বর্ষার আকাশ বেদনাসম্ভূত। অথৈ জলে মাঠ-ঘাট থই থই, অথচ হিয়ার আগুন জ্বালিয়ে রেখেছেন নজরুল। পাড়ার একলা গলিটি যখন কদমকেশর বন, সেও শুধোতে ছাড়ে না যে, অনেক নবধারা বয়ে গেল, তোর কিশোরটি কোথায়? এই তো আজ আস্ত এক নীপবন সাজিয়ে তুলল শ্রাবণ-ঠাকরুন কলোনির ঘিঞ্জি এই বাজারে, তুই কার সঙ্গে স্নান করতে যাবি ধানী রং ঘাঘরি আর মেঘরং ওড়না পরে?
বিচ্ছেদের সঙ্গে ছায়ামিলন্তি খেলতে খেলতে যে মল্লার ক্রমে মিঞা হয়ে ওঠেন, তিনি মুচকি হাসেন উতল হাওয়ায়। আর কোন ঋতুর সঙ্গেই বা এমন সরাসরি বিরহযোগ? স্মৃতির সঙ্গে ফুটবল খেলতে খেলতে পৌঁছে যাওয়া অনন্ত গোলপোস্টের কাছে আর কোন সময়েই বা? বসন্ত দেয় অবিমিশ্র প্রেম আর রঙের উৎসব, ফোটায় দেহজ কুসুম। শীত দেখায় পিকনিকের টায়ারে উড়ে যাওয়া ধুলো, ক্রিকেটের কারুসাজ, মাফলারে ঢেকে রাখা আতুর টনসিলের মতো ভালবাসা। শরতে নীল ঘুড়ির মতো উড়তে থাকা আকাশে উৎসব মানায় ভাল। সে এক দুর্লভ আলোকমঞ্জরির গল্প, যার দিকে তাকিয়ে গোটা দিনের কায়িক শ্রমকেও মেনে নেয় বেলুন বিক্রি করা শিশু। হেমন্তের বিষণ্ণতা অলোকসামান্য ধ্রুপদী, জীবনানন্দের মতো। সে গগন গগনে আপনার মনে খেলা চালিয়ে যেতে পারে না।
বর্ষায় ঝাঁপি খুলে বসে অন্য জন্ম, অন্য সময়, অন্য শব্দকল্পদ্রুম। যে সময়কে কখনও পুইয়েছি বলে মনে হয় ঠিকই, তবে সে কবে, কোন মানবজন্মে, তা যেন ঠিক মনে পড়ে না। ফরাসিরা যাকে যত্নে বলেন ‘দেজা ভ্যু’, আর আমরা বলি, কোন অতলের বাণীকে খুঁজে পাওয়া। রবীন্দ্রনাথের বহু বর্ষাবন্দনা যৌবনের, সব প্রৌঢ়ত্বের বেলা পোহানো বেলায় লেখা নয় মোটেই। কিন্তু সেই যৌবনেও বা মধ্যবয়সে লেখা সেই গানে কোনও ব্যাকুলের কান্না আর হাহাকার। যা কখনও বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে আসা। যা ভিন্ন সময়ের, যে সময় ক্যালেন্ডারে নেই, ইতিহাসেও সব সময় যে রয়েছে তা-ও নয়। যে সময়যান চলছে ভিতরের পথে। অর্থাৎ ‘যাহা দেখেছি তারে ঘিরেছে নিবিড়, / যাহা দেখি নাই তারি ভিড়।’ অন্ধকার আকাশ, উপর্ঝরণ বৃষ্টি তো দেখছি, ওই যে এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে বাজারের থলি হাতে নাকাল হওয়া মানুষ, জল-ছলছল পথ কেটে রিকশার গতি, ইস্কুল-ফেরত শিশুদের জলের সঙ্গে ফুটবল খেলা— সবই দেখছি। কিন্তু সেই ভিজল প্রেক্ষাপটে সামনের সব ছবি আবছা হয়ে অন্য কিছু ফুটে উঠছে যেন। বা ফুটে ওঠার আগেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মাতৃগর্ভের স্মৃতির মতো। কখনও তা জাগতিক অনুবাদে কোনও এক সুরের রেশ, কোনও অসমাপ্ত মুহূর্ত, অর্ধসমাপ্ত চুম্বন, তুমুল আড্ডার ধুয়ো, সিঁড়িতে দেখা এক মুহূর্তের প্রেম, লেফট উইং থেকে বন্ধুর থ্রু, সবই ব্রাশ-স্ট্রোকের মতো বিমূর্ত।
রবি ঠাকুরের কথা যখন বর্ষায় অনিবার্য, তখন ফিরে আসি গীতবিতানেই। যেখানে বৃষ্টিশেষের হাওয়া কার খোঁজে বইছে ধীরে ধীরে? কবি জানেন না স্পষ্ট কী সেই কথা। গোটা গানে এই কথার খোঁজ চলছে। ‘কত যুগের কত মনের কথা বাজায় ফিরে ফিরে’। সদ্য শেষ হওয়া বর্ষায় এইমাত্র যে হাওয়ার ঝাপট এসে লাগল লালকেল্লায় প্রখ্যাত চাঁদনি চকের কাচের চুড়ির গলি থেকে, তা আসলে টুংটাং করে বেজে গিয়েছে, ‘কত যুগের কত মনের কথা নিয়ে’। শুধু ছেড়ে চলে যাওয়ার দলই কেন ফিরে ফিরে আসে মেঘের সঙ্গে? হয়তো বর্ষা কোথাও একটা শূন্যতাও তৈরি করে দিয়ে যায় বলে। বর্ষার এই বিরহসুতো নিজেকে গাঁথতে থাকে কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত হয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সেরে জয় গোস্বামী, জয়দেব বসু, যশোধরা রায়চৌধুরীতে। জয়দেব বসু তাঁর বহুপঠিত ‘মেঘদূত’ শুরুই করছেন নতুন ভাষায় পুরনো বিরহের বোতল খুলে— ‘আকাশে রেখেছো কার অশ্রুসজলতা, দু’বাহু তুলে এই বিজ্ঞাপন/ এঁকেছি পাথরে আজ কীভাবে দূরে থাকি, বাক্য শুষে নেয় কণ্ঠনল।’ জয়ের জনপ্রিয় দীর্ঘকবিতার (মেঘবালিকার জন্য রূপকথা) জার্নি শেষে বর্ষাসূত্রে তাকিয়ে থাকছেন এমন এক বাস্তবতার প্রেক্ষিতরহিত ‘নো ম্যান’স ল্যান্ড’-এ, যেখানে বৃষ্টি ছাড়া সব অন্ধ। ‘...কবি তখন কুটির থেকে/ তাকিয়ে আছে অনেক দূরে/ বনের পরে, মাঠের পরে/ নদীর পরে/ সেই যেখানে সারাজীবন/ বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে,/ সেই যেখানে কেউ যায়নি/ কেউ যায় না কোনদিন...।’ যশোধরা বলছেন, ‘...আকাশের রঙ ভেসে গেছে বৃষ্টিতে/ চোখে দেখা আর যাচ্ছে না, এত কাছে/ শাদা হয়ে গেছে বৃষ্টির শত ধারা/ প্রণয়ে কিছুটা দূরত্ব থাকা ভাল।’ আর এই সব পঙ্ক্তির কিছু আগেই শক্তি লিখেছেন, ‘কিন্তু তুমি নাই বাহিরে অন্তরে মেঘ করে’।
*****
সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল, নবজলধারা? স্মৃতি, বিরহ, শূন্যতা, হাহাকার মেলানো এক মায়াঋতুর কথাই তো? যেখানে বিকেলের মুখে ঝুঁকে পড়া মেঘ পুরনো বন্ধুর মতো। যে হয়তো আর বন্ধু নয় আজ, পশ্চিমের কোনও নির্জন পাড়ায় মেপল-বিছানো পথে হেঁটে গিয়েছে, শত পরাজয় দিয়ে গিয়েছে বিনিময়ে, ফিরে আসছে বর্ষার রথে। স্মৃতির কামরা থেকে বার বার নেমে যাওয়া, দমদম লোকাল থেকে আয়ুর নাগরদোলায় চড়ে সে বন্ধু হয়তো পুরনো শহরেই ফিরে এসেছে, অথচ আজ তাকে রাস্তায় দেখলেও চেনা যাবে না আর। শ্রাবণ গহন হওয়ার মুখে এমন বিকালে মনে মনে তার সঙ্গে কয়েক পা যাওয়া চলে, গভীর বৃষ্টি আসার আগে। একটা সিগারেটের কাউন্টার-সময়ও কলাপাতার উপর প্রথম বৃষ্টির জলের মতো হীরকপ্রভ হয়ে ওঠে তখন। চায়ের কেটলিতে শ্বাসধ্বনি ওঠে সঙ্গতে। আকাশ কাচা জামাকাপড়ের মতো শুভ্রতা হারায়। মেঘের মধ্যে কালো-নীল চুমকিতে সেজে ওঠে তার যাত্রাপথ। প্রথম চুম্বনের মিঠে-নোনা স্বাদ ফিরে আসে।
আবগারি আবহাওয়া, সম্পর্ককে ভিতর থেকে ভিজিয়ে দিতে থাকে। সিঙ্গল মল্টে জল মিশে যায়। এমন দিনে একটি ছাতার নীচে গড়ে তোলা যায় মায়া টিউটোরিয়াল। কারও চশমার কাচে জলের ফোঁটায় এক জীবনের পরিতাপ ঝলসে ওঠে। উল্লাসে মাতোয়ারা গাছেদের সাক্ষী রেখে ব্যথা বিনিময় করে নেয় পিছলে পড়ার আগের পতঙ্গপ্রাণ। নেশা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠেন উস্তাদ আমির খান, ‘বরষন লাগি রে বাদরিয়া, ছায়ে বাদরিয়া।’ জলের ছিটে সঙ্গে নিয়ে শিস কাটতে কাটতে ঘরে ঢুকে এসে ফরাসি কায়দায় শ্রাগ করে পুরনো প্রেম। নতুন বেলজিয়াম কাট গ্লাসে ঢেলে নেয় ভদকা আর টোমাটোর রক্ত। ড্যাম্প হয়ে আসা সফেদ সিগারেট আরও ভিজতে থাকে ঠোঁটে। এ সব রূপকথার অভিমানের মাঝেই অতীতের রেকর্ড থেকে কখনও মুখ তোলেন, স্বর্ণকেশী লিন অ্যান্ডারসন। বলেন, ‘আই বেগ ইয়োর পার্ডন/ আই নেভার প্রমিসড ইউ আ রোজ় গার্ডেন/ অ্যালং উইথ দ্য সানশাইন/ দেয়ার গট টু লিটল রেন সামটাইম…’
সত্যিই তো। সার্বক্ষণিক রৌদ্রের নাম তো জীবন নয়। সম্পর্কে ঝড়বাদল না থাকলে, তাকে সম্পর্ক বলে মনে করা যায় কি? বজ্রপাতের শব্দহীন কোনও নিশ্চিন্ত সংসার ভূ-ভারতে কেউ দেখেছে কখনও? বর্ষা শেষ হলে পড়ে থাকে নির্জন রেনকোট, যাপনের দীর্ঘ ক্লেশ আর খোঁয়াড়ি। যাদের একাকিত্বের কাছে জলের দাগ লেগে রইল।
*****
এই প্রায়ান্ধকার সময়েই কমে আসে ইলিশের দাম, যদি ঈশ্বর করেন! জলের এই উজ্জ্বল শস্য সেজে ওঠে পাতে। বাইরের সোঁদা গন্ধ আর রান্নাঘরে ভাজার ঘ্রাণ, একে অন্যের সঙ্গে জ্যামিং করতে করতে জানলার বাইরে মিলিয়ে যায় দিগন্তের দিকে। অপুর খিদে পায় রোজ। দুর্গা ওই অনাস্বাদিত ইলিশের কপাল থেকে চুরি করে নেওয়া রুপোলি পমেটম জমায় নিভৃতে। তাদের ব্যক্তিগত উঠোনে এসে দাঁড়ান ইলিশ-ঠাকরুন।
কালোজিরে সর্ষেয় সুসজ্জিত ইলিশ বাঙালির সংস্কৃতিচিহ্ন, তার জন্মদাগের মতোই। এর সঙ্গে মিশে রয়েছে গোয়ালন্দগামী স্টিমারের ভোঁ, দেশভাগের রক্তাক্ত অতীত। তবে পদ্মাই হোক বা গঙ্গা— মেঘের কোনও তারকাঁটা নেই। মেঘের আজও প্রয়োজন হয় না ভিসা অন অ্যারাইভাল। ইলিশকে ঘিরে তাই বঙ্গজীবনের পারা উথালপাথাল করে প্রতি বর্ষায়, প্রতিটি ভূখণ্ডেই। এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে ইলিশের সামান্য অংশভাক ব্যাগে নিয়ে, কর্দমাক্ত মাছের বাজার থেকে বিজয়ীর গর্বে ফিরছেন পেনশন-প্রবীণ— এই দৃশ্য ঋতুচক্রের মতোই প্রতি শ্রাবণে ফিরে ফিরে আসে। এই সব কিংবদন্তি থেকে, বৃষ্টির মহাভোজ থেকে, এক-এক জনের পাতে চার-পাঁচটা পড়ার দুর্লভ স্মৃতি থেকে, নরম ডিমের আশ্চর্য রং থেকে উঠে আসে এক ইন্দ্রজাল। তাকে তালসঙ্গত দেয় মুসুর আর মুগডালের কারুবাসনা। আকাশে মেঘ ঘনিয়েছে, জর্জ বিশ্বাসের কিংখাব থেকে সদ্য বেরোনো তলোয়ারের মতো কণ্ঠে, ‘আজ সকাল বেলার বাদল আঁধারে’ ঘনিয়েছে বিষাদও, আর আপনি হাঁড়িতে খিচুড়ি চাপাতে ভুলে গিয়েছেন— এমনটা কি শাস্ত্রসম্ভব? ওমলেটের সোনালি, পাত করে কাটা বেগুনের বেসন-বিলাস, বাতাসকে চঞ্চল করে তোলা শুকনোলঙ্কা ফোড়ন, কুমড়ো আর বকফুল ভাজা যে দেবীর উপচার, তাকেই বর্ষা বলে ডাকি আমরা। জলের এই রুপোলি শস্যটির মায়াটান বঙ্গের বাইরে দেশের রাজধানীতে আজও একই রকম মোহময়। আর তাই, ইলিশের সঙ্গে অবলীলায় মিশে গিয়েছে প্রবাসী নস্টালজিয়া, বঙ্গ-কৌলীন্য, সামাজিক শিকড়, সাংস্কৃতিক চিহ্ন, বিভিন্ন মিথ, দরাদরি, ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার হতাশা। তাকে ঘিরে দিল্লির বঙ্গজীবনের থার্মোমিটারের পারা উথালপাথাল করে প্রতি বর্ষায়। প্রবাসে ইলিশ বাঙালিত্বের একটি লক্ষণ। একটা মর্যাদাবোধও যেন জড়িয়ে রয়েছে ইলিশের সঙ্গে। যাকে আত্মাভিমানও বলা চলে। এক দিকে সাহেবি দিল্লি (লাটিয়ান), অন্য দিকে মুসলমানি পুরনো দিল্লির মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছিল বাঙালি। সে সময়ে গোলমার্কেটে বসানো হয়েছিল মাছের বাজার। তখন কলকাতা থেকে গঙ্গার মাছ আনার ব্যবস্থা ছিল না। বিমানে উড়িয়ে আনার তো প্রশ্নই নেই। রেলেও বরফবন্দি করে আনার সুব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু তখনও বাঙালির পাতে ইলিশ পড়ত। কী ভাবে? এলাহাবাদের ইলিশ এখানকার বাজারে তখন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাত। ডিম পাড়ার সময় ইলিশ বেশি নোনতার পরিবর্তে কম নোনতা জল খোঁজে। আর সেই খোঁজেই তাদের ঝাঁক বেঁধে এলাহাবাদের গঙ্গা পর্যন্ত আসা। এলাহাবাদের গঙ্গা থেকে অনেক সময়েই ফিরে যেতে পারত না সেই ঝাঁক। তবে সে ইলিশে স্বাদ থাকলেও গন্ধ ছিল না।
প্রবাসী বাঙালির নতুন প্রজন্ম আজও যে বর্ষার ইলিশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি তার অন্যতম কারণ, ছোট থেকে প্রবহমান পারিবারিক ইলিশ-আড্ডা! ইলিশ-সংস্কৃতি! ইলিশ তো শুধু খাওয়ার নয়, গর্ব করার এবং গল্প করার বিষয়ও বটে। তা সে যে আড্ডাই হোক না কেন। বাজারে যা দাম, তাতে হয়তো আমি মাছটা কিনতে পারছি না। কিন্তু দেখে এসে প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে ইলিশের দাম নিয়ে কথা বলাটাও তো সুস্বাদু! দিল্লিতে দীর্ঘদিন বসবাসকারী বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ইলিশ-প্রেম এখনও অব্যাহত। তাঁর কথায়, “মাছ ছাড়া আমার কোনও দিন নেই যে, যায়। ইলিশ তো কিনিই। পদ্মার ইলিশ কিনতে গিয়ে ঠকেছি অনেক। ভুল করে গুজরাতের ইলিশও কিনেছি। ঘাসের মতো খেতে! ইলিশ আমি বেশির ভাগ সময়ই কালোজিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে রাঁধি। একা কখনও খাইনি ইলিশ। বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাই। ইলিশ একা খাওয়ার মাছ নয়।”
সত্যিই তো! ঝমঝমে বর্ষার মধ্যে ইলিশ একলা খাওয়ায় মজা নেই। এর আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে।
*****
আমাদের কিশোরবেলায় পুরনো এডিশনের ডিমাই সাইজ়ের ‘মেঘদূত’-এর উপরে জল পড়ত প্রথমে। পড়তেই থাকত টুপটাপ করে। যে ভাবে বাঘা বাইনের ঢাকের উপর বাড়তি জলটুকু ঢেলে দিচ্ছিল সদ্যস্নাতা গাছ। আর গুপীর গলায় সুর এসেছিল আচম্বিতে। সে ভাবেই দশ দিক কালো করে দশভুজা হয়ে মল্লার আসত। হলুদ পলস্তারা-খসা, পাঁজর বার করা ইস্কুল-কলেজ, চিলতে পার্ক, আবাসন, দেওয়ালের পোস্টারে স্বপ্ননায়িকা, ক্যান্টিন, কফিঘরের দেওয়াল, অশ্বত্থের প্যাঁচালো শরীরে ভরসা করা ইটের গাঁথনি, পেট-খোলা ইলেকট্রিক বোর্ড আর তার ভিতরে পাক খেয়ে জুজু হয়ে থাকা তারের সংসারে। বদলে যেত আলো আর তার সংলগ্ন মুখচ্ছবি।
কলেজ স্ট্রিটের বাণিজ্যে বর্ষা আসত দুঃখ নিয়ে। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি থেকে উপচে যাওয়া কলেজ দিঘি পর্যন্ত। সময় বেশি নেই, তাই নামমাত্র দামে বিকিয়ে যাচ্ছে পদাবলী ও প্রেম, পালগ্রেভের সোনালি, পাউন্ডকে লেখা এলিয়টের অভিমান, মডিউলার কিচেন অথবা অন্দরসজ্জার কেতাবিয়ানা, হলুদ মলাটের রোমাঞ্চকর যামিনী। কারও সর্বনাশ, কারও আষাঢ় মাস! এর পর জলের তলায় চলে যাবে অক্ষরসভ্যতা।
আমরা ভাবতাম, বহু যুগের ওপার থেকে মোষরঙা কুরিয়ার প্যাকে এসেছিল মেঘ, সে তো শেষরাতেই। কলেজ স্ট্রিট-সহ গোটা কলকাতা যখন আড়মোড়া ভেঙে টাইগ্রিস হতে চেয়েছিল। ভিতরে শচীনকত্তার সেই স্নায়ুজব্দ কণ্ঠ— ‘মেঘলা নিশিভোরে মন যে কেমন করে!’ প্লাস্টিকের শিট নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় তখন যুদ্ধতৎপরতা শেষ মুহূর্তে। ফ্লাইওভারের পেটের তলার পুতুলের সংসার, শুকনো জীবনের শেষ প্রাপ্যটুকু বুঝে নিয়ে ছাঁদা বেঁধে দৌড়চ্ছে অন্য আকাশের নীচে যাওয়ার জন্য। জলের ঢেউ, স্রোতের নীচের খোলা ম্যানহোল ঠোঁট চাটছে মানুষ খাবে বলে। আজ পুরসভা জাগ্রত দ্বারে! যাদের ভোট নেই, তাদের জন্য রয়েছে বিস্তৃত বারিধারা। হায় পথবাসী হায় গতিহীন হায় গৃহহারা! নীল প্লাস্টিকের বান্ডিলে সব পুরে নিয়ে ঝপাঝপ শাটার ফেলার শব্দ শুধু। বদর বদর। যে মাঝিমাল্লা দুর্বিপাকের আগে নোঙর করেছে, তাদের ক্লান্ত জলযান হয়ে গিয়েছে বন্ধ দোকান। এরই মাঝে অলিগলির মধ্যে তৈরি হওয়া জলপথে বয়ে যাচ্ছে পকেট থেকে ফসকে পড়া, ঝাপসা পরিচয়পত্রগুলি।
আড়াই দশক আগে দিল্লির গ্রীষ্ম ছিল খর— দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ যামিনী, দীর্ঘ বরষ মাস। গোটা দেশ ধুয়ে যাচ্ছে, কলকাতায় বাঘের মতো বাজ ডাকছে, এমনকি পড়শি লখনউও কিছুটা হলেও ‘বরিষ ধরা মাঝে’, অথচ দিল্লিতে একের পর এক ডেট মিস করেছেন শ্রীমতী বর্ষা, এমনটা গিয়েছে বছরের পর বছর। এক পক্ষকাল ধরে রোজ জাতীয় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় একটি আশ্বাসমূলক স্টোরি— ‘কালও বিলম্ব হল ঠিকই, কিন্তু আজ আসছে!’ শহরবাসীও ফিল্ডিং কাটছে মেঘের ক্যাচ উঠবে কখন, আর বাস্তবিকে ঝলসে ঝামা। গোটা জুন এবং অর্ধ জুলাই মেঘের কোনও আত্মীয়স্বজনকেও দেখা যেত না দিগন্তে। খরখরে রোদ, যমুনার জল নেমে যাচ্ছে রোজ। অবশেষে ভৈরব হরষে না হলেও, জুলাই শেষে কয়েক দিনের জন্য সুর্মার বিভিন্ন শেড পরে নিত আকাশ, জলভরা উথালপাথাল হাওয়া। আকণ্ঠ ভিজতে চাইত শহর। বর্ষা থাকত বড়জোর এক মাস, তা-ও সামান্য কয়েক দিন মাত্র।
মুম্বই যে ভাবে শীতের জন্য প্রস্তুত নয়, তেমনই রাজধানীর পরিকাঠামো কখনওই তৈরি ছিল না বর্ষার জন্য। কিন্তু গত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনও জটিল কার্যকারণ সূত্রে বর্ষার মতিগতি পূর্বাভাসহীন, নকশাবিরহিত, ঝোড়ো। মে মাস যেখানে শুকনো আছাড়িপিছাড়ি লু বা গরম বাতাসের জন্য প্রখ্যাত ছিল, তা এখন অবিরল বর্ষাবহনকারী নিরন্তর কালবৈশাখীতে (বৈশাখ চলে গেলেও) পরিণত। ঝড়ের গতি হামেশাই পৌঁছে যাচ্ছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটারে, মাথায় সরাসরি পড়লে ফেটে যাবে এমন শিলাপতন হচ্ছে, উল্টেপাল্টে যাচ্ছে বিমান উড়ানের সময়, ভেঙে পড়ছে বিমানবন্দরের কাঠামো, নাকাল হচ্ছেন যাত্রীরা, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে দিল্লি থেকে শ্রীনগরগামী একটি উড়ান। জ্যৈষ্ঠ মাসেই বৃষ্টিপাত এক দিন পৌঁছেছে প্রায় আশি মিলিমিটারে, স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক।
সবচেয়ে বিপদ তৈরি হচ্ছে সবুজে মুড়ে দেওয়া দক্ষিণ, লাটিয়ান এবং পূর্ব দিল্লির গাছগাছালি থেকে। গোটা শহর জুড়ে গাছপতনের শব্দ শুনতে যতটা কাব্যিক, বাস্তবে ততটাই আতঙ্কের। সাম্প্রতিক প্রকৃতির ধ্বংসলীলায় দিল্লির পুরবিভাগ দৈনিক ষাটটি পর্যন্ত মহীরুহ পতনের অভিযোগ পেয়েছে, আসল সংখ্যা অবশ্যই তার চেয়ে বেশি। রাতের অন্ধকারে মৃত্যুফাঁদ পেতে রাখে এই ভূপতিত বৃক্ষ, যানবাহনের জন্য। স্থানে স্থানে বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্নতা যাকে আরও আশকারা দেয়। আসলে পর্যটকরা এবং কাজেকম্মে আসা মানুষ রাজধানীর যে সবুজায়ন দেখে মুগ্ধ হয়ে ফিরে যান, তা আসলে এক শিকড়হীন বিস্ময়। এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলস্তর এমনিতেই ছিল কম, তা নাকি আরও হ্রাস পাচ্ছে। দিল্লির অনেক গাছের প্রজাতি, যেমন নিম, জাম, অশ্বত্থ এবং বটের গভীর মূল শাখা-প্রশাখা নির্ভর করে নীচের জলস্তরের উপর, বিশেষ করে শুকনো মরসুমে। জলস্তর কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এই শিকড়গুলি আর প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা পেতে পারে না। এর ফলে তাদের দেহকাণ্ড এবং শাখা শুকিয়ে যায়, তীব্র বাতাস সহ্য করতে অক্ষম হয় এবং ভেঙে পড়ে। বৃষ্টিতে কিছুটা সতেজ হয় আবার শুকনো বাতাসে মুষড়ে পড়ে। গাছের এই উপড়ে পড়ার পিছনে জলস্তর কমে যাওয়া ছাড়াও আরও বেশ কিছু ব্যাখ্যা দেন বিশেষজ্ঞরা। যার অন্যতম, অনুপযুক্ত বৃক্ষরোপণ পদ্ধতি, অর্থাৎ যখন গাছগুলি সরু ফুটপাতে বা রাস্তার পাশে রোপণ করা হয় যেখানে শিকড় বিস্তারের জন্য জায়গার বড়ই অনটন। ব্যাপক নগরায়ণ এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নের দ্রুত গতিও একটা কারণ তো বটেই।
*****
বর্ষা তো একা আসে না, সঙ্গে নিয়ে আসে অনেক অনূর্ধ্ব ফুটবল প্রতিযোগিতা। বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা সেন্টার ফরোয়ার্ডের গতি রুদ্ধ করতে পারে না কোনও দিন। বরং ময়দানের ঘাসের রেনডান্স হর্ষে বিভোর হয়ে বরাবর গড়িয়ে দিয়েছে ফাইনাল পাস। যেখানে সেই বালক এবং গোলকিপারের মধ্যে বর্ষার বল্লম শুধু। ঝাপসা গোলপোস্টকে নিশানা করে যাবজ্জীবন বাজি রাখা সেই পাঞ্চ, গ্যালারির ফেটে পড়ার কাছে সলতে হয়ে থাকে বিজন বিকেলে। চামড়ার বল ক্রমশ ভারী হতে থাকে, আর তাকে দখলের চেষ্টায় কাদামাটির শিল্প গড়ে ওঠে। মাঠ বাঁচাও কমিটিকে দুয়ো দিয়ে তৈরি হয় নতুন নতুন গহ্বর। শ্যাম থাপার ব্যাকভলির সমুজ্জ্বল স্মৃতি ম্লান চায়ের দোকানগুলিতে কিছুটা আলো ফেলে। ময়দানের জলভরা হাওয়া এসে লাগে শহরতলির কার্নিসে। অন্ধকার চুন-খসা দেওয়ালে কোনও ক্রমে পোস্টার হয়ে টিকে থাকেন মেসি-মারাদোনা! বর্ষা শেষ হলে, কোনও এক আশ্বিন-সকালে, দেওয়ালের পুনর্জন্মের আশায়।
হেমিংওয়ে সাহেব লিখেছিলেন, বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পাওয়া সম্পত্তি ছিল, চাঁদ আর সূর্য। মানে আকাশভরা সূর্য তারা। পাশাপাশি এটাও লিখেছিলেন, গোটা পৃথিবী টো টো করেও সেই সম্পত্তি কিছুতেই শেষ হচ্ছে না! কাদামাঠে ফুটবল দাপানো এক কিশোর তার নুন-মরিচ জীবনে পৌঁছে যে একমাত্র উত্তরাধিকারের কথা ভাবে, তা হল এই বৃষ্টি। বাল্য এবং কৈশোর জুড়ে বৃষ্টি নামলেই দু’ভাই-বোনকে নিয়ে সটান ভিজতে রাস্তায় নামতেন বাবা। কিশোরের অল্পবয়সি চশমা ভেসে যেত। তবুও হাঁটা, তখনও অনেক পুকুর শহরে। জমে যাওয়া জল ড্রিবল করে। বৃষ্টির দিনে এ সব মনে পড়ে বেশি, যখন দিল্লি সরকার জল সামলাতে না পেরে যমুনার পাড় প্রতি বছর ভাসিয়ে দেয়। যখন বৃষ্টিজনিত রাস্তায় আটকে রিয়ার গ্লাসে মায়বিভ্রম তৈরি হয়। ঝাপসা হয়ে আসা ফুটবল মাঠ থেকে ভেসে আসে গ্যালারি-কাঁপানো হর্ষ।
এ সব ছাড়িয়ে নদী হয়ে ওঠা কোনও প্রাচীন গলি দিয়ে হেঁটে যান আনাড়ির মতো ছাতা হাতে রাজ কপূর, তাঁর ব্যক্তিগত নার্গিসকে নিয়ে…
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)