E-Paper

সাড়ে সাত দশক পূর্ণ করল নার্নিয়ার মায়াবী আখ্যান

বেশ কয়েক প্রজন্মের শিশু-কিশোর, এমনকি বড়দেরও প্রভাবিত করেছে পেভেন্সি ভাইবোন, পশুরাজ আসলান এবং ডাইনি জেডিস। সমাদৃত হয়েছে ‘ক্রনিকল’-এর সাতটি কাহিনিই।

সৌভিক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:২৯
রূপকথা: লেখক চার্লস স্টেপল লিউইস, মাঝে সিরিজ়ের প্রথম বইট ‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’ এবং ডান দিকে, সাতটি বইয়ের বক্স সেট।

রূপকথা: লেখক চার্লস স্টেপল লিউইস, মাঝে সিরিজ়ের প্রথম বইট ‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’ এবং ডান দিকে, সাতটি বইয়ের বক্স সেট।

১৯৪০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ ছড়িয়েছে সারা ইউরোপে। নাৎসি জার্মানির আগ্রাসনের সামনে মাথা নোয়াচ্ছে একের পর এক দেশ, লুফৎওয়াফ-এর বোমারু বিমানবাহিনী ‘ব্লিৎজ়’ আক্রমণে তছনছ করছে লন্ডনকে। পরিস্থিতি এমনই, ইংরেজ অভিভাবকরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের প্রাণ বাঁচাতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন শহর থেকে অনেক দূরে, মফস্সলে বা গ্রামে। পেভেন্সি পরিবারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। তেরো বছর বয়সি পিটার, বারো বছর বয়সি সুজ়ান, দশ বছরের এডমান্ড আর আট বছরের লুসিকে প্রফেসর ডিগরি কার্ক-এর কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁদের মা-বাবা। বৃদ্ধ প্রফেসরের প্রাসাদোপম বাড়িতে দিন কাটতে লাগল চার ভাইবোনের। তার পর এক দিন ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা; লুকোচুরি খেলার সময় পোশাকে ঠাসা এক পুরনো আলমারিতে লুকোতে গিয়ে লুসি পৌঁছে গেল নার্নিয়া-র আশ্চর্য দুনিয়ায়, যেখানে পশুপাখিরা মানুষের মতো কথা বলে, উপকথার পাতা থেকে উঠে আসা প্রাণীরা (যেমন ফন— রোমান পুরাণের অর্ধেক মানুষ-অর্ধেক ছাগল) দিব্যি হেঁটেচলে বেড়ায়!

এ ভাবেই শুরু হয় চার্লস স্টেপল লিউইস-এর ‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’। প্রকারভেদ অনুসারে উপন্যাসটি ‘পোর্টাল ফ্যান্টাসি’, কারণ এখানে মূল চরিত্ররা একটি জাদু-দরজার মাধ্যমে এক জগৎ থেকে অন্য জগতে প্রবেশ করে। আবার প্লট-বিন্যাস অনুযায়ী এটি ‘হিরো’জ় জার্নি’ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত, কারণ এই কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্ররা চেনা জগৎ থেকে অচেনা জগতে পা রাখে এক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে অংশগ্রহণ করতে। যাত্রাপথে জ্ঞানী পথপ্রদর্শক ও সমমনস্ক সঙ্গীদের সাহচর্য পায় তারা, পেরোয় নানা প্রতিকূলতা এবং অভিযান সম্পূর্ণ করার পর উন্নীত হয় সাধারণত্ব থেকে অসাধারণত্বে, নায়কসম উচ্চতায়। বিখ্যাত পুরাণবিদ জোসেফ ক্যাম্পবেল তাঁর ‘দ্য হিরো উইথ আ থাউজ়্যান্ড ফেসেস’ বইয়ে এই শ্রেণির কাহিনিকে ‘মোনোমিথ’ বলেও অভিহিত করেছেন।

ব্রিটিশ সাহিত্যিক চার্লস স্টেপল লিউইস-এর জন্ম ২৯ নভেম্বর, ১৮৯৮-এ, আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট শহরে। ছেলেবেলা থেকেই কল্পনাপ্রবণ ছিলেন তিনি। ডুবে থাকতেন রূপকথায়, এডিথ নেসবিট-এর ছোটদের বইয়ে। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার পর লিউইস প্রথমে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ম্যাগডালেন কলেজে এবং পরে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। অক্সফোর্ড-এর আর এক অধ্যাপক, ভাষাতত্ত্ববিদ তথা ‘দ্য হবিট’ ও ‘দ্য লর্ড অব দ্য রিংস’-এর জনপ্রিয় লেখক জন টোলকিন-এর সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল লিউইস-এর; বন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তিনি শিশু-কিশোরপাঠ্য ফ্যান্টাসি উপন্যাস লেখার কাজে ব্রতী হন। ১৯৪৯ সালে লিউইস মনোনিবেশ করলেন ‘নার্নিয়া’ নামে এক কল্পজগৎ গড়ে তোলায়, যার বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে ডালপালা মেলতে লাগল তাঁর আখ্যান। পরের বছর বই আকারে প্রকাশ পেল ‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’; ইংরেজি কল্পসাহিত্যের আঙিনায় ফুটল এক উজ্জ্বল, সুগন্ধী ফুল।

লুসি, এবং তার কথা শুনে বাকি ভাইবোনেরা যে নার্নিয়া-য় গিয়ে উপস্থিত হয়, তা যেন স্বর্গের ধ্বংসস্তূপ, অমরাবতীর বিবর্ণ ছায়া। অস্কার ওয়াইল্ড-এর ‘দ্য সেলফিশ জায়ান্ট’ গল্পে বর্ণিত স্বার্থপর দৈত্যের বাগানে যেমন বসন্ত ডানা মেলত না কখনওই, তেমনই অবস্থা ছিল নার্নিয়ার। সেখানে বিরাজ করত অন্তহীন শৈত্য, তুষারের চাদরে ঢাকা থাকত নদী-পাহাড়-জঙ্গল। আর এ সবের জন্য দায়ী ছিল ‘হোয়াইট উইচ’ জেডিস; তার অত্যাচারী শাসন সর্বত্র সৃষ্টি করেছিল ভয় এবং সন্ত্রাসের পরিবেশ। ডাইনি রানির অনুচররা— দানব, রাক্ষস, নেকড়ের পাল অকথ্য নির্যাতন চালাত নার্নিয়ার বাসিন্দাদের উপর, কেউ প্রতিবাদ করলেই ডাইনি তাকে মন্ত্রবলে পাথরের মূর্তি করে দিত। এমন দুঃসহ নরক থেকে সবাইকে উদ্ধার করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় পেভেন্সি-রা, বাস্তবায়িত হওয়ার দিকে এগোয় প্রাচীন ভবিষ্যদ্বাণী— “যখন অ্যাডামের দুই পুত্র এবং ইভের দুই কন্যা নার্নিয়ার সিংহাসনে বসবে, তখন ডাইনির শাসন ও জীবন সমাপ্ত হবে।” চার দিকে বার্তা রটে যায়, নার্নিয়ার আসল রাজা,মহান সিংহ আসলান দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর আবার দেখা দিয়েছেন।

আসলানের আগমনবার্তা নার্নিয়ায় আলোড়ন তোলে। যে বড়দিনের উৎসব জেডিসের রাজত্বকালে পরিত্যক্ত হয়েছিল, তা পুনরায় পালিত হয়; স্বয়ং ফাদার ক্রিসমাস এসে পেভেন্সি ভাইবোনদের হাতে উপহার তুলে দেন। অন্তিম সময় আসন্ন জেনে ডাইনি রানি চক্রান্ত করে, এডমান্ডকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে প্ররোচিত করে তার পরিবারের বাকিদের ধরিয়ে দিতে। রাজত্ব পাওয়ার লোভে পথভ্রষ্ট এডমান্ড তাতে রাজিও হয়, কিন্তু আসলানের বিচক্ষণতা সেই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয়। তখন হোয়াইট উইচ আবারও কুটিলতার আশ্রয় নেয়, ‘ডিপ ম্যাজিক অব দ্য পাস্ট’-এর রীতি— নার্নিয়ার সমস্ত বিশ্বাসঘাতকের প্রাণ নেওয়ার অধিকার জেডিসের থাকবে— হাতিয়ার করে এডমান্ডের আত্মসমর্পণ দাবি করে। অবুঝ শিশুর প্রাণরক্ষা করতে নিজেকে ডাইনির হাতে সঁপে দেন আসলান, স্বেচ্ছায় বন্দিদশা স্বীকার করেন। ‘স্টোন টেবল’-এর উপর নিরস্ত্র আসলানকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে জেডিস। কিন্তু আসলানের মৃত্যু হয় না, ‘ডিপার ম্যাজিক অব দ্য পাস্ট’-এর— “বিশ্বাসঘাতকের বদলে কোনও নিরপরাধ যদি নিঃস্বার্থভাবে নিজের প্রাণের আহুতি দেয়, তবে মৃত্যুও পরাভূত হবে”— অমোঘ নিয়ম মেনে পরপার থেকে তিনি ফিরে আসেন।

পুনরুজ্জীবিত আসলানের শ্বাসের স্পর্শে জীবন্ত হয়ে ওঠে পাথর হয়ে থাকা পশুপাখিরা, মহান সিংহের নেতৃত্বে শুভশক্তির সেনা একত্র হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। সংগ্রামে বীরত্বের পরিচয় দেয় পিটার, সুজ়ান, লুসি; অনুশোচনার আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে ওঠা এডমান্ডও মাথা উঁচু করে লড়াই করে। শেষে আসলানের আঘাতে ‘হোয়াইট উইচ’ পরাস্ত হয়, স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত হয় নার্নিয়া। কৃতজ্ঞ নার্নিয়াবাসী সানন্দে বরণ করে নেয় তাদের চার নতুন শাসক হাই কিং পিটার দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট, কুইন সুজ়ান দ্য জেন্টল, কিং এডমান্ড দ্য জাস্ট এবং কুইন লুসি দ্য ভ্যালিয়েন্ট-কে।

প্রথম জীবনে নাস্তিক হলেও ক্রমশ লিউইস খ্রিস্টধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে পড়েছিলেন। ‘নার্নিয়া’র কাহিনির মধ্য দিয়েও সূক্ষ্মভাবে জিশুর মাহাত্ম্যকথা তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন শিশুদের মধ্যে। আসলান কি জিশুখ্রিস্টের রূপক?— এক স্কুলছাত্রের করা এই প্রশ্নের উত্তরে লিউইস তাঁকে চিঠি লিখে জানান, বিষয়টাকে তিনি অন্য ভাবে দেখেছেন। তাঁর মতে, নার্নিয়া হল পৃথিবীর সমান্তরাল একটি জগৎ, যেখানে মানবসভ্যতার বদলে বিস্তারলাভ করেছে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন পশুদের সভ্যতা। মানবতাকে পাপ থেকে উদ্ধার করতে ঈশ্বরের সন্তান পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন মানবসন্তান রূপে। রোমানদের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল ‘ইয়েশুস নাজ়ারেনুস রেক্স ইওডেওরেম’ অর্থাৎ ‘নাজ়ারেথের জিশু, ইহুদিদের রাজা’। বাইবেলেও জিশুকে একাধিক বার ‘রাজার রাজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ ঈশ্বরের সাম্রাজ্যের চাবি ছিল তাঁরই হাতে। মসিহা খ্রিস্ট যদি নার্নিয়ায় আবির্ভূত হতেন, তা হলে তিনি পশুরাজ সিংহের দেহই ধারণ করতেন— এই নিয়ে লিউইস-এর মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি আসলান চরিত্রটি সৃষ্টি করেন।

‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’ উপন্যাসে ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও ‘সাবটেক্সট’ আরও রয়েছে। পেভেন্সি ভাইবোনেদের সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মিল খুঁজে পান জিশুর চার প্রধান শিষ্য তথা ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এর ‘গসপেল’ রচয়িতা ম্যাথিউ, মার্ক, লুক এবং জন-এর; অন্য দিকে ‘হোয়াইট উইচ’ জেডিস মনে করিয়ে দেয় ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, পতিত দেবদূত লুসিফার অর্থাৎ শয়তানকে। ছলনার ফাঁদে পা দেওয়া এডমান্ডের অনৈতিক কার্যকলাপ জুডাস ইস্ক্যারিয়ট-এর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতি ইঙ্গিত করে, সর্বোপরি ‘স্টোন টেবিল’-এ আসলানের মৃত্যু এবং পুনরুত্থান জিশুর ‘ক্রুসিফিকশন’ এবং ‘রেজ়ারেকশন’-এর দ্যোতনাই বয়ে আনে।

১৯৫১ থেকে ১৯৫৬-এর মধ্যে নার্নিয়া নিয়ে লিউইস-এর লেখা আরও ছয়টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তাদের মধ্যে ‘প্রিন্স কাসপিয়ান’ এবং ‘ভয়েজ অব দ্য ডন ট্রেডার’ যেমন পেভেন্সিদের পরবর্তী অভিযানের কথা বলে, তেমনই ‘দ্য ম্যাজিশিয়ান’স নেফিউ’ পাঠকদের নিয়ে যায় অতীতে, নার্নিয়ার জন্মলগ্নে। প্রিকোয়েল ও সিকোয়েল মিলিয়ে এই সাতটি উপন্যাস একত্রে পরিচিতি পায় ‘দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া’ নামে, ফ্যান্টাসিপ্রেমীদের কাছে সমাদরও লাভ করে। লেখকের উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং প্রকাশভঙ্গিকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন সমালোচকরা, ১৯৫৬ সালে শিশুসাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য কার্নেগি মেডেল-এ ভূষিত হন লিউইস।

বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফ্যান্টাসি সিরিজ় ‘দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া’ দশকের পর দশক ধরে বাচ্চাদের চোখে কল্পলোকের রঙিন কাজল এঁকেই ক্ষান্ত থাকেনি, বয়সে বড় পাঠকদেরও ভাবনাচিন্তার রসদ জুগিয়েছে, প্রাণিত করেছে পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিকদেরও। ‘ব্রিজ টু টেরাবিথিয়া’-র লেখিকা ক্যাথারিন প্যাটারসন, ‘দ্য ম্যাজিশিয়ানস’ সিরিজের স্রষ্টা লেভ গ্রসম্যান থেকে হ্যারি পটার-খ্যাত জে কে রোওলিং—প্রত্যেকেই নিজের নিজের সাহিত্যকর্মের উপর লিউইস-এর ‘হেপ্টালজি’-র প্রভাব মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন।

নার্নিয়ার মায়াবী আখ্যানের সূচনা যার হাত ধরে, সেই ‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’-এর পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হল গত ১৬ অক্টোবর।সীমার মধ্যে অসীমের সন্ধান করা এই অনবদ্য উপন্যাস আগামী দিনে আরও বহু পাঠকের মন জয় করবে, এ কথা নিশ্চিত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

C. S. Lewis narnia

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy