এক জীবনে জন্ম এক বার, মৃত্যুও এক বারই। পৃথিবীর প্রাণীদের জন্য জীবণমরণের এই সমীকরণ ধ্রুবসত্য। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে কি হিসাব বদলে যায়? পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ এখনও পাননি বিজ্ঞানীরা। তবে মহাকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে তাঁরা নজর রেখেছেন। নক্ষত্রদের জন্ম, মৃত্যুর হিসাব রেখেছেন। সম্প্রতি একটি পর্যবেক্ষণ নক্ষত্র গবেষণার যাবতীয় হিসাবনিকেশ উল্টে দিচ্ছে। মহাকাশে তারাদের জন্ম এবং মৃত্যুর প্রমাণ আগেই পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। এখন মিলছে একই তারার একাধিক মৃত্যুর হদিস!
অসীম মহাশূন্যের কোন প্রান্তে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে, অধিকাংশেরই নাগাল পাওয়া যায় না। সম্প্রতি ইউরোপীয় মহাকাশ পর্যবেক্ষণকেন্দ্র (স্পেস অবজ়ারভেটরি বা ইএসও) থেকে নক্ষত্র গবেষণায় নতুন তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা একটি নক্ষত্রে জোড়া বিস্ফোরণের প্রমাণ পেয়েছেন। এক নক্ষত্রে জোড়া বিস্ফোরণের অর্থ, জোড়া মৃত্যু!
কী ভাবে মৃত্যু হয় নক্ষত্রের?
নক্ষত্রের মৃত্যুর মূলত দু’টি পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের গোচরে রয়েছে। সূর্য এবং অন্যান্য ছোট নক্ষত্রগুলির অন্তিম পর্বে কোনও বিস্ফোরণের সম্ভাবনা নেই। এই ধরনের নক্ষত্র গোটা জীবনের গতিপথে হাইড্রোজেন পরমাণুকে হিলিয়ামে রূপান্তরিত করতে থাকে। হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে, অভিকর্ষের ক্রমাগত টানে নক্ষত্রটি ভেঙে পড়তে শুরু করে। কোর সঙ্কুচিত হলে সঙ্গে সঙ্গে কোরের চার পাশের প্লাজ়মার শেল হাইড্রোজেন পোড়ানোর কাজ শুরু করে। এর ফলে নক্ষত্রের মূল অংশ সঙ্কুচিত হয় ও বাকি অংশ প্রসারিত হতে হতে তার আকারের চেয়ে হাজার গুণ বড় হয়ে যায়। একটা সময় হিলিয়ামের দহন শেষ হলে পড়ে থাকে কার্বন। জ্বালানি ফুরোলেই এই নক্ষত্র অন্তিম দশার দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু বড় নক্ষত্রের ক্ষেত্রে এমন হয় না। বড় নক্ষত্র পৌঁছোয় সুপারনোভা পর্যায়ে।
বিশাল নক্ষত্র তার কেন্দ্রে ভারী উপাদানগুলিকে একত্রিত করে লোহার কেন্দ্রস্থল তৈরি করে। সেই লৌহস্তর যখন ভেঙে পড়ে, প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে মহাকাশে। একে সুপারনোভা বলা হয়। এই পর্যায়ে নক্ষত্রের মধ্যেকার উপাদানগুলি মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুপারনোভার মূল অংশ নিউট্রন নক্ষত্রে (মূলত নিউট্রন দ্বারা গঠিত) পরিণত হয়। অত্যধিক বড় তারার ক্ষেত্রে সুপারনোভা থেকে জন্ম নেয় কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল। এর মাধ্যাকর্ষণ এতটাই শক্তিশালী যে, আলোও এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না।
আরও পড়ুন:
কী পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা?
এত দিন বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, একটি প্রকাণ্ড নক্ষত্র এক বারই বিস্ফোরণের মাধ্যমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু ইএসও-র গবেষকেরা ১ লক্ষ ৬০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে একটি নক্ষত্রের সুপারনোভা (এসএনআর ০৫০৯-৬৭.৫) পর্যায়ের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। আনুমানিক ৩০০ বছর আগে এই ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছিলেন ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ (ভিএলটি) এবং মাল্টি ইউনিট স্পেকট্রোস্কোপিক এক্সপ্লোরার (এমইউএসই)। বিজ্ঞানীদের দাবি, সুপারনোভার এই ধ্বংসাবশেষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, এই নক্ষত্রটিতে অন্তত দু’বার বিস্ফোরণ ঘটেছিল।
চন্দ্রশেখর লিমিট
কোনও ছোট নক্ষত্র (সাদা বামন নক্ষত্র) যে সর্বোচ্চ ভরে (সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ) পৌঁছোনোর পর নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে ভেঙে পড়ে, তাকে চন্দ্রশেখর লিমিট বলা হয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। ইএসও-র সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ বলছে, কিছু কিছু নক্ষত্র চন্দ্রশেখর লিমিটে পৌঁছোনোর আগেও সুপারনোভা পর্যায়ে পৌঁছোতে পারে। ইএসও-র গবেষণা এবং হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপের তথ্য অনুযায়ী, এসএনআর ০৫০৯-৬৭.৫ সুপারনোভা ধ্বংসাবশেষটি একসময়ে সাদা বামন গ্রহ ছিল। তাতেই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। যে কোনও সুপারনোভা বিজ্ঞানীদের পক্ষে অত্যন্ত কার্যকর। কারণ এগুলি মহাজাগতিক দূরত্ব মাপতে সাহায্য করে।
দু’বার বিস্ফোরণ কী ভাবে
সাদা বামন নক্ষত্রটি যদি অন্য কোনও নক্ষত্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তবে তার থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে শুরু করে। যত ক্ষণ পর্যন্ত না চন্দ্রশেখর লিমিট পূর্ণ হচ্ছে, তত ক্ষণ উপাদান সংগ্রহের কাজ চলে। তার পর এই নক্ষত্র সুপারনোভায় বিস্ফারিত হয়। এই বিস্ফোরণের ফলে তরঙ্গ (শকওয়েভ) তৈরি হয়, যা নক্ষত্রটিক কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত করে। এর ফলে ঘটে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। আবার তৈরি হয় সুপারনোভা। নক্ষত্রের জোড়া বিস্ফোরণ নিয়ে আরও বিশদে গবেষণা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।