরচ হিসেবে তাঁর অ্যাকাউন্টে ঢুকল ২০ লক্ষ ডলার। এবং, ওয়েবসাইট থেকে মুছে গেল পরিবেশ-দুর্ভাবনার যাবতীয় চিহ্ন। আপটন জানালেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদটা মিথ্যে নয় বটে, কিন্তু তার পিছনে মানুষের হাত আছে, এ কথা নিয্যস অপপ্রচার।’ আর, যাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন এই উদ্যোগের? দেখা গেল, নির্বাচনী প্রচারের জন্য যথেষ্ট টাকাই জোগাড় করে উঠতে পারলেন না তাঁরা। ইন্ডিয়ানার ছ’দফার সেনেটর রিচার্ড জি লুগার যেমন। ২০১২ সালের নির্বাচনে প্রাইমারিতেই ধরাশায়ী হলেন টি পার্টির অনামা প্রতিদ্বন্দ্বী রিচার্ড ই মারডকের হাতে। লুগার পরিবেশের কথা বলা বন্ধ করতে অস্বীকার করেছিলেন।

কোখ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর ঢালা ডলারের বিপুল অংশ ঢুকেছে সেই সব সংস্থার অ্যাকাউন্টে, যাদের মূল কাজ ‘বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রমাণ করা যে জলবায়ু পরিবর্তনের পুরো গল্পটাই আসলে মিথ্যে, মার্কিন অর্থনীতির ক্ষতি করার কৌশল’। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থা গ্রিনপিস হিসেব কষে দেখিয়েছে, গত দশ বছরে ঠিক কত কোটি ডলার পেয়েছে সংস্থাগুলি। তাদের কাজে ঘোরপ্যাঁচ নেই— হরেক প্রমাণ সাজিয়ে বলে যেতে হবে, পরিবেশ যেমনটি ছিল, ঠিক তেমনটিই আছে, অন্তত বড়সড় কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই। দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে তারা, যাতে সেই নেতারা বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি খাড়া করে পরিবেশ পরিবর্তনকে অস্বীকার করতে পারেন। এবং, যে গবেষকরা এই বিপদের কথা বলে চলেছেন প্রাণপণ, তাঁদের বদনাম করে সর্বশক্তিতে। কাজ হচ্ছে এই কৌশলে, সন্দেহ নেই— মার্কিন রিপাবলিকান রাজনীতি থেকে পরিবেশ-উদ্বেগ কার্যত মুছে গিয়েছে। ফ্লোরিডার মতো যে রাজ্যগুলো এই বিপদের একেবারে মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানকার রিপাবলিকান রাজনীতিকরাও মুখ খুলতে ভরসা পান না। সমুদ্রের বেড়ে ওঠা জলস্তরে রাজ্য ডুবে যাওয়ার চেয়েও বুঝি নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ার ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবলতর।

মার্কিন মিডিয়ার এক অংশে ঝ়ড় উঠছে। প্যারিস চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত কতখানি ট্রাম্পের, আর কতখানি কোখ ভাইদের, তুমুল তর্ক চলছে তা নিয়ে। কিন্তু, তর্কই সার। কোখ ভাইদের প্রত্যক্ষ যোগ প্রমাণ করার কোনও উপায় এখনও নেই। তাঁরা যে পিতৃ-আজ্ঞা মান্য করতে ভোলেননি। জলের কত গভীরে বিচরণ করেন তাঁরা, বোঝে সাধ্য কার!

David Koch Charles Koch ডেভিড কোখ চার্লস কোখ Donald Trump ডোনাল্ড ট্রাম্প Businessmen
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy