একটি বিন্দু থেকে গোটা ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম। সেই জন্মলগ্ন থেকেই ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে মহাবিশ্ব, যা শুরু হয়েছে আজ থেকে প্রায় ১৩৮০ কোটি বছর আগে। বিজ্ঞানীরা সস্নেহে যার নাম দিয়েছেন ‘বিগ ব্যাং’ বা ‘মহাবিস্ফোরণ’ (আক্ষরিক অর্থে বিস্ফোরণ নয়, প্রসারণ বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত)। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের যখন বিনাশ হবে, তখন তা আবার বিগ ব্যাংয়ের আগের অবস্থাতেই ফিরে যাবে। ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে, সব আবার এক বিন্দুতেই বিলীন হবে। এমনই দাবি নয়া গবেষণায়।
ব্রহ্মাণ্ড যে আসলেই প্রসারিত হচ্ছে, অঙ্ক কষে তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন হেনরিটা সোয়ান লেভিট এবং এডউইন হাবল নামে দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী। গবেষণায় দেখা যায়, যত দিন যাচ্ছে, এক-একটা নক্ষত্রপুঞ্জ ক্রমশ দূরে... আরও দূরে সরে যাচ্ছে। যার অর্থ, আয়তনে বাড়ছে ব্রহ্মাণ্ড।
আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের অবতারণার সময় একই কথা বলেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইনও। নানা সমীকরণে তিনি বুঝেছিলেন, এই ব্রহ্মাণ্ড হয় ক্রমাগত সঙ্কুচিত হচ্ছে, নয়তো প্রসারিত হয়ে চলেছে। সেই সময় তিনি ‘ডার্ক এনার্জি’র ধারণা দিয়েছিলেন। আসলে মহাকর্ষের টানে প্রসারণে লাগাম পড়ার কথা ছিল। কতটা লাগাম পড়ল, সম্প্রসারণের হার কতটা কমে এল, তা মাপতে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। তাঁরা দেখলেন, ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ হার তো কমছেই না। উল্টে তা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অচেনা কোনও এক শক্তির ধাক্কায়। এই শক্তিই হল ‘ডার্ক এনার্জি’।
কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানী মহলের একাংশের ধারণা, এই ‘ডার্ক এনার্জি’ এখন যে ভাবে কাজ করছে, ভবিষ্যতে সে ভাবে কাজ না-ও করতে পারে। ভবিষ্যতে বদলে যেতে পারে এই অদৃশ্য শক্তির চরিত্র। আর তেমনটা ঘটলে মহাবিশ্ব আর প্রসারিত হবে না! বরং, তা সঙ্কুচিত হতে শুরু করবে, যা ডেকে আনবে ব্রহ্মাণ্ডের বিনাশ।
গত এক বছরে এই বিষয়টি নিয়ে দু’টি সমীক্ষা হয়েছে। একটির নাম ‘ডার্ক এনার্জি সার্ভে’। অন্যটি হল ‘ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্ট’। গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছিল। সেটির নাম— ‘দ্য লাইফস্প্যান অফ দ্য ইউনিভার্স’। সেখানে ‘ডার্ক এনার্জি’র চরিত্র-আচরণ নিয়ে নানা দাবি করা হয়।
এমনিতে এই ব্রহ্মাণ্ড ৩,৩০০ কোটি বছর বাঁচবে বলে মনে করা হয়। যদি তা ধরেই এগোনো যায়, তা হলে এখন সে মাঝবয়সে পৌঁছে গিয়েছে। গবেষণাপত্রের লেখক, আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হেনরি টাই অঙ্ক কষে দেখালেন, আর ১,১০০ কোটি বছর পর ব্রহ্মাণ্ডের সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন শুরু হবে সঙ্কোচন। ব্রহ্মাণ্ড ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পরিণত হবে একটি বিন্দুতে। এই প্রক্রিয়াকে ‘বিগ ক্রাঞ্চ’ বলে থাকেন বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন:
‘ডার্ক এনার্জি’র মূলত দু’টি অংশ। একটি হল ‘অ্যাগজ়িয়ম’। বিজ্ঞানীরা অনেকে মনে করেন, এটি একটি অতি ক্ষুদ্র কণা। তবে সবটাই অনুমানের পর্যায়ে রয়েছে। এর অস্তিত্ব আজও প্রমাণ হয়নি।
দ্বিতীয় অংশটিকে বলা হয় ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’। অভিকর্ষ তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে আইনস্টাইন তাঁর ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা’ তত্ত্বের সমীকরণে একটি ধ্রুবকের আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধ্রুবকটিরই নাম ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’। গ্রিক অক্ষর ‘ল্যামডা’ দিয়ে একে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। পরে অবশ্য সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণার সঙ্গে সাযুজ্য রাখতেই তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণ থেকে ‘ল্যামডা’ সরিয়ে দেন আইনস্টাইন। তবে আজকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি, আইনস্টাইনের সমীকরণ থেকে বাদ পড়া সেই ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’-এর মাধ্যমেই ‘ডার্ক এনার্জি’র সবচেয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।
বিজ্ঞানীমহলের দাবি, মহাবিশ্ব যে প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তা মূলত এই ‘অ্যাগজ়িয়ম’-এর কারণে। কিন্তু ভবিষ্যতে ওই কণা তার শক্তি হারাবে। তার ফলে ব্রহ্মাণ্ডের সম্প্রসারণের গতি কমতে শুরু করবে। সেই সময় চরিত্র বদলাতে পারে ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’-এর। দেখা যেতে পারে নেতিবাচক আচরণ। অর্থাৎ, ‘নেগেটিভ কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’। যার অর্থ হল— তখন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং তা ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে শুরু করবে।
যদিও এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ কিছু প্রাথমিক তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে। এ ব্যাপারে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেজ্ঞদের বক্তব্য, ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’-এর আচরণ নেতিবাচক হলেও যে এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ ঠিক, সে কথা বলা যাবে না।
গত শতাব্দীর শেষ সিকিভাগ ধরে বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করে এসেছেন, এই মহাবিশ্বে যা যা রয়েছে, সেই সব কিছুর মৌলিক উপাদান অণু আর পরমাণু। তবে ব্রহ্মাণ্ডের মাত্র ৫ শতাংশ এই অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি। ২৫ শতাংশ তৈরি ‘ডার্ক ম্যাটার’ দিয়ে। এটি হল এক ধরনের অজানা বস্তু, যা দেখা যায় না। তবে অভিকর্ষের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব জানা যায়। বাকি ৭০ শতাংশই তৈরি ‘ডার্ক এনার্জি’ দিয়ে।
‘ডার্ক এনার্জি’র উৎস নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। এ ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। অনেকের মতে, মহাশূন্যের অসীম শূন্যতার মাঝে সব সময় যে ‘কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন’ বা কোয়ান্টাম শক্তির রূপান্তর ঘটে চলেছে, তার ফলে ‘ডার্ক এনার্জি’র সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও এর সপক্ষে এখনও তেমন কোনও জোরদার প্রমাণ নেই। ফলে ‘ডার্ক এনার্জি’র রহস্য এখনও পর্যন্ত অধরাই রয়ে গিয়েছে। যে শক্তির উৎস সম্পর্কেই এখনও ঠিক ভাবে জানা গেল না, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তার চরিত্র বদলের সম্ভাবনা নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীদের বড় অংশ।