একটা জাতি গোটা বিশ্বের কাছে সুপরিচিত তাদের খাদ্যাভ্যাসের গুণে। কেউ খেতে ভালবাসেন, কেউ খাওয়াতে, কেউ বা ততটা খেয়ে উঠতে না পারলেও খাওয়ার গল্প শুনতে ভালবাসেন। কেউ দু’টি ডাল-ভাতের সংস্থানে খুশি, কারও পাখির চোখ রাজকীয় আহার, কেউ আবার সন্তানকে ‘দুধে ভাতে’ জড়িয়ে রাখতে চান।
বাঙালির আত্মপরিচিতির বেশ অনেকটাই খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে। দেশভাগ, ভিটেমাটি ছেড়ে আসা, ছিন্নমূলের ব্যথা তখনও নীল করেনি বাঙালিকে। মিলেমিশে এই অবিভক্ত বাংলাতেই তৈরি হয়েছে একের পর এক স্বাদ। মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে সমকালীন প্রবন্ধ... সবেতেই মেলে তার প্রমাণ। এই বাঙালিই বোধহয় একমাত্র, যে ফলের খোসা থেকে ডগা, কাণ্ড থেকে শিকড়, ফুল থেকে পাতা সব কিছু দিয়ে তৈরি করে ফেলতে পারে নানা ব্যঞ্জন। আর রান্না? ভাজা, ভাতে, পোড়া, সিদ্ধ, শুক্তো, ঘণ্ট, ছ্যাঁচড়া, ছেঁচকি, চচ্চড়ি, ছক্কা, ছোকা, ঘ্যাঁট, লাবড়া, ঝাল, ঝোল, ভাপা, ডালনা, দোলমা, অম্বল, টক... এক পঙ্ক্তিতে ধরানোই মুশকিল।
বাঙালির সাবেক ব্যঞ্জনে শুক্তো বা তেতো দিয়ে শুরু করে ডাল-ভাজা, চচ্চড়ি কিংবা ডালনার পরে পাতে পড়ে মাছ-মাংস। অম্বল বা চাটনিতেও শেষ হয় না ব্যঞ্জন। তাই পিঠে-পায়েস-মিষ্টির মধুরেণ সমাপয়েৎ জরুরি। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী খুল্লনার রান্নার বিবরণে লিখেছেন শুক্তো রান্নার পদ্ধতি— ‘বেগুন কুমড়া কড়া, কাঁচকলা দিয়া শাড়া/ বেশন পিটালী ঘন কাঠি।/ ঘৃতে সন্তলিল তথি, হিঙ্গু জীরা দিয়া মেথী/ শুক্তা রন্ধন পরিপাটী।।’ তার পরে ঘি দিয়ে নালিতা শাক ভাজা, কাঁঠালের বীজ দিয়ে চিংড়ি, আখের রস দিয়ে মুগ ডাল, আদা-লঙ্কা গুঁড়ো মাখানো কই ভাজা, চিতলের পেটি ভাজা, রুইয়ের ঝোল, আম শোল, তেঁতুল দিয়ে পাঁকাল মাছ, ভাঁটির জ্বালে রান্না করা ক্ষীর— পদ নেহাত কম নয়!