Advertisement
E-Paper

চাঁদের অন্দর ভেসে যাচ্ছে জলে, স্পষ্ট ছবি দিল ভারতের ‘চন্দ্রযান-১’

সেই জল এখনও রয়েছে তরল অবস্থায়, তাই শুধুই প্রাণের সম্ভাবনা নয়, বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস আরও জোরালো হল, প্রাণ বা জীবনের অস্তিত্ব নিশ্চিত ভাবেই রয়েছে চাঁদ মুলুকে। হতে পারে তা অণুজীব।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৭ ১৬:৪৭
চাঁদ। ফাইল চিত্র।

চাঁদ। ফাইল চিত্র।

দুই মেরুতে জল (আইস ওয়াটার হিসেবে) আছে, জানা ছিল। পিঠেও (সারফেস) কোথাও কোথাও জল আছে, তা অজানা ছিল না। কিন্তু চাঁদের একেবারে অন্দরে ‘ম্যান্টল’-এ যে জল রয়েছে পুরোপুরি তরল অবস্থায়, এ বার তা সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা গেল। এও জানা গেল, তরল অবস্থায় থাকা সেই জল রয়েছে প্রচুর পরিমাণে।

চাঁদ মুলুকে ৯ বছর আগে পাঠানো ভারতের মহাকাশযান ‘চন্দ্রযান-১’-এর দেওয়া তথ্যাদি আর ছবি বিশ্লেষণ করে এই চমকদার তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আর যেহেতু সেই জল এখনও রয়েছে তরল অবস্থায়, তাই শুধুই প্রাণের সম্ভাবনা নয়, বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস আরও জোরালো হল, প্রাণ বা জীবনের অস্তিত্ব নিশ্চিত ভাবেই রয়েছে চাঁদ মুলুকে। হতে পারে তা অণুজীব।

যে গবেষণাপত্র এই চমকদার তথ্যটি দিয়েছে, সেটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-জিওসায়েন্স’-এর ২৪ জুলাই সংখ্যায়। মূল গবেষক আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ, এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর র‌্যালফ মিলিকেন ও হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো শুয়াই লি। সহযোগী গবেষকদের মধ্যে রয়েছেন দুই ভারতীয়। এক জন ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মহেশ আনন্দ। অন্য জন আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বিষ্ণু রেড্ডি।

চাঁদের পিঠে যেখানে যেখানে জলের হদিশ মিলেছে (নীল ছোপ)। ছবি- নাসা

বহু কোটি বছর আগে চাঁদের বিশাল বিশাল আগ্নেয়গিরিগুলো ছিল জীবন্ত। তাদের জ্বালামুখ থেকে অসম্ভব গরম লাভাস্রোত (যার অন্যতম উপাদান- ‘ম্যাগমা’) বেরিয়ে এসেছিল। ম্যাগমা বেরিয়ে আসে পৃথিবী ও চাঁদের ম্যান্টল বা হৃদয়ের অন্তঃপুর থেকে। সেই ম্যাগমার মধ্যেই ছিল কাচের টুকরোর মতো পদার্থ। যাকে বলা হয়, ‘ভলক্যানিক গ্লাসেস’। চাঁদের প্রায় গোটা পিঠ জুড়ে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে সেই কাচের টুকরোগুলি। প্রচুর পরিমাণে। প্রায় সাড়ে ৪ দশক আগে নাসার দু’টি মহাকাশযান ‘অ্যাপোলো-১৫’ ও ‘অ্যাপোলো-১৭’ চাঁদের পিঠ থেকে কুড়িয়ে এনেছিল সেই ম্যাগমায় মিশে থাকা কাচের টুকরোগুলো। তখনই বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন, সেই ‘ভলক্যানিক গ্লাসেস’ টুকরোগুলো একেবারে ভিজে চুপচুপে হয়ে রয়েছে। তাঁদের ধারণা হয়েছিল, চাঁদের পিঠের কোনও কোনও অংশ, যেখানে জল এখনও আছে, সেই জলেই বোধহয় ভিজে চুপচুপে হয়েছিল ম্যাগমার সঙ্গে থাকা কাচের টুকরোগুলো। কিন্তু, ‘চন্দ্রযান-১’-এর পাঠানো তথ্যাদি আরও নিখুঁত ভাবে পরখ করে এ বার গবেষকরা দেখেছেন, চাঁদের পিঠে যেখানে এখনও পর্যন্ত জলের হদিশ পাওয়ার সম্ভাবনা দূর অস্তই, সেই সব জায়গা থেকে কুড়িয়ে আনা কাচের টুকরোগুলোও ভিজে চুপচুপে হয়ে রয়েছে।

এর থেকেই গবেষকরা এ বার নিশ্চিত হতে পেরেছেন, চাঁদের পিঠের জলের জন্য ওই কাচের টুকরোগুলি ভেজেনি। ওই টুকরোগুলো চাঁদের ম্যান্টল থেকে উঠে এসেছিল আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের সঙ্গে মিশে থাকা ম্যাগমার মধ্যে ও আর তাদের আশপাশে। ফলে, চাঁদের ম্যান্টলে যে জল রয়েছে তরল অবস্থায়, এ বার তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলেন বিজ্ঞানীরা। আর যেহেতু ওই কাচের টুকরোগুলো চাঁদের পিঠে প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে, তাই গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন, ম্যান্টলে তরল অবস্থায় থাকা জল রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। আর তা ম্যান্টলের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে।

গবেষকদের দাবি, পৃথিবীতে যত জল রয়েছে, চাঁদের ম্যান্টলে থাকা জলের পরিমাণ তার চেয়ে কোনও অংশে কম হবে না।

আরও পড়ুন- বিশ্বের অর্ধেক শিশুকে কাবু করা ভাইরাস ঠেকানোর রাস্তা খুলল

মূল গবেষকদের অন্যতম হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো শুয়াই লি ই-মেলে আনন্দবাজারকে লিখেছেন, ‘‘এত দিন আমাদের ধারণা ছিল, চাঁদের ম্যান্টলটা একেবারে শুকনো খটখটে। সেখানে জলের বিন্দুমাত্র নেই। এ বার নিশ্চিত হলাম, জল তো তরল অবস্থায় রয়েছেই চাঁদের ম্যান্টলে, তা রয়েছে প্রচুর পরিমাণেও। ফলে‌, অণুজীব হলেও, নিশ্চিত ভাবেই প্রাণ রয়েছে চাঁদের ম্যান্টলের কোনও না কোনও অংশে।’’

চাঁদের ম্যান্টলে সত্যি-সত্যিই জল রয়েছে কি না বা থাকলে তা কতটা রয়েছে, গবেষকরা এই প্রথম তা নিখুঁত ভাবে জানতে পেরেছেন মূলত দু’টি কারণে। এক, ‘চন্দ্রযান-১’-এ থাকা ‘মুন মিনারোলজি ম্যাপার’-এর অসম্ভব শক্তিশালী স্পেকট্রোমিটার। এখানেই ‘চন্দ্রযান-১’-এর অবদান, অভিনবত্ব। দুই, এই প্রথম গবেষণাগারে কম্পিউটার সিম্যুলেশন করে গবেষকরা দেখতে পেরেছেন, সত্যি-সত্যিই জল তরল অবস্থায় জমা রয়েছে কি না ম্যান্টলে আর থাকলে তা কতটা পরিমাণে।

চাঁদের ম্যান্টল ( ধূসর রং)। ছবি নাসা।

চাঁদের ম্যান্টলে জল তরল অবস্থায় আছে কি না, সেটা বুঝতে কেন অসুবিধা হচ্ছিল গবেষকদের?

চাঁদের পিঠের যেখান থেকে ওই ভিজে কাচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে এনেছিল, নাসার দু’টি মহাকাশযান, সেই জায়গাগুলিকে দিনভর সূর্যের প্রখর তাপ সহ্য করতে হয়। আলোর মতো সেই তাপও প্রতিফলিত হয় চাঁদের পিঠ থেকে। সেটাকেই বলি, তাপ বিকিরণ। স্পেকট্রোমিটার আলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য মেপে বলে দিতে পারে কোথায় জল রয়েছে, আর কোথায় তা নেই। কিন্তু যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে তা মাপা হয়, সেই একই তরঙ্গদৈর্ঘ্য চাঁদের পিঠ থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা তাপ বিকিরণেরও।

সহযোগী গবেষক, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বিষ্ণু রেড্ডির কথায়, ‘‘ফলে, জল নাকি তাপ বিকিরণ, ঠিক কার জন্য ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্য ধরা পড়ছিল স্পেকট্রোমিটারের ‘দর্শনে’, তা নিখুঁত ভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। এ বার গবেষণাগারে কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমে তাপ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকে জলের অস্তিত্ব বোঝার তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে আলাদা করে দেখা সম্ভব হয়েছে। তাই নিখুঁত ভাবে জানা গিয়েছে, চাঁদের ম্যান্টলে সত্যি-সত্যিই জল রয়েছে। আর তা রয়েছে প্রচুর পরিমাণে।’’

গবেষকরা জানিয়েছেন, এ বার তাঁরা আরও বেশি নিশ্চিত হয়েছেন মঙ্গলের চেহারার মতো কোনও ধূমকেতু বা গ্রহাণু বা অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তু সাড়ে ৪০০ কোটি বছর আগে এসে সজোরে ধাক্কা মেরেছিল পৃথিবীকে। সেখান থেকেই জন্ম হয়েছিল চাঁদের। আর সেই ধূমকেতু বা গ্রহাণু থেকেই জল ঝরে পড়েছিল চাঁদে। একই ভাবে পৃথিবীতেও জল এসেছিল বলে বিজ্ঞানীদের অনেকেরই ধারণা। এও নিশ্চিত হয়েছেন, ম্যান্টলে জল রয়েছে বলেই এক সময় চাঁদের চৌম্বক ক্ষেত্র অত জোরালো ছিল। তার বায়ুমণ্ডলকে সে ধরে রাখতে পেরেছিল বেশ কিছু দিন।

আরেক সহযোগী গবেষক, ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মহেশ আনন্দ অব্শ্য বলছেন, ‘‘জল তৈরি হতে গেলে হাইড্রোজেন লাগে। কিন্তু চাঁদে সেই হাইড্রোজেনের হদিশ এখনও পর্যন্ত মেলেনি। তাই অত জল কী ভাবে তৈরি হল চাঁদের ম্যান্টলে, তা এখনও জানতে, বুঝতে পারিনি আমরা।’’

চাঁদ তাই রহস্যের পর্দাটা এখনও পুরোপুরি সরিয়ে নিল না!

Moon Astronomy Scientist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy