দুই বাবা সন্তানের জন্ম দিয়ে ইতিহাস তৈরি করেছিল। তাদের সেই সন্তান সুস্থসবলও হয়েছিল। দিব্যি খেয়েদেয়ে, হাঁটাচলা করে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু বাধা আসে বংশবিস্তারে। দুই বাবার সন্তান নিজে আর সন্তানের জন্ম দিতে পারছিল না। এত দিনে সেই ‘অসম্ভব’কেও সম্ভব করে দেখালেন বিজ্ঞানীরা! সুস্থ ভাবে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিল দুই বাবার সন্তানও। মানুষ নয়, গোটা পরীক্ষাটি আপাতত করা হয়েছে ইঁদুরের উপর। ভবিষ্যতে মানুষের উপরেও এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা সম্ভব কি না, এই সাফল্যের পর তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
দুই পুরুষের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে বলে অ্যান্ড্রোজেনেসিস। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন সন্তান উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল পুরুষের কাছ থেকেই জিনগত উপাদান পেয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় গবেষণাগারে এর আগে দুই পুরুষ ইঁদুর থেকে নতুন ইঁদুরের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তবে সেই ইঁদুরগুলি নিজেরা সন্তানধারণ করতে পারেনি। চিনের সংহাই জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েননি। তাঁরা দুই পুরুষ ইঁদুর থেকে প্রজননক্ষম সুস্থ ইঁদুর তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাতে সম্প্রতি এসেছে সাফল্য। তাঁদের গবেষণাপত্র ২৫ জুন পিএনএএস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
কী ভাবে কী করা হয়েছে?
প্রথমে দু’টি পুরুষ ইঁদুরের থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করেন বিজ্ঞানীরা। তা ইঁদুরের ডিম্বাণুর সঙ্গে মেশানো হয়। এই ডিম্বাণুটি থেকে নিউক্লিয়াসটি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল আগেই। নিউক্লিয়াসেই স্ত্রী-ডিএনএ থাকে। তা সরিয়ে ফেলা হলে স্ত্রী ইঁদুরের বিশেষত্ব আর ওই ডিম্বাণুতে অবশিষ্ট থাকে না। ডিএনএ সম্বলিত নিউক্লিয়াসটি সরিয়ে ফেলার পর দুই পুরুষ ইঁদুরের শুক্রাণু দিয়ে ডিমটিকে নিষিক্ত করা হয়। তৈরি হয় ২৫৯টি ভ্রূণ। নিষেকের প্রক্রিয়াটির জন্য অন্য ইঁদুরের গর্ভ (সারোগেট) ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ২৫৯-এর মধ্যে মাত্র তিনটি ভ্রূণ থেকে ইঁদুরের জন্ম হয়। তার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা গিয়েছিল দু’টিকে।
চিনের গবেষণাগারে দুই পুরুষ ইঁদুর থেকে জন্ম নেওয়া দু’টি প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুর। পিএনএএস জার্নালে প্রকাশিত ছবি।
এই দুই ইঁদুর প্রাপ্তবয়স্ক হলে অন্যান্য ইঁদুরের সংস্পর্শে আসে এবং যথাসময়ে তারা সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণাপত্রে তাঁরা লিখেছেন, ‘‘অ্যান্ড্রোজেনেসিস পদ্ধতিতে তৈরি ভ্রূণের বিকাশ আরও উন্নত করার চেষ্টা করছি আমরা। দু’টি শুক্রাণু কোষ থেকে প্রাপ্ত জেনেটিক উপাদান ব্যবহার করে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রজননক্ষম ইঁদুর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।’’ গোটা প্রক্রিয়ায় আরও উন্নতি প্রয়োজন, মেনে নিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। দুই পুরুষের শুক্রাণু থেকে নতুন ইঁদুর তৈরিতে সাফল্যের অনুপাত ২৫৯:৩ মাত্র।
কল্যাণীর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জিনোমিকস’-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক পার্থপ্রতিম মজুমদার বলেন, ‘‘যে পদ্ধতিতে দুটি পুরুষ ইঁদুর থেকে নতুন ইঁদুর তৈরি করা হয়েছে, তা স্বাভাবিক পদ্ধতি নয়। দুটি পুরুষ ইঁদুরের থেকে শুক্রাণু নেওয়া হয়েছে। একটি মা ইঁদুরের ডিম্বাণু নেওয়া হয়েছে। সেই ডিম্বাণু থেকে বার করে নেওয়া হয়েছে নিউক্লিয়াস। সাধারণত যৌনজনন পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে ইমপ্রিন্টিং কন্ট্রোল রিজন। ক্রোমোজোমের মধ্যে এমন কিছু জিন থাকে, যেগুলি সমলিঙ্গে সন্তানধারণ আটকায়। চিনা বিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে সেই বিশেষ জিনগুলিকেই কোনও না কোনও ভাবে সরাতে সক্ষম হয়েছেন। এটা ওঁদের আবিষ্কৃত কোনও পদ্ধতি নয়। আগেই এই পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। চিনারা সেই পদ্ধতি খুব ভাল ভাবে রপ্ত করেছে। তার ফলও পেয়েছে।’’
নতুন ইঁদুর তৈরিতে শুধুই বাবার অবদান, মা ইঁদুরের কোনও ভূমিকা নেই? পার্থ বলেন, ‘‘সেটা বলা যাবে না। আমরা আমাদের কোষে মাইটোকন্ড্রিয়াগুলি স্বাভাবিক নিয়মেই মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকি। এই মাইটোকন্ড্রিয়া কিন্তু নিউক্লিয়াসের বাইরে সাইটোপ্লাজমের মধ্যে থাকে। ওঁরা শুধু নিউক্লিয়াস সরিয়েছেন। সাইটোপ্লাজমে হাত দেননি। ফলে নতুন ইঁদুরেও মাইটোকন্ড্রিয়ার মাধ্যমে মায়ের অবদান থেকেই গিয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘তাতেও অবশ্য নতুন ইঁদুরের প্রজননক্ষম হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু স্টেম সেল (স্টেম কোষ) প্রবেশ করানো হয়েছে। কী ভাবে প্রজননক্ষম ইঁদুর তৈরি হল, বিজ্ঞানটা ওঁদের কাছেও খুব স্পষ্ট নয়।’’
বিজ্ঞানীরা প্রায় সকলেই একমত, ইঁদুরে যা সম্ভব হয়েছে, তা ভবিষ্যতে মানুষের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায় কি না, সেই ভাবনার সময় এখনও আসেনি। ইঁদুরের মধ্যেই এই প্রক্রিয়া এখনও অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন। অধিকাংশ প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে আপাতত এই পদ্ধতি ইঁদুরে আরও উন্নত করার দিকেই মন দিতে চান গবেষকেরা। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘‘বর্তমানে এই পদ্ধতির সাফল্যের হার কম। তবে এই আবিষ্কারটি আগামী দিনে স্তন্যপায়ীদের মধ্যে অ্যান্ড্রোজেনেসিসে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।’’
তবে অনেকেই মনে করছেন, দুই পুরুষ থেকে নতুন প্রাণ উৎপাদন সম্ভব হলে আগামী দিনে সমকামী যুগলদের জন্য তা খুশির খবর বয়ে আনবে। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের হাত ধরে তাঁরাও সন্তানধারণের কথা ভাবতে পারবেন। কিন্তু এখনই সেই পর্যায়ের ভাবনাচিন্তায় নারাজ বিজ্ঞানীরা। পার্থ বলেন, ‘‘ইঁদুরের উপর যে পরীক্ষাটি করা হয়েছে, মানুষের উপর তা করতে দেওয়া হবে বলেই আমি মনে করি না। নীতিগত ভাবে তা সম্ভব নয়। সবথেকে বড় কথা হল, এই প্রক্রিয়া জটিল। এতে বিকৃত শিশুর জন্মের সম্ভাবনাও থেকে যায়। মানুষের ক্ষেত্রে আগামী ৫০ বছরেও এই পদ্ধতির প্রয়োগ আমি দেখতে পাচ্ছি না।’’ ইঁদুরে সাফল্য এলেও অ্যান্ড্রোজেনেসিস নিয়ে আপাতত ধীর গতিতে এগোতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা।