Advertisement
E-Paper

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

অ নিতা ভারী ডিগডিগে, তেজি একটা মেয়ে ছিল। সে আমাদের বাড়ি ঠিকে কাজ করত। কিন্তু জগৎসংসারে হেন কিছু নেই যা সে জানত না। বাড়ি ঢোকামাত্র অনিতার রেডিয়ো চালু। কাল কোথায় দুই বস্তিতে মারামারি হয়েছে, কে কে সেখানে সোডার বোতল ছুড়েছে, কংগ্রেস-সিপিএম কী কী কাজ ঠিক করছে, কী ভুল করছে, প্রসেনজিতের নতুন বইটা কেমন হয়েছে, ক্যালোরব্যালোর করে সে সব গল্প বলে চলত। কে শুনছে, কে শুনছে না, সে নিয়ে ভাবার সময় ছিল না তার।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩

অ নিতা ভারী ডিগডিগে, তেজি একটা মেয়ে ছিল। সে আমাদের বাড়ি ঠিকে কাজ করত। কিন্তু জগৎসংসারে হেন কিছু নেই যা সে জানত না। বাড়ি ঢোকামাত্র অনিতার রেডিয়ো চালু। কাল কোথায় দুই বস্তিতে মারামারি হয়েছে, কে কে সেখানে সোডার বোতল ছুড়েছে, কংগ্রেস-সিপিএম কী কী কাজ ঠিক করছে, কী ভুল করছে, প্রসেনজিতের নতুন বইটা কেমন হয়েছে, ক্যালোরব্যালোর করে সে সব গল্প বলে চলত। কে শুনছে, কে শুনছে না, সে নিয়ে ভাবার সময় ছিল না তার।
এক দিন তো সে আমার রাশভারী, ছবি বিশ্বাস টাইপ জ্যাঠাকে সাট্টা খেলার নিয়মও শিখিয়ে দিল! কিন্তু ও সাট্টা খেলার রুল জানল কী করে? খুব সহজ। তার রিকশাওয়ালা স্বামী সন্ধের পর থেকে সাট্টা দিশিতে নিমজ্জিত থাকত। মাঝে মাঝে শ্রীঘর ঘুরে আসত। অনিতার সঙ্গে মারপিট নিত্য বরাদ্দ ছিল। অনিতা পর দিন সকালে খুব গর্ব করে বলতও, ‘কাল দিয়েছি এক রদ্দা। শুধু লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে দিশি খাওয়া!’ তাতে অনিতাকে আরও সমীহ করতাম। কারণ প্রাকৃতিক নিয়মে অনিতারাই মার খেয়ে থাকে। অনিতা যে ফিরে দিতেও পারে দু-চার ঘা, এ সত্যিই সাবাস-যোগ্য।

সেই বীরাঙ্গনা অনিতা এক দিন কাজে এল, এবং সে চুপ। আমরা সবাই খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। ওর চোখমুখ ফোলা। মা-জেঠিমা অনেক করে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘হ্যাঁ রে, তোর কিছু হয়েছে? বরের সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করেছিস? বাচ্চাদের শরীর খারাপ?’ কিছুরই সে উত্তর দেয় না। মুখ নিচু করে কাজ করে যায়।

দুপুর গড়াতেই কাজ সারার পর কোনও কোনও দিন অনিতা আমাদের বাড়ি খেয়ে আবার অন্য বাড়ি কাজে চলে যেত। সে দিন হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ কী রান্না হয়েছে গো?’ মা বলল, ‘ডিমের ঝোল।’ অনিতা ম্লান মুখে বলল, ‘আচ্ছা ছোটমা, আমার খাবারটা আমি না আজ বাড়ি নিয়ে যাব।’ মা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আবার বাড়ি যাবি, খাবি, ফের কাজে আসবি। খুব দরকার বাড়ি যাওয়ার?’ তেজি অনিতা হঠাৎ অবসন্ন হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। যেন তার সব অস্ত্র অকেজো হয়ে পড়েছে।

আর দু’এক বার জোরাজুরিতে সে ফুঁপিয়ে উঠল। ‘এ মানুষটাকে নিয়ে কী করি বলো তো ছোটমা? পরশু রাতে খুব ঝগড়া-মারামারি করলাম। মদের টাকা দিইনি। ছেলের ইসকুলে জমা দিতে হবে, সেই টাকাটা রেখেছিলাম বিছানার তলায়। যেই নিতে গেল, আমিও দিলাম হাত মুচড়ে, খিমচেও দিয়েছিলাম। রাগ করে সারা রাত বাড়ি ফেরেনি। কাল রাতে টালমাটাল হয়ে ফিরল। শুধোলাম, তুমি টাকা পেলে কোথায়? রিকশা তো নিয়ে যাওনি। খুব মুখ খারাপ করে গাল পাড়ল আমায়। মাঝরাত থেকে কী বমি, ধাত ছেড়ে যাচ্ছে, চোখ উল্টে যাচ্ছে। পেট পাকিয়ে পড়ে যাচ্ছিল বার বার। চেপে ধরলাম, বলো কী হয়েছে। বলল, আমি টাকা দিইনি বলে ও কাল রক্ত বেচে সেই টাকায় মদ গিলেছে। খালি পেট, সারা দিন কিচ্ছু খায়নি। কাল মানুষটা যেতে বসেছিল গো! আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দাও, এক বার নিজের কথাটা ভাবলে না গো। ওই তো রোগা চেহারা, তায় সারা দিন রিকশা টানে। ওর কী এ সব পোষায়? তাই ভাবলাম গোটা ডিমটা খেলে যদি শরীরটা একটু ঠিক হয়’ বলে ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল অনিতা, দ্য লক্ষ্মীবাঈ।

Sanchari Mukhopadhyay egg book Prosenjit Chatterjee Prosenjit Chattopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy