খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছিল চার দশক আগে। ১৯৮৩ সালে। খোঁজ মিলল ৪২ বছর পর। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড থেকে পাওয়া গেল গাছে চড়া প্রাগৈতিহাসিক কুমিরের ডিমের খোসা। কথা হচ্ছে, পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক মেকোসুচিন কুমিরকে নিয়ে। তাদের অস্তিত্বের কথা আগেই জানা গিয়েছিল। এ বার জানা গেল বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই সরীসৃপদের শিকার ধরার কায়দা।
অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্বে কুইন্সল্যান্ডের মুরগন শহরে এক খামারবাড়িতে মাটি খুঁড়়ে পাওয়া গিয়েছে জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া এই ডিমের খোসাগুলি। জীবাশ্মবিদদের দাবি, সেগুলি প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছরের পুরানো। মেকোসুচিন কুমিরের এত পুরানো জীবাশ্ম এর আগে পাওয়া যায়নি। অস্ট্রেলিয়ার লবণাক্ত এবং মিষ্টি জলে বর্তমানে কুমিরের যে প্রজাতিগুলি দেখা যায়, তাদের আবির্ভাব হয়েছে প্রায় ৩৮ লক্ষ বছর আগে। তবে এদেরও আগে থেকে অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু দ্বীপে ঘুরে বেড়াত গাছে চড়া কুমিরেরা।
কুমির বংশের এই উপগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি ছিল। সবগুলিই বর্তমানে বিলুপ্ত। ধরে নেওয়া হয়, মেকোসুচিন কুমিরের সর্বশেষ কিছু প্রজাতি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে। সেই হারিয়ে যাওয়া কুমিরদের প্রাচীনতম জীবাশ্ম এ বার খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা। ওই জীবাশ্ম (ডিমের খোসা) বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, মেকোসুচিন কুমিরেরা শুধু গাছে চড়তেই জানত না, গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে শিকার ধরতেও পটু ছিল।
স্পেনের বার্সেলোনার ‘ইনস্টিটিউট ক্যাটালা ডি প্যালিওন্টোলজিয়া মিকেল ক্রুসাফন্ট’-এর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের একটি দল কুইন্সল্যান্ডে ওই ডিমের খোসাগুলি খুঁজে পায়। এই গবেষণায় তাদের সাহায্য করে সিডনির নিউ সাউথ ওয়েল্স বিশ্ববিদ্যালয়ও। গবেষণায় উঠে এসেছে, মেকোসুচিন কুমিরেরা অন্তত ৫ মিটার (প্রায় ১৬ ফুট) পর্যন্ত লম্বা হত। এদের মধ্যে কিছু কুমির গাছের উপর থেকে শিকার করতে পারত। গবেষকেরা গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে শিকার ধরা এই কুমিরদের নাম রেখেছেন ‘ড্রপ ক্রোক’।
গবেষকদলের অন্যতম সদস্য নিউ সাউথ ওয়েল্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল আর্চার। গাছে চড়া কুমিরদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অনুমান করা হচ্ছে, এদের মধ্যে কিছু কুমির জঙ্গলেই শিকার করত। এরা সম্ভবত চিতাবাঘের মতো শিকার ধরত। পছন্দের খাবারের উপর গাছের উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত। অন্তত কিছু ‘ড্রপ ক্রোক’ সর্ব ক্ষণের জন্য না হলেও দীর্ঘ সময় গাছেই থাকত।” গত মঙ্গলবার ‘জার্নাল অফ ভার্টিব্রেট প্যালিওন্টোলজি’তে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।
মেকোসুচিন কুমিরের জীবাশ্ম আগেও পাওয়া গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। কুইন্সল্যান্ডেরই অপর এক প্রান্ত থেকে সেগুলি পাওয়া গিয়েছিল। তবে তা এত পুরনো ছিল না। সেগুলি ছিল প্রায় আড়াই কোটি বছরের পুরানো। নতুন খুঁজে পাওয়া জীবাশ্মগুলি এই সরীসৃপদের শারীরিক গঠন এবং অভিযোজন ক্ষমতা আরও ভাল করে বুঝতে সাহায্য করছে বিজ্ঞানীদের।
গবেষকদলের প্রধান জেভিয়ার পানেডসও একই কথা জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, “এই প্রাগৈতিহাসিক ডিমের খোসাগুলি মেকোসুচিন কুমিরের শারীরবৃত্তীয় গঠন, প্রজনন এবং অভিযোজনের ক্ষমতা বুঝতে সাহায্য করছে। তারা কী ধরনের প্রাণী ছিল, কোথায় থাকত, কী ভাবে বংশবিস্তার করত— এই সবেরই আভাস মেলে এই জীবাশ্ম থেকে।”
গাছে চড়া এই কুমিরেরা কবে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, তা সুস্পষ্ট ভাবে এখনও বলা যায় না। তবে অনুমান করা হয়, প্রায় তিন হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে কুমিরের এই উপগোষ্ঠী। নিউ সাউথ ওয়েল্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা গবেষকদলের অন্যতম সদস্য মাইকেল স্টেনের মতে, অন্য শিকারি প্রাণীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে না পেরে এবং শিকারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ফলে এই কুমিরেরা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে ঠিক কী কারণে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, তা বুঝতে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই প্রাগৈতিহাসিক ডিমের খোসা এদের প্রজনন এবং অভিযোজন সংক্রান্ত গবেষণায় আরও নতুন দিক খুলে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।