Advertisement
E-Paper

ম্যাও

যে প্রাণীটি লোকে সবচেয়ে বেশি পোষে, তা বেড়াল। বেড়াল দেবতা বলে পুজো পেয়েছে, শয়তান বলে অভিশাপ। জল এড়িয়ে চলে, অথচ প্রিয় খাবার মাছ!যে প্রাণীটি লোকে সবচেয়ে বেশি পোষে, তা বেড়াল। বেড়াল দেবতা বলে পুজো পেয়েছে, শয়তান বলে অভিশাপ। জল এড়িয়ে চলে, অথচ প্রিয় খাবার মাছ!

তসলিমা নাসরিন

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৪ ০১:০৭

যত পোষা বেড়াল আছে পৃথিবীতে, সবারই পূর্বনারী বা পূর্বপুরুষ ‘নিয়ারইস্টার্ন ওয়াইল্ডক্যাট’ বা নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়াল। ‘পোষা’ মানে শুধু পুষ্যি নয় যত বেড়াল রাস্তা ঘাটে মাঠে ময়দানে বাসা বাড়িতে থাকে বা ঘুরে বেড়ায়। নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়াল ছাড়া অন্য চার রকম যে বনবেড়াল আছে— ইয়োরোপীয় বনবেড়াল, দক্ষিণ আফ্রিকার বনবেড়াল, মধ্য এশীয় বনবেড়াল, চিন-মরুভূমির বনবেড়াল ওদের ডিএনএ-র সঙ্গে এই পোষা বেড়ালদের ডিএনএ মেলে না। নিকটপ্রাচ্যের দেশগুলো এক এক জনের সংজ্ঞায় এক এক রকম। তবে যে দেশগুলোকে নিকটপ্রাচ্যের মধ্যে মোটামুটি ফেলা যায়: বাহরিন, সাইপ্রাস, মিশর, ইরান, ইরাক, ইজরায়েল, জর্ডন, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সুদান, সিরিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেন।

আমরা এত কাল জানতাম, চার হাজার বছর আগে জঙ্গল থেকে বনবেড়াল প্রথম ঢুকেছিল মিশরের লোকালয়ে। ভুল। বেড়াল জঙ্গল থেকে লোকালয়ে এসেছে আরও আগে। নানা রকম প্রমাণ জড়ো করে এখন অবধি যা তথ্য পাওয়া গেছে, তা হল, নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়ালদের মধ্যে কেউ কেউ, সম্ভবত হায়েনা আর বাঘ ভালুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য, মানুষের এলাকায় ঢুকে পড়েছিল, দশ বা বারো হাজার বছর আগে, কোনও নিকটপ্রাচ্যদেশে। আজ তারই বংশধর আমাদের রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ানো গৃহস্থবাড়ির বেড়াল। ১৯৮৩ সালে সাইপ্রাসে প্রথম পাওয়া গেছে আট হাজার বছর পুরনো বেড়ালের চোয়ালের হাড়। তার পর বছর দশ আগে যেটা পাওয়া গেছে, সেটা চোয়ালের হাড়-টাড় নয়, রীতিমত কঙ্কাল। আস্ত একটা মানুষের সঙ্গে আট মাস বয়সি আস্ত একটা বেড়ালকে কবর দেওয়া হয়েছিল। কবরটা সাড়ে ন’হাজার বছর পুরনো। কবরটা দেখেই বোঝা গেছে, ওই এলাকায় বেড়ালরা মানুষের সঙ্গে বসবাস শুরু করেছে বেশ অনেক আগেই, সম্ভবত পনেরো হাজার বছর আগে, দীর্ঘ কালের সম্পর্ক না হলে অত আদর করে কেউ বেড়ালকে নিয়ে কবরে শুত না। সাইপ্রাসে তুরস্কের চাষিরা বাসা বেঁধেছিল। তারাই সম্ভবত তুরস্ক থেকে পোষা বেড়াল নিয়ে আসে। তুরস্ক থেকেই, তা না হলে আর কোথাও থেকে বেড়াল জোটার কোনও সম্ভাবনা ছিল না সাইপ্রাসে। সাইপ্রাসের আশেপাশের কোনও জঙ্গলে বনবেড়াল ছিল না।

সারা পৃথিবীতে এখন বেড়ালের সংখ্যা ষাট কোটি। বিবর্তনের মজা এখানেই। ঘর-গেরস্তের বেড়ালগুলোই টিকে আছে। বনের বেড়ালগুলো বরং নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। আসলে, চোখ-কান খোলা রাখতে হয়, ভাল ভাবে বাঁচা যাবে এমন কিছুর গন্ধ পেলে পুরনো জায়গা ছেড়ে নতুন জায়গায় তড়িঘড়ি চলে যেতে হয়। মানুষ তার জীবনের শুরু থেকেই জায়গা বদলাচ্ছে। ক্রমশ ভাল-র দিকে যাচ্ছে। জায়গা বদলেছে বলে হোমো সেপিয়েন্স নামের মানুষ প্রজাতি টিকে আছে, নিয়ানডার্থাল নামের মানুষ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

মানুষ যখন মূলত শিকারি ছিল, তখন কুকুরকে সঙ্গে রাখত। যখন থিতু হল, কৃষিকাজ শুরু করল, তখন কুকুরের বদলে বেড়াল হল বিশ্বস্ত সঙ্গী। বেড়াল শস্য খেতে আসা ইঁদুর মারত, ওই খেয়েই দিব্যি মনের সুখে খামারে বাস করত। মানুষও খুশি ছিল, বেড়ালকে দিয়ে ইঁদুর মারার কাজ চলত, আর সেই জন্য শস্যের অভাব হত না। প্রাচীন মিশরীয়রা বেড়ালের পুজো করত। বাস্টেট দেবীর মাথাটা ছিল বেড়ালের। বেড়াল পুজো করার মন্দিরও ছিল মিশরে। মিশরীয় আইনে মানুষের চেয়েও বেশি মর্যাদা পেত বেড়াল। কোনও বাড়িতে আগুন ধরলে, আগে মানুষকে নয়, বেড়ালকে বাঁচানোর নিয়ম ছিল। শুধু মিশরের রাজা-বাদশার মমি বানানো হত তা নয়, বেড়ালেরও মমি বানানো হত, বেড়ালের এক কবরখানায় তিন লক্ষ বেড়ালের মমি পাওয়া গেছে। কেউ কোনও বেড়ালকে প্রাণে মেরে ফেললে জেল-হাজত-জরিমানা নয়, যাবজ্জীবনও নয়, রীতিমত মৃত্যুদণ্ড হত। প্রাচীন রোমও অনেকটা এ রকমই ছিল। বেড়ালকে স্বাধীনতার প্রতীক বলে ভাবা হত। দূরপ্রাচ্যে বেড়ালের মর্যাদা আবার অন্য কারণে বেশি ছিল। বেড়ালরা নথিপত্র, পাণ্ডুলিপি, এ সব ইঁদুরের দাঁত থেকে রক্ষা করত বলে।

চার দিকে বেড়ালকে যখন মানুষ ঈশ্বরের বা প্রায়-ঈশ্বরের সম্মান দিচ্ছে, তখন মধ্যযুগে, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, বেড়ালকে অশুভ প্রতীক, ডাইনির সঙ্গী, শয়তানের দূত বলে ভাবতে শুরু করল ইয়োরোপীয়রা। প্লেগের জন্য দায়ী বেড়াল, এমনও অভিযোগ করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে বেড়াল নিয়ে এখনও কুসংস্কার চূড়ান্ত। কালো বেড়াল পথে পড়লে গাড়ি থামিয়ে দেয় লোকে। এক জন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কালো বেড়াল রাস্তা পার হচ্ছে, মানে কী?’ ‘এর মানে’, বলেছিলাম, ‘কালো বেড়ালটা কোথাও যাচ্ছে।’ কুসংস্কার যারা বোঝে, তারা কৌতুক বোঝে না।

যে প্রাণীটি লোকে সবচেয়ে বেশি পোষে, তা গরু নয়, ঘোড়া নয়, কুকুর নয়, পাখি নয়, তা বেড়াল। ইয়োরোপ আমেরিকার প্রায়

ঘরে ঘরে বেড়াল। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই পোষা বেড়ালের সংখ্যা ন’কোটি। যে প্রাণীটি কোনও দুধ দেয় না, বোঝা বইতে পারে না, যার চামড়া দিয়ে কোনও কিছু বানাবার উপায় নেই, যে মানুষের কোনও উপকারে আসে না, সেই প্রাণীকেই সবচেয়ে বেশি পুষছে মানুষ, ব্যাপারটি খুবই অদ্ভুত। এক বন্ধু বলেছিল, ‘বেড়াল জল এড়িয়ে চলে, আর তাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার কিনা মাছ!’ বিবর্তন দুনিয়ার কত কিছু যে পালটে দেয়!

আমার বেড়ালটার কথাই বলি, নাম মিনু। নিজের মাছটাও নিজে খেতে জানে না। কাঁটা বেছে দিলে তবে খাবে। দেখে এক বার আমার বন্ধু বলেছিল, ‘কী ব্যাপার, তুমি তো বেড়ালটাকে কাঁটা বেছে মাছ খেতে দিচ্ছ। আমি তো এত কাল জানতাম বেড়ালরা কাঁটা খায়। কাঁটা বেছে বেড়ালকে মাছ খেতে দেওয়ার মানে বেড়ালের বেড়ালত্ব কিছু আর অবশিষ্ট নেই, মনুষ্যত্ব ডেভেলপ করেছে।’

তা ঠিক, মিনুকে দেখলে যে-কেউ বলবে, মিনুর ভেতরে বেড়ালত্ব কিছু আর নেই, যা আছে তা মনুষ্যত্ব। আজ ন’বছর মিনু আমার সঙ্গে। গড়িয়াহাটের মাছের বাজারে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা ছানাটাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, আজ তার জীবন অনেকটা রানির মতো বা দেবীর মতো। কত রকম সরকারি নির্যাতন গেল আমার উপর, সবাই চলে গেল, সব বন্ধু, সব অনুরাগী, শুধু মিনু রয়ে গেল। ও আর যাবে কোথায়! রাস্তার জীবনে ও আর অভ্যস্ত নয়, শিকার করেও খেতে পারবে না, চুরি করেও না। ও-সব ও অনেক কাল ভুলে গেছে, অথবা শেখেইনি কোনও দিন। রাস্তায় বেরোলে গাড়ি-ঘোড়া-কুকুর মানুষের হাতে নির্ঘাত মরবে। তার চেয়ে নিরাপদ ঘরে ঘুমোবে খেলবে, সুস্বাদু খাবার দেওয়া হবে, বিদেশি কোম্পানির ট্রিটস, রয়্যাল ক্যানিন ফুড; কখনও নাক সিঁটকাবে, অভিমান করবে, রাগ করবে, খেতে পীড়াপীড়ি করলে ‘খাব না’ বলে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকবে, হাতে-পায়ে ধরেও মুখ খোলানো যাবে না, কখনও মর্জি হলে তবেই মুখে খাবার তুলবে।

বাড়িভর্তি তার খেলনা, পুরো বিকেল জুড়ে তার সঙ্গে খেলতে হবে। আবদারের অন্ত নেই। গরমে তার এসি চাই, শীতে তার পশমি কম্বল চাই, উলের জ্যাকেট চাই, হিটার চাই। কেউ বিশ্বাস করুক না-করুক, তার আলাদা শোওয়ার ঘর, আলাদা বিছানা, আলাদা টয়লেট। টয়লেট কখনও অপরিষ্কার পেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। আগে তার টয়লেট পরিষ্কার চাই, পরে অন্য কথা। শুধু যে নিজের কথাই ভাবে, তা নয়। সে দিন জ্বর হয়েছিল আমার, যত ক্ষণ জ্বর না সারল, শিয়র থেকে নড়ল না। এই হল আমার পালিতা কন্যা মিনু।

মিনু আর এখন বেড়ালের মতো কাঁদে না, কাঁদে মানুষের মতো। হাসেও হয়তো মানুষের মতোই। এই মিনুরই পূর্বনারীরা জঙ্গল থেকে মানুষের এলাকায় ঢুকে পড়েছিল এক কালে, ইঁদুর শিকার করার কাজ পেয়ে বর্তে গিয়েছিল। আজ সেই বনবেড়ালের বংশধর ঘরের জীবন যাপনে এমনই অভ্যস্ত হয়েছে যে ইঁদুর দেখলে ভয় পায়। খেলনা ইঁদুরের ঘাড়ে বেশ ছুটে এসে কামড় দেয়, কিন্তু জ্যান্ত ইঁদুর দেখে দৌড়ে পালায়। পোষা বেড়ালগুলোর স্বভাবচরিত্র এত পালটে যাচ্ছে যে বেড়ালের বদলে অন্য কোনও নামে হয়তো এদের ডাকতে হবে। কী নামে?

taslima nasreen rabibasariya cat
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy