Advertisement
E-Paper

সাদা পতাকা

সকালটা বেশ ঝলমলেই শুরু হয়েছিল। মায়ের ডাকটাই সব গোলমাল করে দিল। বুবাই, বুবাই...। ডাকটা নীচ তলা থেকে ভেসে আসছিল। সম্ভবত, মা বাড়ির পিছনের উঠোন থেকে ডাকাডাকি করছে। বুবাই সাড়া দিচ্ছিল না। ও এখন সাড়া দেবে না। মায়ের ডাক দু’তিন রকমের। এই ডাকটা মারাত্মক। আওয়াজ শুনেই আন্দাজ করতে পারছে, খুব রেগে গেলে মা এই ভাবে ডাকে। অঙ্কের খাতাটা টেনে তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজের অঙ্কগুলো কষতে শুরু করে দিল।

সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সকালটা বেশ ঝলমলেই শুরু হয়েছিল। মায়ের ডাকটাই সব গোলমাল করে দিল। বুবাই, বুবাই...। ডাকটা নীচ তলা থেকে ভেসে আসছিল। সম্ভবত, মা বাড়ির পিছনের উঠোন থেকে ডাকাডাকি করছে।

বুবাই সাড়া দিচ্ছিল না। ও এখন সাড়া দেবে না। মায়ের ডাক দু’তিন রকমের। এই ডাকটা মারাত্মক। আওয়াজ শুনেই আন্দাজ করতে পারছে, খুব রেগে গেলে মা এই ভাবে ডাকে। অঙ্কের খাতাটা টেনে তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজের অঙ্কগুলো কষতে শুরু করে দিল। কেননা, ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে একটু পরেই চটি ফটফটিয়ে মা ওপরে আসবে। রেগে গেলে মা ছেড়ে দেয় না। সাড়া না পেলে ওপরে আসবেই। ডাকটা এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জোর করে মন ওই দিক থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল ও।

কিন্তু মন সরছে না। মাথার মধ্যে সকালের ঘটনাটাই ঘোরাফেরা করছে। আজ সকালেই একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে বুবাই। কাণ্ডগুলো ঘটানোর সময় ওর একটুও খেয়াল থাকে না। যা ইচ্ছে হয় তাই করে। পরে যখন সেই ব্যাপারগুলো নিয়ে হইচই হতে থাকে, তখন মনে হয়, না করলেই হত।

আজকেরটা ঠিক সে রকম। না হলে ভাল হত। কিন্তু হয়েছে। পাশের বাড়ির বেড়ালটা এ বাড়ির উঠোনে চুপচাপ শুয়ে ছিল। বেড়ালটা খুবই সুন্দরী। গায়ের রং ধবধবে সাদা। শুধু মাথায় আর ঘাড়ে দুটো কুচকুচে কালো ছোপ আছে। বেড়ালটাকে দেখে ওর একটা অদ্ভুত খেয়াল হল। ওটাকে রং করলে কেমন হয়? পেয়ারা গাছের নীচে ব্রাশ ডোবানো আলকাতরার টিনটা আগেই দেখেছিল। কাঠমিস্ত্রির ভুলে পড়ে আছে। চট করে ব্রাশটা তুলে বেড়ালটার পিঠে দুটো টান দিয়ে দিয়েছিল। পালিয়ে যাওয়া বেড়ালটাকে দেখে ও ভেবেছিল ঘটনাটা ওখানেই শেষ হল। তা ছাড়া কোনও সাক্ষী নেই দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েই ওপরে চলে এসেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছে। পাশের বাড়ির রু-এর আদরের বেড়াল। নিশ্চয়ই রু লাগিয়েছে মাকে। মা তাই ডাকছে। ভাবনাটা শেষ হওয়ার আগেই মা এসে দাঁড়াল টেবিলের পাশে।

এতক্ষণ ধরে ডাকছি সাড়া দিচ্ছিস না কেন?

শুনতে পাইনি।

শুনতে পাসনি? ফের বাজে কথা! আজ সকালে কী করেছিস? চোখ বড় বড় করে মা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে বড় অপরাধী লাগে বুবাইয়ের। তবু ঠান্ডা গলায় বলে, কিছু করিনি তো।

কিছুই করিসনি? মিথ্যে কথা! তা হলে রু-এর বেড়ালের পিঠে কে আলকাতরা লাগিয়েছে?

আমি কী করে জানব?

আমাদের বাড়িতে তুই ছাড়া আর কে ওই রকম বাঁদরামি করবে? রু তো বলল, ‘কাকিমা আপনাদের বাগানেই আলকাতরার টিন আছে। এটা নিশ্চয়ই বুবাইয়ের কীর্তি। মুশকিলের কথা কী জানেন, বেড়ালটা সব জায়গায় গা ঘষছে। আমাদের বিছানার চাদরে, ঘরের মেঝেতে আলকাতরা লেগে গিয়েছে।’ আচ্ছা, তোকে নিয়ে কী করি বলত? সব সময় এ ও সে তোর নামে নালিশ করছে। আমি কি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব?

মার কথার কোনও উত্তর দিচ্ছিল না বুবাই। মাকে ও জানে। কথার উত্তর দিলে আরও রেগে যাবে। মাথা নিচু করে ভাবছিল ও, কেন যে এ রকম হয়। কোনও প্রমাণ ছাড়া ওকে দোষী বুঝে যায় সবাই।

মা রেগেমেগে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখে গেল ওকে। এই সব স্কুলের শাস্তিগুলো মা যে কী করে শিখল! মা তো স্কুলের দিদিমণি নয়, তবে? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এত পা ব্যথা করছিল যে, মাঝে মাঝে চার পাশ দেখে পা নামিয়ে নিচ্ছিল ও। মন দিয়ে এ পাশ ও পাশ দেখতে দেখতেই নজরে এল বারান্দার কোণ দিয়ে একটা আরশোলা যাচ্ছে। আরশোলাটাকে খপ করে ধরে দুটো ঠ্যাং ছিঁড়ে নিল বুবাই। এ বার আরশোলাটা বেঁকে বেঁকে চলছে। বুবাইয়ের বেশ মজা লাগল। মা ওকে শাস্তি দিয়েছে। আর ও বেশ আরশোলাকে শাস্তি দিল!

বিকেলে ফুটবল ম্যাচ ছিল মুক্তি সঙ্ঘের সঙ্গে। খেয়ালি সঙ্ঘের একমাত্র গোলকিপার বুবাই। চিন্তায় ছিল খুব, মা যদি খেলতে না দেয়। মায়ের রাগ কমেছে। বিকেলে ক্লাবের জার্সি গায়ে গোলের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল ও।

মুক্তি সঙ্ঘ এক গোলে পিছিয়ে আছে। খেলা শেষ হতে মিনিট পাঁচেক বাকি। গোলের দিকে এগিয়ে আসা বলটা ধরতে সঠিক ঝাঁপ দিয়েছিল বুবাই। ধরতে পারল না। পর পর দু’বার ঠিক একই ভাবে গ্রিপ মিস করল আর এক গোলে জিতে গেল মুক্তি সঙ্ঘ।

খেলার শেষে খেয়ালি সঙ্ঘের সেক্রেটারি দুলুদা বললেন, ছিঃ ছিঃ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’গোল খেলি! রীতিমত রেগে গটগটিয়ে চলে গেলেন দুলুদা। এর পর জুনিয়র গ্রুপে ও চান্স পাবে কি না সন্দেহ।

শুয়ে শুয়ে ঘটনাগুলো পর পর সাজাচ্ছিল বুবাই। না এর পিছনে কিছু একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। কাল রাতেও তো বিশ্রী কাণ্ড হল একটা। বিয়েবাড়ি যাবে বলে জামাপ্যান্ট বদলাচ্ছিল ও। জামা খুলতেই মা বলল, এগুলো কী হয়েছে? সারা গায়ে ফুলো ফুলো চাকা চাকা! এ তো আমবাত বেরিয়েছে দেখছি। না, নেমন্তন্ন যেতে হবে না। আজ রাতটা দুধ পাঁউরুটি খা, কালই ডাক্তার দেখাতে হবে।

তার পর আজ যা হল, সেও তো অদ্ভুত কাণ্ড! মার ভেজানো ছোলা টিয়াপাখিকে দেয় ও। পাখিটা রামভীতু। ছোলা দিতে হাত ঢোকালেই সরে যায় এক পাশে। শেষ মুঠোতে কিছু ছোলা নিজের মুখে ফেলে দেয় বুবাই।

এ দিনই ব্যতিক্রম! ছোলা দিতে হাত ঢোকানো মাত্র তেড়ে এসে টিয়াপাখিটা কামড়ে ধরল আঙুলটা। চেঁচাতে চেঁচাতে হাত টেনে নিয়েছিল ও। রক্তারক্তি কাণ্ড। মা হাতে ডেটল লাগাতে লাগাতে বলল, নিরীহ পাখিটা হঠাত্‌ খেপে গেল কেন? নিশ্চয়ই কিছু করেছিস।

তখনই কথাটা মাথায় আসেনি। পরে এল। দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে যে গলিটা দিয়ে শর্টকাট করে, সেখানেও একটা ঘটনা ঘটেছে। দাঁড়িয়ে থাকা একটা গরুর পিঠে ব্যাগের পিছনটা দিয়ে এক ঘা মারতে যেতেই গরুটা তাড়া করেছিল ওকে। খুব জোরে দৌড়তে গিয়ে রাস্তায় পা পিছলে পড়ে যায় ও। গরুটাও শান্ত ভাবে ফিরে গেল তক্ষুনি। অথচ অন্য দিন বুবাই দেখেছে মাথাটা এক বার নেড়েই গরুটা চুপ করে যায়।

এ ঘটনাটা একদম স্বস্তি দেয়নি ওকে। সব কিছু কেমন উল্টোপাল্টা ঘটছে। তাই শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিল কী কী ক্ষতি হল। ক্ষতির সংখ্যা তো কম নয়। সামনের ম্যাচে টিম থেকে বাদ। আগামী কয়েক মাসে নেমন্তন্নের কোনও আশা নেই। আঙুল কেটেছে বেশ ভাল রকম। পা মচকে রীতিমত খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে।

নাঃ, অস্থির লাগছে! আর শুয়ে থাকা যাচ্ছে না। ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল লাল মেঝের ওপর দিয়ে বাদামি রঙের শুঁয়োপোকাটা হেলেদুলে চলছে। মুখে একটা ছোট্ট সবুজ পাতা। পাতাটার সঙ্গে শুঁয়োটাকে দারুণ মানিয়েছে। দু’জনেরই ওপর রোদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। পোকাটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ও একটা বিরাট কাজে ব্যস্ত। দাঁড়াবার সময় নেই এক ফোঁটা। এক বার ভাবল বুবাই এক লাথি মেরে পাতাশুদ্ধু পোকাটাকে উধাও করে দেয়। পা তুলতে গিয়েও নামিয়ে নিল। থাক না বাবা, যে যার কাজ করছে। জ্বালাতন করে লাভ কী!

ঠিক সে দিনই সন্ধেয় অদ্ভুত কাণ্ডটা ঘটল। টেবিলে বসে পড়ছিল ও আর মাঝে মাঝে মেঝেতে পা ঠুকছিল। ব্যথাটা যায়নি বলে চুনহলুদ গরম করে মা পায়ের গোড়ালিতে লাগিয়ে দিয়েছে। শুকিয়ে গিয়েছে বলে পা ঠুকলেই ওটা ঝরে ঝরে পড়ছে।

পা ঠুকে কতটা গুঁড়ো পড়ল দেখতে গিয়ে নজরে এল, সেই শুঁয়োপোকাটা এ বার একটা সাদা তুলোর টুকরো মুখে করে এগিয়ে আসছে ওরই টেবিলের দিকে। বেশ তড়বড়িয়ে এসে টেবিলের পায়ার কাছে থামল ওটা। মাথাটা এক বার তুলে যেন জরিপ করল ওকে। কেমন যেন মনে হল মিষ্টি করে হাসল একটু! তার পর মাথা নামিয়ে তুলোটা ওর পায়ের কাছে রেখে ফের ফিরে গেল আবার।

দেখতে দেখতে বুবাইয়ের মনে হচ্ছিল তুলোটা যেন সাদা পতাকা। ওরা কি তবে ওর সঙ্গে সন্ধি করল এ বার?

পরের দিন সকালে মন দিয়ে অঙ্ক করছিল বুবাই। মা এসে বসল পাশে। বলল, একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়েছে জানিস। টিয়াপাখির খাঁচাটা খোলা। পাখিটা উড়ে গিয়েছে।

বুবাই মায়ের দিকে তাকায় এ বার। ওকে আমিই উড়িয়ে দিয়েছি মা।

সে কী, তুই তো বায়না করে পুষেছিলি। না হলে পাখিকে খাঁচায় দেখতে যে ভাল লাগে না, সে কথা

অনেক বার তো বলেছিলাম তোকে। বারণও করেছিলাম। তুই শুনিসনি।

বুবাই হাসে। তখন আমি তোমার কথাটা বুঝতে পারিনি মা। কিন্তু আজ বুঝেছি।

মা চলে যাওয়ার পর টেবিলের ওপর থেকে তুলোটা আস্তে আস্তে তুলে নিল বুবাই। ড্রয়ারের এক কোণে যত্ন করে রেখে দিল ওটা! ও যে সাদা পতাকার সব শর্ত মেনে নিয়েছে, সেটা তো মা জানে না।

anandamela rabiamela sarbani bandopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy