Advertisement
E-Paper

স্বাধীনতা তুমি...

আজ শালা দিনটাই খারাপ! সকাল থেকে একটার পর একটা লাফড়া। চিত্তরঞ্জনের রেল কারখানায় ক্যাজুয়াল লেবারের কাজ করত গৌরাঙ্গ। ইউনিয়নের নেতা সুধাময়বাবু বলেছিলেন, যেমন কাজ পাওয়া যায় করে যেতে। পার্টির সঙ্গে লেগে থাকলে তিনি ঠিক একটা হিল্লে করে দেবেন।

সঞ্জয় দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

আজ শালা দিনটাই খারাপ! সকাল থেকে একটার পর একটা লাফড়া। চিত্তরঞ্জনের রেল কারখানায় ক্যাজুয়াল লেবারের কাজ করত গৌরাঙ্গ। ইউনিয়নের নেতা সুধাময়বাবু বলেছিলেন, যেমন কাজ পাওয়া যায় করে যেতে। পার্টির সঙ্গে লেগে থাকলে তিনি ঠিক একটা হিল্লে করে দেবেন। হিল্লে মানে ফ্যাক্টরিতে একটা পার্মানেন্ট চাকরি। হয়নি। সেই ঝাড়খন্ডি আর বাঙালির ঝগড়া। কোল বেল্টের এক বড় নেতার সঙ্গে বেঁধে গেছিল সুধাময়বাবুর। রাজায় রাজায় ঝগড়ার শিকার হতে হল গৌরাঙ্গের মতো কিছু সাধারণ লোকের।

চাকরিটা হবে না, বুঝতে পারার পর থেকেই এক’পা দু’পা করে অপরাধ-জগতের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায় গৌরাঙ্গ। সে অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নিতে বেশি সময় নেয়নি। পরিবর্তে দিয়েছে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা। সত্যি কথা বলতে কী, ক্যাজুয়াল লেবারের কাজ করে যা পেত, তার থেকে এখন অনেক বেশি আয় করে গৌরাঙ্গ।

প্রথমে শুরু করেছিল ছোটখাটো চুরি দিয়ে। রেল ফ্যাক্টরিতে দিনের নানা সময়ে ট্রাকে করে নানা ধরনের সাপ্লাই আসে। সেই সব স্টক থেকে মাল সরিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে হাত পাকিয়েছে গৌরাঙ্গ। ক্যান্টিনের জন্য আসা মশলাপাতি বা অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের যন্ত্রাংশ পর্যন্ত, যখন যা পেয়েছে হাতে, তা-ই। একটু একটু করে বেড়েছে তার কাজের পরিধি। রেলের ওয়াগন থেকে মাল হাপিশ করা, গোডাউনের রাত-প্রহরীদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে ট্রাক ভর্তি মাল বার করে নিয়ে যাওয়া, মাঝেমধ্যে কয়লার রেক থেকে ভাল জাতের কয়লা সরিয়ে দিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করা।

অস্ত্র চোরাচালানের লাইনে বেশি দিন আসেনি সে। শুরু করেছিল হঠাৎই, রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্সের বাতিল করে দেওয়া কিছু মান্ধাতা আমলের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল আর কয়েক রাউন্ড গুলি সরিয়ে ফেলেছিল এই লাইনেরই আর এক জন। তার পর সেগুলোর কোনও খরিদ্দার না পেয়ে শরণাপন্ন হয়েছিল গৌরাঙ্গর। রাইফেলগুলোর সঙ্গে কয়েকটা রিভলভারও ছিল। সেগুলো দিয়েই এ লাইনে হাতেখড়ি গৌরাঙ্গর। অন্য যে কোনও অপরাধ-ব্যবসার থেকে অর্থোপার্জনের সুযোগ বেশি বেআইনি অস্ত্রের ব্যবসায়। এ লাইনে এখন সে পরিচিত মুখ। এই তল্লাটে তো বটেই, আসানসোল, রানিগঞ্জ, এমনকী কলকাতাতেও এখন তার যোগাযোগ। তাও খুব বেশি কাজ সে করে না। ব্যবসা বাড়াবার একটা বড় সমস্যা আছে গৌরাঙ্গর। সপ্তাহে দুটো বা তিনটের বেশি অস্ত্র লুকিয়ে রাখার জায়গা তার হাতে নেই। এ ব্যবসার একটা অসুবিধা হল, ধরা পড়লে শাস্তি সাংঘাতিক, বিশেষ করে যদি পুলিশ অফিসারটিকে ঠিকমত ঘুষ দিয়ে বাগে আনতে না পারো।

তাই সপ্তাহে দুটো বা তিনটের বেশি বন্দুক পাচার করার চেষ্টা করে না গৌরাঙ্গ। তাতেই বেশ আয় হয়। সে চেষ্টা করে ভাল মানের আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধানে থাকতে। একটা বেরেটা, ব্রাউনিং বা উইনচেস্টার বিক্রি করে যা টাকা পাওয়া যায়, তাতে হেসে-খেলে দু’তিন সপ্তাহ চলে যায়। স্ত্রী অলকার হাতে সংসার-খরচের টাকা তুলে দিয়েও বেশ খানিকটা হাতে থাকে তার। ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে মাল খাওয়া আর মাঝেমধ্যে নিষিদ্ধপল্লিতে গিয়ে ফুর্তি করার খরচ উঠে যায় তার। আর কী চাই? আর একটা সুবিধেও আছে। এ লাইনে এক বার নাম হয়ে গেলে মাল জোগাড় করা আর খদ্দের পাওয়ার সুবিধে। এ তল্লাটে অনেকেই জেনে গেছে, গৌরাঙ্গ সরকারের কাছে ভাল জিনিসের খোঁজ থাকে।

এই অঞ্চলেই বড় হয়েছে গৌরাঙ্গ। বাবা হরেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন ধানবাদে একটি স্কুলের শিক্ষক। তাতে কী? পিতৃপরিচয়ের গৌরবে মটমট করলে সংসার চলবে গৌরাঙ্গর? মা মাঝে মাঝে বুঝতে চায় না! বলে, ‘কী মানুষের ছেলে ছিলি তুই?’ সে মানুষটা মরে গিয়ে বেঁচেছে, আজ পনেরো বছর হল। রাস্তায় নেমে দেখো না বাবা, সংসার চালানোর জন্য দুটো পয়সা রোজগার করা কী কঠিন জিনিস!

সাইলেন্সার বসানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন এ-আর-১৫ সেমি অটোম্যাটিকটা হাতে পাওয়া মাত্রই গৌরাঙ্গ বুঝেছিল, এ তল্লাটে এ জিনিসের খদ্দের পাওয়া সহজ না-ও হতে পারে। কিন্তু বিক্রি করতে পারলে পয়সা যথেষ্ট হবে। মাস তিনেক আর কোনও কাজ না করলেও চলবে। এক্কেবারে নতুন মাল। ফরেন তো বটেই। মুম্বইয়ে কোনও বিদেশি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বন্দুকটা কেনে কলকাতার এক মারওয়াড়ি অস্ত্র-ব্যাপারি। সে উপযুক্ত ক্রেতা খুঁজছিল। খবর পেয়ে গৌরাঙ্গ গিয়ে জিনিসটা নিয়ে আসে তার কাছ থেকে। রফা হয়, সে বিক্রি করতে পারলে বখরা আধাআধি। না পারলে দু’সপ্তাহের মধ্যে গিয়ে সে মাল ফেরত দিয়ে আসবে। এ লাইনে মুখের কথায় লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা হয়। কথার খেলাপ কেউ করে না, কারণ তার শাস্তি একটাই— মৃত্যুদণ্ড।

বেওয়ারিশ মৃতদেহ পড়ে থাকবে রেল লাইনের ধারে, পচা ডোবার তলায়। কখনও বা ভেসে যাবে বরাকর নদীর স্রোতে।

গত কয়েক দিন ধরে হন্যে হয়ে খোঁজ করেছে গৌরাঙ্গ, এমন কারও, যে উচিত দাম দিয়ে বন্দুকটা কিনবে। কদর বুঝবে জিনিসটার। কোল মাফিয়ার জগতে তার যে ক’জন চেনাজানা আছে, সবাইকে বলেছিল খোঁজ করতে। জিনিসটা বিক্রি হলে ভাল কমিশনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। আজই খবর এসেছিল এক জায়গা থেকে, এক জন মালটা দেখতে চায়! লুকনো জায়গা থেকে বন্দুক বার করতে গিয়েই গৌরাঙ্গর মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। বন্দুকটার অস্তিত্ব যে কেউ জেনে ফেলেছে, সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট!

খাটের তলায় ট্রাঙ্কটা সরানো দেখে থমকে গিয়েছিল গৌরাঙ্গ। বিকেল পড়ে আসছে। সেই মুহূর্তে ঘরে কেউ নেই, কিন্তু যে কোনও সময় কেউ ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। মা বা অলকার সামনে এ সব মাল বের করতে চায় না গৌরাঙ্গ। বাচ্চাদের সামনে তো নয়ই! ও দিকে ঝন্টু রাস্তায় সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে তরকারির ঝুড়ি। প্রতি দিন সকাল সন্ধ্যায় বাজারে তরকারি নিয়ে বসে ঝন্টু। ওটা তার একটা জীবিকা। অন্য জীবিকা, প্রয়োজনে গৌরাঙ্গকে সাহায্য করা। যখন যেমন। ঝুড়ি ভর্তি তরকারির তলায় লুকিয়ে তারা অস্ত্রটা নিয়ে যাবে চিত্তরঞ্জনে। সেখান থেকে ট্রেনে বা ট্রেকারে ধানবাদ। ধানবাদেই আসবে পার্টি। টাউনের বাইরে একটা পরিত্যক্ত কোল ইয়ার্ডে দেখা হওয়ার কথা। এ সব কাজে ঝন্টু তার পার্টনার। আর তার জন্য ওকে বখরার ভাগও দেয় গৌরাঙ্গ।

ট্রাঙ্কটা কি অলকা সরিয়েছে? শাড়ি, বা ছেলেদের জামা বের করার জন্য? না, এখনও তো শীত পড়েনি! ওই ট্রাঙ্কটায় তো থাকে শুধু গরম জামা। মায়ের পক্ষে ওই ট্রাঙ্ক সরানো সম্ভব নয়। কোনও প্রয়োজন হলে তো তাকেই বলত মা। তা হলে একটাই সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। নির্ঘাত বুধুয়ার কাজ। বন্দুক বাড়িতে ঢুকলেই টের পায় ছেলেটা। বন্দুকের পিছনে ছোঁক ছোঁক করা স্বভাব! মা ঠিকই বলে, রক্তের দোষ!

‘অ গৌরাঙ্গ, তুই কি বাড়ি ফিরিছিস?’

মায়ের গলা পেয়েই অস্ত্রটা চট করে চাদরের তলায় চালান করে দিয়েছিল গৌরাঙ্গ।

‘না, আমায় এখুনি আবার বেরোতে হবে,’ বলেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। বাইরে তখন ঝন্টু অধৈর্য হয়ে সাইকেলে ঘন্টি দিচ্ছে। আরও দেরি করলে সময় মতো ধানবাদে পৌঁছতে পারবে না তারা।

বুধুয়ার উপর সন্দেহটা যে তার অমূলক নয়, সেই ধারণাটা বদ্ধমূল হল ক্লায়েন্টকে মাল দেখানোর সময়। ম্যাগাজিন ভরা ছিল, এখন দুটো গুলি কম! ঘটনাটা একটু অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল গৌরাঙ্গকে। সেই জন্যই কী যে দুজন এসেছিল, তাদের সঙ্গে ঠিকমত দর কষাকষিটা করতে পারল না গৌরাঙ্গ? মাল তাদের পছন্দ, কিন্তু মুম্বই থেকে আসা দুজন ক্রেতা যে দাম দিতে চাইছেন, তাতে রাজি হলে গৌরাঙ্গর হাতে প্রায় কিছুই থাকে না! জিনিসটা ওই দামে বিক্রি করতে রাজি হল না গৌরাঙ্গ।

কিন্তু ফেরার পথে শিউলিবাড়ির মালের ঠেকে দু’পাত্তর নামিয়ে বাড়ি ঢুকবে, এই মনে করে ঝন্টুকে নিয়ে সেখানে বসতে গিয়ে যা শুনল, যাওয়ার পথে সেটা শুনলে অস্ত্রটা আর বাড়িতে ফেরত আনত না গৌরাঙ্গ। যে দামেই হোক, বেচে দিত। জামতাড়া আর চিত্তরঞ্জনের মাঝে কলকাতাগামী পূর্বায় নাকি হঠাৎ এক জন মারা গিয়েছে। চিত্তরঞ্জনের জিআরপি অফিস থেকে খবর ছড়িয়েছে, লোকটা নাকি গুলি খেয়ে মরেছে। কিন্তু গুলি কে করল কেউ বলতে পারছে না, কারণ ট্রেনের কামরায় কারও সঙ্গে কোনও লাফড়া হয়নি লোকটার।

কোনও গোলাগুলিও চলেনি কামরায়। পুলিশ নাকি তেড়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। সামনেই স্বাধীনতা দিবস। তার আগে এ রকম বেওয়ারিশ গুলি চলার ঘটনায় চিত্তরঞ্জন জিআরপি’র বড়বাবু নাকি ঘটনাটায় চাপ খেয়ে গেছেন। ধরপাকড় শুরু হতে পারে। মালের ঠেকে সেটাই সে দিন গরম খবর। যে লোকটি মারা গেছে, তার সম্বন্ধেও নানান কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সে সব শোনার ধৈর্য ছিল না গৌরাঙ্গর। শিউলিবাড়ির ঝাড়ুয়া আর ইয়াসিন কথাটা আলোচনা করছিল। তাদের থেকে আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করল, ট্রেনের ঘটনাটা কবে ঘটেছে। মনে মনে হিসেব করে দেখল, সে মাল বাড়িতে আনার তিন দিন পরেই এক জনের লাশ পড়ে গেছে।

পুলিশের হাতে যদি কোনও ভাবে ধরা পড়ে যায়, তা হলে দু’দিক দিয়ে বিপদ। জেলের ভয় তো আছেই। এ জিনিস তো আর সাধারণ বন্দুক নয়! এই অস্ত্র নিয়ে ধরা পড়লে ঘুষ দিয়ে ছাড়া পাওয়া না-ও যেতে পারে। তার চেয়েও বড় বিপদ আসবে অন্য দিক থেকে। পুলিশের হাতে জিনিসটা খোয়া গেলে রাধেশ্যাম বাজোরিয়ার লোকজন তাকে ছেড়ে দেবে না! আর এ লাইনে ছেড়ে না দেওয়ার অর্থ হল, হয় মাল ফেরত দাও, না হলে চিরতরের মতো চুপ করিয়ে দেওয়া হবে।

বন্দুকটা কেউ সরিয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে দূরপাল্লার ট্রেনে কারও বেঘোরে মারা যাওয়ার যোগ কেন থাকবে? নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে গৌরাঙ্গ, কিন্তু কোনও দুশ্চিন্তা কাঁটার মতো বিঁধছে তাকে। সবচেয়ে খারাপ সন্দেহটাই আজকাল আগে মনে আসে! তবে কি বুধুয়ার হাতেই...? দু’পাত্তর পেটে পড়েছে। মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে গৌরাঙ্গর।

‘কী হল গুরু? আর নেবে না?’

ক্রমশ

Mystery Novel
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy