মিশরের পিরামিড বললেই আমাদের মাথায় আসে গিজ়া পিরামিড। সুচারু, সম্পূর্ণ, সমবাহু, সুবিশাল। এতটাই নিখুঁত ভাবে তৈরি যে, তার নির্মাণকার্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লোকে ভিনগ্রহের প্রাণীদের টেনে আনে।
অথচ গিজ়া থেকে কুড়ি কিলোমিটার দক্ষিণে সাক্কারা আর দাহশুর গেলেই পিরামিড নির্মাণের আদিপর্বটা বোঝা যায়, ভিনগ্ৰহীদের প্রয়োজন হয় না। তাই কায়রো ভ্রমণে এসে আমরা ঠিক করেই নিয়েছিলাম, গিজ়ার বিখ্যাত পিরামিডগুলো দেখার আগে প্রাচীনতর পিরামিডগুলো দেখব। সে যুগের এঞ্জিনিয়ারিং-এর ইতিহাস ধাপে ধাপে বুঝতে।
কায়রো থেকে ঘণ্টা দেড়েক ট্যাক্সিতে বসে নীলনদের পশ্চিম দিকের সেচখালের পাশ দিয়ে বানানো দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে, স্থানীয় গ্রামগঞ্জের জীবনযাত্রা দেখতে দেখতে এসে পড়লাম সাহারা মরুভূমির বুকে।
আমাদের স্থানীয় গাইড হাবিব ইতিহাস নিয়ে বেশ ওয়াকিবহাল, আর বেশ মুখে মুখে গল্প করে সেটা বোঝানোর দক্ষতাও রাখেন। বললেন, “প্রাচীন মিশরে জীবিত মানুষদের স্থান ছিল নীলনদের পুব দিকে, আর মৃত ব্যক্তিদের জন্য ছিল পশ্চিম তট, তাই দেবতাদের মন্দিরগুলি হত পূর্ব তীরে, আর মৃতদের সমাধিগৃহ, স্মৃতিমন্দির, পিরামিড— সবই পশ্চিম পাড়ে— সূর্যের প্রতিদিনের জীবনচক্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।”
শুধু কায়রো নয়, লুক্সর, আসোয়ান, সব শহরেই দেখা যায় এই প্রথামাফিক পূর্ব-পশ্চিমের ভেদ। জীবিত আর মৃতদের মাঝখান দিয়ে বয়ে যায় নীলনদ, যেটা আমরা পেরিয়ে এলাম মৃতদের শহর সাক্কারা দেখতে।
আমাদের গাইড সাক্কারায় ঢোকার মুখেই একটা মাস্তাবা দেখালেন। মাস্তাবা হল, ত্রিমাত্রিক ট্রাপিজ়িয়াম আকারের বেদি, যার চার দিকের ধারগুলো খাড়াই ভাবে না উঠে ঢাল হয়ে উঠেছে, আর উপরটা সমতল। উচ্চতা মোটামুটি একটা একতলা বাড়ির মতো, কিন্তু বিস্তার প্রায় কয়েক হাজার বর্গফুট, পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি। মিশরের প্রাচীনতম সমাধিসৌধগুলি প্রধানত এই আকারেই তৈরি হত। গাইড বললেন এটা মনে রাখতে, পরে কাজে লাগবে।
সাক্কারার মূল পিরামিডের প্রবেশপথ বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ দিয়ে সজ্জিত। পাথরগুলো সুন্দর ভাবে পালিশ করা হয়েছিল, পৌনে পাঁচ হাজার বছর পরও সেই জৌলুস টিকে আছে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে তাদের মসৃণতা অনুভব করা যায়।
প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকার পর দেখা দিল পিরামিড। মরুভূমির তপ্ত বালির মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজের বিশালতার জানান দিচ্ছে। চেহারায় জ্যামিতি বা ইতিহাস বইয়ের পাতার পিরামিডের চেয়ে অনেকটাই আলাদা— রাজা জোসারের তৈরি ‘স্টেপ পিরামিড’। সাধারণ পিরামিডের সঙ্গে মূল পার্থক্য হল, এটা সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে উঠেছে, সরলরৈখিক ভাবে নয়। একটা বিশাল মাস্তাবা বেদির উপর আর একটা মাস্তাবা বেদি, তার উপর আর একটা, এ রকম ছয় ধাপে উঠেছে, তাই নাম স্টেপ পিরামিড। বাস্তবেই স্বর্গে ওঠার সিঁড়ি! আমাদের গাইড হাবিব মনে করিয়ে দিলেন, মাস্তাবার প্রযুক্তিকে ক্রমিক ভাবে ব্যবহার করে স্টেপ পিরামিড তৈরি হয়েছিল।
রাজা জোসার উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তাই চেয়েছিলেন তাঁর পিরামিডের উচ্চতাও তেমনই হোক। জোসারের স্টেপ পিরামিড অন্তত দুশো ফুট উঁচু, প্রায় কুতুব মিনারের কাছাকাছি। আজ থেকে ৪৭০০ বছর আগে ওই উচ্চতার স্থাপত্য বানানো সহজ কাজ ছিল না, তাই রাজ-স্থপতি ইমহোটেপ বুদ্ধি করে সাধারণ পিরামিডের বদলে স্টেপ পিরামিডের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
সাক্কারায় আরও দুটো সৌধ দেখলাম, কিন্তু সেগুলোর কথা পরে বলছি। আপাতত পরবর্তী গন্তব্য হল দাহশুর। দুই মৃত্যুপুরীর মাঝে জীবিতদের গ্রামগঞ্জ দেখতে দেখতে গাড়িতে করে এগোলাম। দুই মরু-উপত্যকার মাঝপথে খাওয়া হল পুদিনাপাতা দেওয়া গরম চা, মরুভূমিতে শরীর ঠান্ডা রাখার পক্ষে আদর্শ পানী
দাহশুরে অবস্থিত রাজা স্নেফরুর তৈরি বেন্ট পিরামিড (ছবি: লেখক)।
জোসারের একশো বছর পর আর এক জন রাজা এলেন, তাঁর নাম স্নেফরু। তাঁর লক্ষ্য আরও বড় ছিল। তিনি সত্যিকারের পিরামিড-আকৃতির পিরামিড বানানোর উদ্যোগ নিলেন। প্রথমে একটা স্টেপ পিরামিডের গায়ে চুনাপাথরের আবরণ লাগিয়ে সত্যিকারের পিরামিডের আকার দিলেন। এই পিরামিডের ভিতরের স্টেপ পিরামিডটা এখনও টিকে আছে, কায়রোর কাছে মেইদুম বলে একটা জায়গায়। এই পিরামিড রাজার মনের মতো হয়নি, তাই তিনি তৈরি করালেন আর একটা পিরামিড, যেটাকে বলা হয় বেন্ট পিরামিড। সেটা দেখতেই এলাম দাহশুরে।
বেন্ট অর্থাৎ বাঁকা পিরামিড, কারণ একটা উচ্চতা অবধি পিরামিড নির্মাণ করার পর রাজ-স্থপতিরা এসে রাজাকে বললেন, পিরামিডের ঢাল কমাতে হবে, নইলে তা সুস্থির হবে না। অতএব একটা উচ্চতার উপর পিরামিডের ঢাল বেঁকে গেল, তাই এর নাম বেন্ট পিরামিড। এই বাঁকা পিরামিড দেখে রাজা খুশি হননি। তিনি চেয়েছিলেন জীবৎকালেই সত্যিকারের পিরামিড বানিয়ে যাবেন, এবং সেটা তৈরিও হল। এই শেষ পিরামিডের নাম রেড পিরামিড, যেখানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সেটাও দেখার সুযোগ হল দাহশুরে।
পিরামিড কিন্তু তাঁদের জীবদ্দশাতেই রাজারা তৈরি করে রাখতেন। প্রাচীন মিশরে খুব কম রাজবংশই একশো বছরের বেশি টিকেছিল, তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে রাজারা ভরসা পেতেন না।
রাজা স্নেফরুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর পরবর্তী যুগের রাজাদেরও সুযোগ করে দিল তাঁর প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নিজেদের সমাধিকে নূতন নূতন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। তৈরি হল গিজ়ার গ্ৰেট পিরামিড। কিন্তু পিরামিডের গগনচুম্বী উচ্চতায় গিয়ে তার গল্প শেষ হয়ে যায় না। তার গভীরে আরও কিছু কাহিনি থাকে। পিরামিডের উচ্চতা ছিল স্বর্গের দেবতাদের কাছাকাছি পৌঁছনোর মাধ্যম, কিন্তু স্বর্গে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে প্রয়োজন হত অন্য কিছু। তাছিল বিভিন্ন মন্ত্র, যা খুব গোপনে রাখা থাকত পিরামিডের গভীরে।
সাক্কারায় স্টেপ পিরামিড ছাড়া আরও দু’টি দর্শনীয় স্থান ভূগর্ভের মধ্যে। গাইড আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন দুটোর মধ্যে কী কী পার্থক্য, খেয়াল করতে। প্রথমটা রাজকুমারী ইদুতের সমাধি। সারা দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা অজস্র দেওয়ালচিত্র, সে যুগের রং কোথাও কোথাও এখনও টিকে আছে। ছবির বিষয়বস্তু নানা রকম, শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম, ষাঁড় বলিদানের দৃশ্য, আর অনেক নৌকোর ছবি।
নৌকো যেমন নীলনদের প্রতিদিনের জীবন-জীবিকার প্রতীক, তেমনই প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে তা ছিল ইহলোকের সঙ্গে পরলোকের যোগাযোগের মাধ্যমও। পরে মিশরের প্রত্যেকটা মন্দির ও সমাধিতে এই নৌকোর বহুল উপস্থিতি চোখে পড়েছে।
অন্য সমাধিগৃহটি আরও পুরনো। সেটা দেখাতে রাজা উনাসের ভাঙা পিরামিডের ভিতরে গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন। একটু কষ্ট করে সুড়ঙ্গ বেয়ে ঢুকতে হয়। এতে দেওয়ালচিত্র নেই। মিশরের পরবর্তী কালের বিখ্যাত সমাধিগৃহগুলোয় দেবদেবীদের ছবি, স্বর্গযাত্রার ছবি, মর্ত্যের জীবনযাত্রার ছবি ইত্যাদি অনেক কিছু থাকত, এটিতে সে-সব নেই। সারা দেওয়াল জুড়ে শুধু লেখা, হায়রোগ্লিফিক লিপিতে। এই লেখাগুলোকে বলা হয় পিরামিড-লিপি, এদের বিষয় ছিল মন্ত্র। রাজা যাতে সুষ্ঠু ভাবে সমস্ত বাধা পেরিয়ে স্বর্গে পৌঁছন, সেখানে পুনর্জীবন লাভ করেন, দিব্য শরীর ধারণ করেন, স্বর্গের দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন এবং সেখানে যেন শান্তিতে থাকতে পারেন— তার জন্য মন্ত্রমালা।
গাইড আমাদের আরও বিশদে বোঝালেন, কেন এগুলো লিপিবদ্ধ করা হল। যখন পিরামিড-লিপির চল হয়নি, তখন পুরোহিতরা রাজার সমাধিতে এসে নিয়মিত ভাবে মন্ত্রপাঠ করে যেতেন। উনাসের সময় থেকে সেই মন্ত্রগুলিকে দেওয়ালে গ্রন্থিত করা শুরু হল, যাতে পুরোহিতদের অনুপস্থিতিতেও রাজার আত্মা নিজেই মন্ত্রগুলো পড়ে নিতে পারেন।
এই মন্ত্রগুলো পরের দিন দেখলাম কায়রোর গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজ়িয়মেও, তবে একটু অন্য রকম চেহারায়। এগুলো লেখা ছিল কফিনের অভ্যন্তরীণ দেয়ালে, আর পিরামিড-লিপি ছিল সারা ঘর জুড়ে। পিরামিড-লিপি ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত হয় ছোট আকারের কফিন-লিপি দিয়ে। বিষয় প্রায় একই। আরও পরে এল প্যাপিরাসের পুঁথিতে লেখা মন্ত্র, যেটা কফিনের মধ্যে রাখা হত। এই পুঁথিকে বলা হয় ‘বুক অব দ্য ডেড’।
দেবতা আনুবিসের কাজ ছিল শেষ বিচার করা। হৃৎপিণ্ড পাপের বোঝায় ভারী কি না, তিনি মেপে বিচার করতেন। তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগে প্রয়াত ব্যক্তির আত্মাকে বহুবিধ প্রশ্নের উত্তর দিতে হত। তার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও মন্ত্রসমূহ লেখা থাকত ওই পুঁথির মধ্যে।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, মিশর মানে শুধুই পরলোকের উদ্যাপন নয়। পিরামিড, সমাধিগৃহ, আর কফিনের আড়ম্বর দেখে মাঝে মাঝে মনে হতে পারে যে, প্রাচীন মিশরীয়দের সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ছিল পরপারের জগৎকে ঘিরে, কিন্তু রাজকুমারী ইদুতের মতো অনেক সমাধিগৃহ আছে, যেখানে ইহলোকের, ইহজীবনের উদ্যাপন দেখা যায়। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা দেখা যায়। সমাজের শ্রমজীবী মানুষদের ছবি তুলে ধরতে শিল্পীরা যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। এই কাজের জন্য এঞ্জিনিয়ারদের ব্যাপক প্রতিপত্তি ও সম্মান ছিল।
মিশরের প্রথম পিরামিড অর্থাৎ জোসারের স্টেপ পিরামিড যিনি নির্মাণ করেন— রাজ-স্থপতি ও সভাপণ্ডিত ইমহোটেপ— তাঁকে দেবতার স্তরে উন্নীত করা হয়। ইমহোটেপ একাধারে চিকিৎসাবিদ, স্থপতি ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। আসওয়ান ঘুরতে এসে দেখলাম কোন-ওম্বু মন্দিরের একটি অর্ঘ্যবেদি, যেখানে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ইমহোটেপের উদ্দেশ্যে অর্পিত, আর ফিলে আইল্যান্ডে তাঁর মন্দিরও দেখলাম। এগুলি তাঁর মৃত্যুর দু’হাজার বছর পর নির্মিত। তাই জোসারের স্টেপ পিরামিড দেখার সময় মনে রাখতে হয়, এটি শুধুই পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগের সিঁড়ি নয়, সভ্যতার আদিতম প্রযুক্তির উদ্যাপনও বটে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)