Advertisement
E-Paper

বঙ্গোপসাগরে কেন এত ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হয়? ঢিলছোড়া দূরত্বে মলাক্কা প্রণালীর ঝড়কে কেন বিরল বলল মৌসম ভবন

সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর এবং সংলগ্ন অঞ্চলে পর পর দু’টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে। ঝড়গুলি বিস্তর বিপর্যয়ও ঘটিয়েছে। মলাক্কা প্রণালীর ঘূর্ণিঝড় সেনিয়ারকে তো সরাসরি ‘বিরল’ বলে উল্লেখ করেছে ভারতের মৌসম ভবন।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:০২
Why cyclones are more common in Bay of Bengal and rare in Strait of Malacca

বঙ্গোপসাগরের কাছে মলাক্কা প্রণালীতে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়কে বিরল বলা হয়েছে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

বঙ্গোপসাগর ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। গ্রীষ্মের শেষে মে-জুন মাস থেকে শুরু করে শীতের শুরুতে অক্টোবর-নভেম্বর মাস পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে অবস্থিত সমুদ্রটির উপর একের পর এক ছোটবড় ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। কোনওটি বিধ্বংসী হয়ে ওঠে, কোনওটি আবার স্থলভাগের কাছাকাছি আসার আগেই শক্তি হারায়। বঙ্গোপসাগরের ঠিক বিপরীতে ভারতের পশ্চিম উপকূলে রয়েছে আরব সাগর। সেখানে কিন্তু ছবিটা অন্য। আরব সাগরেও মাঝেমধ্যে ঘূর্ণিঝড় দানা বাঁধে। তবে তা সংখ্যায় এত বেশি নয়। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হওয়ার বিশেষ কারণ রয়েছে। আরব সাগরের ক্ষেত্রে তার অনুকূল পরিস্থিতি নেই।

সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর এবং সংলগ্ন অঞ্চলে পর পর দু’টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের উপকূল থেকে অনেক দূরে দক্ষিণ প্রান্তের এই ঝড়গুলি বিস্তর বিপর্যয় ঘটিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সেনিয়ারকে সরাসরি ‘বিরল’ বলে উল্লেখ করেছে ভারতের মৌসম ভবন। এই ঘূর্ণিঝড়টি ইন্দোনেশিয়া এবং তাইল্যান্ডে তাণ্ডব চালিয়েছে। দুই দেশে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে ৬৫০-এর গণ্ডি। সেনিয়ার শান্ত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে দানা বাঁধে ঘূর্ণিঝড় দিটওয়া। এর প্রভাবে শ্রীলঙ্কায় বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থলভাগে আছড়ে না পড়েই ভারতের দক্ষিণের দ্বীপরাষ্ট্রে ৩৫০-জনের বেশি মৃত্যু ঘটিয়েছে দিটওয়া। তার পর ভারতের উপকূলের সমান্তরালে ক্রমে উত্তরে এগিয়েছে এবং শক্তি হারিয়েছে।

বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ বলছে, বঙ্গোপসাগরে বেশি ঘূর্ণিঝ়ড় হওয়ার মোট পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।

ভৌগোলিক অবস্থান

বঙ্গোপসাগর তিন দিক দিয়ে ভূমি দ্বারা বেষ্টিত। তাই সমুদ্রে উৎপন্ন হওয়া জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু অন্য কোনও দিকে যেতে পারে না। সাগরে আটকে পড়ে। জলের উপর থাকতে থাকতে বায়ুর শক্তি বাড়ে এবং ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। ক্রমে তা স্থলভাগে আছড়ে পড়ে। আরব সাগরের উত্তর এবং পূর্ব দিকে স্থলভাগ থাকলেও বাকি দু’দিক খোলা। তাই এখানে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু আটকে পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম।

জলের উষ্ণতা

‌ঘূর্ণিঝড় তৈরির অন্যতম প্রধান কারণ সমুদ্রের জলের উষ্ণতা। আরব সাগরের চেয়ে বঙ্গোপসাগরের জল অনেক বেশি উষ্ণ। এখানে জলের তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। এর ফলেও ঘূর্ণিঝড় তৈরির সম্ভাবনা বঙ্গোপসাগরে বেশি হয়।

আর্দ্র বায়ু

ঘূর্ণিঝড় তৈরির জন্য জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্দ্র বায়ু বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। আরব সাগরের ক্ষেত্রে তা হয় না। কারণ, তার চারপাশে পশ্চিম এশিয়ার মতো শুষ্ক স্থলভাগ রয়েছে। সেখান থেকে শুষ্ক বায়ু আরব সাগরের উপর আসে। তাতে আর্দ্রতা বেশি থাকে না।

খামখেয়ালি মৌসুমি বায়ু

দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু দ্বারা তুলনামূলক বেশি প্রভাবিত হয় বঙ্গোপসাগর। এই বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প বয়ে আনে। মৌসুমি বায়ুর খামখেয়ালি স্বভাবের কারণে গোটা অঞ্চলে আবহাওয়ার পরিস্থিতি অস্থির, অস্থিতিশীল হয়ে থাকে। এর ফলে বাতাসের গতিবিধি বেশি হয়, যা ঘূর্ণিঝড় তৈরির অনুকূল।

রক্ষক পশ্চিমঘাট

আরব সাগরের দিকে ভারতের পশ্চিম উপকূল জুড়ে রয়েছে বিশাল পশ্চিমঘাট পর্বত। পশ্চিম দিকে ঘূর্ণিঝড়ের অন্যতম প্রতিবন্ধক এই পর্বতমালা। বলা যায়, পশ্চিম উপকূলের রক্ষাকর্তা পশ্চিমঘাট। তার ফলে আর্দ্র বাতাস বাধা পায় এবং ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে পারে না। যদিও বর্তমানে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বিজ্ঞানীদের হিসাব গুলিয়ে যাচ্ছে। আরব সাগরেও আগের চেয়ে অনেক বেশি এবং অনেক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে। তবে বঙ্গোপসাগরের পরিস্থিতি বদলায়নি।

মলাক্কা প্রণালীর ঘূর্ণিঝড়

বঙ্গোপসাগরের একেবারে পূর্ব প্রান্তে রয়েছে মলাক্কা প্রণালী। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের ভূখণ্ডকে বিচ্ছিন্ন করে ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলপ্রণালী। এর ঠিক পশ্চিমে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের পূর্বাংশ যা আন্দামান সাগর নামেও পরিচিত। কিছু দিন আগে এখানে তৈরি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় সেনিয়ার। বঙ্গোপসাগর ঘূর্ণিঝড়প্রবণ হলেও মলাক্কা প্রণালীতে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়া অত্যন্ত বিরল। বিজ্ঞানীরা তাই বিস্মিত হয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড় সেনিয়ার ইন্দোনেশিয়ার দিকে এগিয়ে সেখানে তাণ্ডব চালিয়েছে। তাইল্যান্ডেও ১৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এই বিরল ঘূর্ণিঝড়ের কারণে।

কেন বিরল

বস্তুত, ইন্দোনেশিয়ার কাছে এই অংশ দিয়ে নিরক্ষরেখা বিস্তৃত। ব্লুমবার্গের রিপোর্ট বলছে, নিরক্ষরেখার কাছাকাছি অঞ্চলে পৃথিবীর ঘূর্ণনগতি অত্যন্ত কম। সেই কারণেই এখানে ঘূর্ণিঝড় তৈরির অনুকূল পরিস্থিতি নেই বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। হংকং পর্যবেক্ষণাগার জানিয়েছে, মলাক্কা প্রণালীতে শেষ বার ঝড় হয়েছিল ২০০১ সালে, যার নাম ছিল টাইফুন ভামেই। তার পর এই প্রথম সেখানে আবার কোনও ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় তৈরি হল। এর নেপথ্যে মলাক্কা প্রণালীর জলের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছে হংকং পর্যবেক্ষণাগার।

ঘূর্ণিঝড় দিটওয়া

মলাক্কা প্রণালী থেকে দূরে শ্রীলঙ্কার উপকূলের কাছে তৈরি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় দিটওয়া। এর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। বন্যার জলে ভেসে গিয়েছে গ্রাম এবং শহর। দেশের মধ্যবর্তী অংশের সঙ্গে রাজধানী কলম্বোর যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনাও। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ দিকে ঘূর্ণিঝ়ড় একেবারে বিরল না হলেও শ্রীলঙ্কার উপকূলের কাছাকাছি এই অংশে এত প্রবল ঘূর্ণিঝড় সাধারণত দেখা যায় না। সেই কারণে পূর্বাভাস থাকলেও সে ভাবে প্রস্তুতির সময় মেলেনি বলে মনে করছেন অনেকে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারতের তামিলনাড়ু, পুদুচেরী এবং দক্ষিণ অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে বৃষ্টি চলছে।

Bay Of Bengal Strait of Malacca Cyclone
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy