Advertisement
E-Paper

এই ভারতীয় না থাকলে নতুন ৭ ‘পৃথিবী’র হদিশ মিলত কি?

চিলি যা পারেনি, লাদাখ তা করে দেখাল! বেলজিয়ামের গবেষকদল যার দিক-দিশা পায়নি, তার মুলুকের একেবারে ঠিকঠাক খবরটা এনে দিলেন এক ভারতীয় বিজ্ঞানী।ওই ভারতীয় বিজ্ঞানী না-থাকলে সাত-সাতটা নতুন ‘পৃথিবী’র হদিশ মেলার খবরটা এত তাড়াতাড়ি ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা যেত না।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৭ ১০:৩০
এই সেই সাত ‘পৃথিবী’র মুলুক! (ইনসেটে) ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী দেবেন্দ্র সাহু।

এই সেই সাত ‘পৃথিবী’র মুলুক! (ইনসেটে) ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী দেবেন্দ্র সাহু।

চিলি যা পারেনি, লাদাখ তা করে দেখাল!

বেলজিয়ামের গবেষকদল যার দিক-দিশা পায়নি, তার মুলুকের একেবারে ঠিকঠাক খবরটা এনে দিলেন এক ভারতীয় বিজ্ঞানী।

ওই ভারতীয় বিজ্ঞানী না-থাকলে সাত-সাতটা নতুন ‘পৃথিবী’র হদিশ মেলার খবরটা এত তাড়াতাড়ি ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা যেত না।

এখনও পর্যন্ত নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা সেই ভারতীয় বিজ্ঞানী বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর দেবেন্দ্র কে সাহু। ছত্তিসগঢ়ের সন্তান দেবেন্দ্রের নেতৃত্বে একদল ভারতীয় বিজ্ঞানী জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখে সাড়ে ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় বসানো হিমালয়ান চন্দ্র টেলিস্কোপের (এইচসিটি) ২ মিটার ব্যাসের লেন্সে টানা ৬ ঘণ্টা চোখ লাগিয়ে রেখে নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন এই ব্রহ্মাণ্ডে ‘আমাদের পাড়া’ মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির ‘অ্যাকোয়ারিয়াস’ নক্ষত্রপুঞ্জে থাকা ওই আশ্চর্য সৌরমণ্ডল ‘ট্রাপিস্ট-১’-এর অস্তিত্ব। জানাতে পেরেছিলেন, বেলজিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী লিগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক মিশেল গিলনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক গবেষকদল ওই সৌরমণ্ডলে একটি অসম্ভব রকমের ঠাণ্ডা (আলট্রা-কুল) বামন নক্ষত্রকে (ডোয়ার্ফ স্টার, যার নাম- ‘ট্রাপিস্ট-১’) ঘিরে একেবারে পৃথিবীর আকারের যে-তিনটি গ্রহ পাক মারছে বলে অনুমান করছেন, তা একেবারেই সঠিক। আর সেই তিনটি আদ্যোপান্ত পৃথিবীর আকারের ভিনগ্রহ- ‘ট্রাপিস্ট-১বি’, ট্রাপিস্ট-১সি’ ও ‘ট্রাপিস্ট-১ডি’ রয়েছে তাদের নক্ষত্র (ট্রাপিস্ট-১) থেকে ঠিক সেই দূরত্বে, যাকে বলে ‘গোল্ডিলক্‌স জোন’। মানে, কোনও নক্ষত্র থেকে তাকে ঘিরে পাক মারা কোনও গ্রহ যে দূরত্বে থাকলে সেই গ্রহের পিঠেই (সারফেস) জল থাকতে পারে তরল অবস্থায়। তাকে জমে গিয়ে যেমন বরফ হয়ে যেতে হয় না, তেমনই তা অত্যন্ত তাপে বাষ্পীভূতও হয়ে যায় না। আর জল তরল অবস্থায় থাকার মানে, তা প্রাণের হদিশ মেলার সম্ভাবনাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে, ১০০ বছর পর আমরা পৃথিবীর মতোই এই ব্রহ্মাণ্ডে আরও একটি বাসযোগ্য গ্রহে পাড়ি জমাতে পারব কি না, তার জবাবে কিছুটা আলো দেখাতে পারল যে আন্তর্জাতিক গবেষণা, তাতে রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেবেন্দ্রের নেতৃত্বে লাদাখে টেলিস্কোপে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ। ২২ ফেব্রুয়ারি নাসা ঘোষণা করল, এই প্রথম পৃথিবীর মাপে একই সঙ্গে সাতটি গ্রহের হদিশ মিলল, যা পাক মারছে খুব টিমটিম করে জ্বলা একটি বামন নক্ষত্রকে (ডোয়ার্ফ স্টার)। আমাদের থেকে মাত্র ৪০ আলোকবর্ষ দূরে।


এই সেই আশ্চর্য সৌরমণ্ডল।

কী ভাবে এই সাড়াজাগানো আন্তর্জাতিক গবেষণায় জড়িয়ে পড়েছিলেন দেবেন্দ্র?


আমাদের সৌরমণ্ডলের নিরিখে ‘ট্রাপিস্ট-১’ সৌর-সংসার

বেঙ্গালুরু থেকে টেলিফোনে জ্যোতির্বিজ্ঞানী দেবেন্দ্র সাহু বললেন, ‘‘বেলজিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল গিলনের নেতৃত্বে একটি গবেষকদল প্রথম ওই সৌরমণ্ডলের (ট্রাপিস্ট-১) খোঁজ করতে নামেন ২০১১ সালে। তার পর ২০১৫-য় তাঁরা চিলিতে বসানো ‘ট্রাপিস্ট’ টেলিস্কোপ (যার পুরো নাম- ‘ট্রানজিটিং প্ল্যানেটস অ্যান্ড প্ল্যানেটিসিম্যালস স্মল টেলিস্কোপ) দিয়ে দেখতে পান পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০ আলোকবর্ষ দূরে (২৩৫ ট্রিলিয়ন মাইল) একটি বামন নক্ষত্র রয়েছে ‘অ্যাকোয়ারিয়াস’ নক্ষত্রপুঞ্জে। যে নক্ষত্রটি জ্বলছে খুব টিমটিম করে। আর যে নক্ষত্রটির আঁচ আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক অনেক গুণ কম। চেহারাতেও সে একরত্তি। কিন্তু চিলির ‘ট্রাপিস্ট’ টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে গিলন ও তাঁর সহযোগী জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন, ওই বামন নক্ষত্রটির আলো কখনও কমছে, কখনও বাড়ছে। কেন এই আলোর বাড়া-কমা, তার যথাযথ কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না বিজ্ঞানীরা। তার পর তাঁরা শরণাপন্ন হন চিলিতেই বসানো আরও একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপের। যার নাম- ‘ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ’ বা ‘ভিএলটি’। তাতে তাঁরা দেখলেন, ওই বামন নক্ষত্রটির আলোর বাড়া-কমার কারণ আসলে তাকে ঘিরে পাক মারছে খুব কাছাকাছি থাকা তিন-তিনটি গ্রহ। অবিকল পৃথিবীর মতো। পাথুরে, জলে ভরা। আর সেগুলি রয়েছে তাদের নক্ষত্র থেকে যে দূরত্বে, তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘গোল্ডিলক্‌স জোন’ বা ‘হ্যাবিটেব্‌ল জোন’। মানে, যেখানে কোনও গ্রহ থাকলে, সেখানে প্রাণের জন্ম বা বিকাশের মতো তরল জল, বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ওঁরা তার পরেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না।’’


সাত গ্রহ নিয়ে ‘ট্রাপিস্ট-১’-এর সৌর-সংসার


ইনফ্রারেড ব্যান্ডের টেলিস্কোপে যে ভাবে ধরা দিয়েছিল এই আশ্চর্য সৌরমণ্ডল

কেন নিশ্চিত হতে পারছিলেন অধ্যাপক গিলন ও তাঁর সহযোগীরা?

দেবেন্দ্র বললেন, ‘‘সাধারণত, তিন ধরনের টেলিস্কোপ দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডকে দেখা হয়। একটি দৃশ্যমান আলো বা অপটিক্যাল ব্যান্ডের টেলিস্কোপ। আলোর অন্য দু’টি ব্যান্ডকে চোখে দেখা যায় না। ইনফ্রারেড আর আল্ট্রাভায়োলেট রেঞ্জের এক্স-রে টেলিস্কোপ। চিলির ‘ট্রাপিস্ট’ টেলিস্কোপটি ছিল ইনফ্রারেড ব্যান্ডের। অধিকতর শক্তিশালী ‘ভিএলটি’ টেলিস্কোপটি দিয়ে দু’টি ব্যান্ডই দেখা যায়। অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড ব্যান্ড। কিন্তু ওই তিনটি গ্রহ তাদের নক্ষত্রকে এক বার পাক মারতে কতটা সময় লাগায় (অরবিটাল পিরিয়ড), সে ব্যাপারে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলেন না গিলন ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা। তাঁরা তখন ভারতের দ্বারস্থ হন। কারণ, এত দিন তাঁরা যে দু’টি টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে ওই আশ্চর্য সৌরমণ্ডল আর সেখানে থাকা অবিকল পৃথিবীর চেহারার তিনটি ভিনগ্রহের হদিশ পেয়েছেন, সেই চিলির প্রায় উল্টো দিকের দ্রাঘিমাংশে (লঙ্গিটিউড) রয়েছে ভারতের লাদাখে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার উচ্চতায় বসানো ‘হিমালয়ান চন্দ্র টেলিস্কোপ’ (এইচসিটি)। এই টেলিস্কোপ দিয়ে অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড ব্যান্ডে কোনও মহাজাগতিক বস্তুকে দেখতে পাওয়া যায়। ‘ভিএলটি’-র থেকে এর সুবিধাটা হল, অনেক বেশি উচ্চতায় লাদাখে বসানো রয়েছে এই ‘এইচসিটি’। আর যেহেতু এই টেলিস্কোপ দিয়ে অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড-দু’টি ব্যান্ডকেই দেখা যায়, তাই চিলির ‘ট্রাপিস্ট’ টেলিস্কোপের চেয়ে লাদাখের ‘এইচসিটি’-র সুবিধা অনেক বেশি। গোড়া থেকেই ওই টেলিস্কোপের মাধ্যমে যাবতীয় পর্যবেক্ষণের দায়িত্বটা রয়েছে আমার কাঁধে। তাই গিলনদের দেখা ‘ট্রাপিস্ট-১’ সৌরমণ্ডলে তিনটি ভিনগ্রহকে ২০১৫-র ২৪ নভেম্বর রাতে টানা ৬ ঘণ্টা ওই টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে নিশ্চিত করার কর্মযজ্ঞে নামতে হয় আমাদের।’’
আমাদের সৌরমণ্ডলের নিরিখে ‘ট্রাপিস্ট-১’ সৌর-সংসার


যে ভাবে ‘ট্রাপিস্ট-১’ সৌর-সংসার ধরা পড়েছিল লাদাখের টেলিস্কোপে

গিলনদের গবেষণার কোন খুঁত ধরা পড়েছিল দেবেন্দ্র ও তাঁর সহযোগীদের পর্যবেক্ষণে?

দেবেন্দ্রের কথায়, ‘‘প্রথম খুঁতটা ধরা পড়ে ‘ট্রাপিস্ট-১বি’ গ্রহটির অরবিটাল পিরিয়ডের হিসেবে। গিলন ও তাঁর সহযোগীরা ‘ভিএলটি’, ‘ট্রাপিস্ট’ আর হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে বসানো ‘ইউকে ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ’ দিয়ে পর্যবেক্ষণের পর বলেছিলেন, ওই ভিনগ্রহটির (ট্রাপিস্ট-১বি) অরবিটাল পিরিয়ড হবে ৩.০২ পার্থিব দিন। কিন্তু আমরা পর্যবেক্ষণের পর নিশ্চিত হই যে, ওই ভিনগ্রহটির অরবিটাল পিরিয়ড আদৌ ৩.০২ পার্থিব দিন নয়। আদতে সেটা ১.৫১ পার্থিব দিন। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ গিলান ও তাঁর সহযোগী গবেষকদরে সঙ্গে আমার গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ২০১৬-র মে মাসে। আমরা ওই ট্রাপিস্ট-১ নক্ষত্র থেকে তিনটি গ্রহের সঠিক দূরত্বও বলতে পেরেছিলাম। পরে এই ফেব্রুয়ারিতেই নাসার স্পিৎজার স্পেস টেলিস্কোপ ওই সৌরমণ্ডলে পৃথিবীর আকারের আরও ৪টি গ্রহের হদিশ পায়। ‘ট্রাপিস্ট-১ই’, ‘ট্রাপিস্ট-১এফ’, ‘ট্রাপিস্ট-১জি’ এবং ‘ট্রাপিস্ট-১এইচ’। আমাদের অনুমান, একেবারে দূরে থাকা ‘ট্রাপিস্ট-১এইচ’ গ্রহটি হয়তো বরফে ভরা কোনও গ্রহ হতে পারে। আর ‘ট্রাপিস্ট-১এফ’-এর বায়ুমণ্ডল হতে পারে অনেকটা আমাদের বৃহস্পতির মতো, গ্যাসে ভরা। তবে বাকি গ্রহগুলি পাথুরে আর জলে ভরা বলেই প্রাথমিক ভাবে আমাদের মনে হয়েছে।’’

আরও পড়ুন: নতুন সাত ‘পৃথিবী’র খোঁজ পেল নাসা, মিলবে কি প্রাণের সন্ধান?

ছবি সৌজন্যে: নাসা

TRAPPIST-1 7 Earth Sized Planets Devendra K Sahu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy