E-Paper

প্রথম আদি তব ‘তুষ্টি’

ঋতুভিত্তিক খাওয়াদাওয়া, রোগনিরাময়ের রন্ধনপ্রণালী... এ সবই চলে আসছে বৈদিক যুগ থেকে। সুপাচক হিসেবে প্রসিদ্ধ রাজা নলের ‘পাকদর্পণম’-এ উল্লেখ পাওয়া যায় তার

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৩১
Meat Khichdi

তহর্যন্নম (মাংসের খিচুড়ি) ছবি: সর্বজিৎ সেন।

ভূভারতের অনেক খাদ্যপ্রণালীই চলে আসছে সেই মহাভারতের যুগ থেকে। রন্ধনশাস্ত্রে সে যুগে শুধু নারীদের নামই অগ্রভাগে স্থান পেত না, বহু পুরুষও রন্ধনবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন ভীম, তেমনই রাজা নলও। জনশ্রুতি, রাজা বীরসেনের পুত্র নিষধরাজ (বা নিষাদ) নল এমনই সুপাচক ছিলেন যে, আগুন ছাড়াই তিনি রান্না করতে পারতেন। আসলে ভূতের রাজার দেওয়া বরের মতো, দেবতাদের বরে হাত খুলেছিল রাজা নলের।

কাহিনির সূত্রধর

কথিত আছে, বিদর্ভরাজ্যে আয়োজিত দময়ন্তীর স্বয়ম্বর সভায় যাওয়ার সময়ে পথেই নলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ ও যমের। নলের রূপ দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, পাণিপ্রার্থীরূপে সে অপরাজেয়। দময়ন্তী তাঁকেই গ্রহণ করবেন। তখন তাঁরা নলকে নির্দেশ দেন তাঁদের হয়ে দৌত্য করতে। নল তা করলেও স্বয়ম্বর সভায় দময়ন্তীর প্রার্থনায় দেবতারা সরে দাঁড়ান। নলকেই স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন দময়ন্তী। আর চার দেবতা তুষ্ট হয়ে নলকে বর দেন, যজ্ঞকালে ইন্দ্রকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন নল, অগ্নি বর দিলেন নলের ইচ্ছামাত্রই তিনি আবির্ভূত হবেন, বরুণ বর দিলেন নলের কখনও জলাভাব হবে না আর যম বর দিলেন নলের রান্না যে কোনও খাবারই সুস্বাদু হবে। নলের সুপাচক হওয়ার পিছনের কারণ অনেকটাই স্পষ্ট এই গল্পে।

কিন্তু নলের ‘পাকদর্পণম’-এ চোখ রাখলে বোঝা যায়, তাঁর রান্না পদ সুস্বাদু করার আয়োজনই শুধু সেখানে নেই, সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার নিদানও দেওয়া রয়েছে। অম্ল, পিত্ত, বাত— শরীরের এই ত্রিধাতুকে মাথায় রেখেই রান্নার প্রণালী তৈরি করেছেন রাজা নল। প্রত্যেক খাবারের সঙ্গে তাই তার গুণাগুণও বর্ণিত। এই বইয়ে ঋষি বাৎস্যায়নের রন্ধনকলার ভাগও রয়েছে। তিনি দু’ভাগে ভাগ করেছেন রন্ধনকলাকে, প্রথমভাগ ব্যঞ্জন, শাক, ঝোল, মিষ্টান্ন, অন্নপিষ্টক ইত্যাদি, আর দ্বিতীয় ভাগ শরবত, সির্কা, চাটনি ইত্যাদি পানীয় প্রস্তুত বিষয়ে। রন্ধনকলার এই ভাগকে লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, প্রথম ভাগ হল পাক-সাপেক্ষ আর দ্বিতীয় ভাগ পাক-নিরপেক্ষ। এ ছাড়াও ওদন ভেদ অর্থাৎ অন্নের রকমফের, সূপভেদ অর্থাৎ ঝোলের নানা রকম, সর্পিভেদ অর্থাৎ ঘিয়ের প্রকারভেদের উল্লেখও পাওয়া যায়। তবে এই বইয়ে বর্ণিত প্রায় সব রান্নাই ঋতুভিত্তিক। অর্থাৎ যে ঋতুতে আঞ্চলিক ভাবে যা পাওয়া যায়, তা দিয়েই মূলত রান্না করা হত।

Dumur (Ficus of Fig) Dalna

ঔদুম্বর-ব্যঞ্জনম্‌ (ডুমুরের ডালনা)। ছবি: সর্বজিৎ সেন।

ঋতুভিত্তিক রান্না

ছোটবেলায় ঠাকুরমা, দিদিমারা বলতেন ‘অসময়ের খাবার খেতে নেই,’ এই অর্থাৎ বলতে অসময়ের ফসলকে উল্লেখ করা হচ্ছে এই বইয়ে। যেমন শীতের আনাজপাতির মধ্যে পড়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলো। আবার গরমে পটল, লাউ, ঝিঙে। যে ঋতুর খাবার সেই ঋতুতে খেলেই শরীরে সইবে। এখন বারোমাস্যা আড়ত করা আনাজ খেয়ে হজমের সমস্যা রোজকার অতিথি। গরমে ফুলকপি, বাঁধাকপিতে পেট গরম করবে, এতে নতুন কী!

আর একটা বিষয়ও এখানে উল্লেখ্য যে স্থানীয় ফসল, আনাজপাতির গ্রহণযোগ্যতা বেশি। ক্রান্তীয় অঞ্চলের আনাজ সেই অঞ্চলের জলবায়ু অনুযায়ী ফলছে। স্থানীয়দের আহার্য হিসেবে তা-ই যথেষ্ট। এখন বিদেশ থেকে আমদানি করা ফল, আনাজপাতি খাওয়ার চল বেড়েছে। সেখানে স্থানীয় উচ্চমানের ভিটামিন, খনিজ সমৃদ্ধ ফল, সবজি ক্রমশ তালিকায় পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমি জগতে নজর রাখলে দেখা যাবে, সেখানে এখন সর্বাপেক্ষা আলোচ্য বিষয় হল ‘লোকাভোর’ অর্থাৎ যাঁরা স্থানীয় খাবার খেতেই পছন্দ করেন। পশ্চিমি দুনিয়া যেখানে ক্রমশ লোকাভোর ধারণার দিকে ঝুঁকছে, সেখানে আমরাকেন আমদানি করা ফল, আনাজপাতির দিকে ঝুঁকছি, সেটা ভাবা দরকার।

Barley laddu

বননিষ্পাব-লড্ডুকম্ (যবের লাড্ডু)। ছবি: সর্বজিৎ সেন।

আনাজপাতির মতো ঋতুভেদে মাছ, মাংসেরও ভাগ রয়েছে ‘পাকদর্পণম’-এ। গরমে মেষ, বর্ষায় মোরগ, শরতে শুধুই মাছ আবার শীতে পাখির মাংস। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে রাজা নলের রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানা। সেই অনুযায়ী এই ধরনের ঋতুভিত্তিক খাবারের ভাগ।

রন্ধনকলা

পাকদর্পণে রান্নার সামগ্রীর ব্যবহার ছিল শুদ্ধ। যেমন রান্নায় শুধু ঘি, নবনীত ব্যবহার হত। কটু তেলের ব্যবহার ছিল নিষিদ্ধ। আবার ঘি, নবনীর ব্যবহার তাপ নিয়ন্ত্রণ করে এমন ভাবে করতে হবে যাতে তা পুড়ে না যায়। পুড়ে গেলেও সেই রান্না আর শুদ্ধ থাকবে না। নানা রকম পায়েস, পিঠে তৈরিতে ব্যবহার হত গুড়, মধু বা মিষ্টি ফলের রস। স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার হত সৈন্ধব লবণের। আর ঝালের জন্য কটুক বা কটুকী ফল— যার মধ্যে মরিচ, কৃষ্ণমরিচ, পেঁয়াজ, রসুনের উল্লেখ রয়েছে।

Kheer made with Honey

মধুক্ষীরঃ ছবি: সর্বজিৎ সেন।

পঞ্চশস্যও তখন বহুল প্রচলিত। মূল আহার্য হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায় পঞ্চশস্যের অর্থাৎ ধান, যব, মাষকলাই, মুগ ও তিলের। এখন যেমন এ দেশের খাদ্যতালিকা থেকে প্রায় মুছেই গিয়েছে যব। কিন্তু সে যুগে যব ছিল অন্যতম প্রধান আহার্য। যবের লাড্ডু (বননিষ্পাব লাড্ডুকম), পায়েসের সন্ধানও মেলে এই গ্রন্থে।

এতে গন্ধে পুষ্পে

কথায় আছে ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং। রান্না সুগন্ধি করার আয়োজনও কম ছিল না তখন। সুবাসের জন্য রান্নায় ফুল মেশানোর চল ছিল। তবে মিষ্টি পদে নয়, খিচুড়িতেও ফুলের প্রয়োগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রণালীতে চোখ রাখলে দেখা যায়, তা আসলে গমের খুদ বা দালিয়া দিয়ে তৈরি মাংসের খিচুড়ি (তহর্যন্নম)। এর সঙ্গে মুগডাল ভেজে নিয়ে জলে পাক করতে হবে। তার পর পড়বে ননী। এ বার একে একে মালতী, চাঁপা ইত্যাদি ফুল। রান্না হয়ে এলে মিশিয়ে দিতে হবে মুরগির ডিমভাজা ও সাঁতলানো মাংসের কুচি। সবশেষে এলাচ, কর্পূরের মতো গন্ধদ্রব্যাদি মিশিয়ে আবার রাঁধতে হবে। এই খিচুড়ি ত্রিদোষনাশক, বলবর্ধক বলে উল্লিখিত।

Daliya (cracked Wheat) pudding

নবগোধূমচূর্ণ পায়সম্ (দালিয়ার পায়েস) ছবি: সর্বজিৎ সেন।

দালিয়া দিয়ে যেমন খিচুড়ির পদ পাওয়া যায়, তেমনই রয়েছে দালিয়ার পায়েস (নবগোধূমচূর্ণ পায়সম্‌)। প্রথমে গমের খুদ ভাল করে আলাদা করে নিয়ে, মহিষের দুধে তা জ্বাল দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে রান্নার সময়ে যেন ধোঁয়া না ওঠে, তা হলে সে রান্না শুদ্ধ থাকে না। কম আঁচে গাঢ় করে ক্ষীর তৈরি করে নিতে হবে। এর পরে পড়বে ফল ও ফুল। যেমন এক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে, ‘তত্র সুগন্ধেন সমন্বিতং কহ্লারকুসুমং দাড়িমস্য ফলং কেষাং তদ্‌-রসং চ বিনিক্ষিপেৎ’— সুগন্ধি কহ্লার অর্থাৎ শ্বেতপদ্মের পাপড়ি ও দাড়িম অর্থাৎ ডালিম বা বেদানার রস দিতে হবে। এই পায়েসে আম্রমঞ্জরী মেশানোর কথাও পাওয়া যায়।

কিছু পায়েসে আবার মেশানো হত কস্তুরী, বহ্নিকা-কুসুম (লেবু ফুল), জাজী অর্থাৎ মালতী ও কেতকী ফুলের পাপড়ি। তবে কোন ফলের সঙ্গে কোন ফুলের পাপড়ি মেশানো হবে, তারও ভাগ রয়েছে। কাঁচা আম বা কাঁঠালের সঙ্গে যেমন কেতকী ফুলের পাপড়ি, বেলের সঙ্গে নারিঙ্গ ফুল বা লেবু ফুলের পাপড়ি। এই ভাবেই ক্রমশ তৈরি হয় বেল সহযোগে, আম-আঙুর বেদানা সহযোগে দালিয়ার পায়েস। এই প্রত্যেকটি পায়েসের গুণও বিবিধ। এগুলো পিত্তনাশক, বলবর্ধক, আবার কোনওটি শরীর শীতলকারী।

এ ছাড়াও উল্লেখ পাওয়া যায় তিতা বেগুন, শাপলা-চিংড়ির ঘণ্ট (কুমুদকন্দ-চিঙ্গট ঘণ্ট), মুগ ডালের বড়া (মুদ্গ-বটক), মধুক্ষীরঃ সহ নানা রন্ধনপ্রণালীর। প্রত্যেক প্রণালীতেই রয়েছে প্রকৃতির নির্যাস, যা আদি ও অকৃত্রিম। হলুদ হয়ে যাওয়া বইয়ের পাতায় এই রন্ধনভান্ডার আবদ্ধ না রেখে, এই রান্নার সুবাস খুঁজে নেওয়ার পালা এ বার...

Water Lilies and Prawn dish

কুমুদকন্দ-চিঙ্গট ঘণ্ট (শাপলা-চিংড়ি ঘণ্ট)। ছবি: সর্বজিৎ সেন।



তথ্যঋণ: রন্ধনশাস্ত্র (রাজা নল প্রণীত রন্ধনপ্রণালী-সম্বলিত ‘পাকদর্পণম’-সহ): অধ্যাপিকা ড. পুরীপ্রিয়া কুণ্ডু; খাবার সৌজন্যে: পৌষ্টিক লাইফ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

healthy food

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy