Advertisement
E-Paper

সঙ্গী অর্থাভাব, তবু অসুস্থ পশুদের দেখভালে জীর্ণ চিড়িয়াখানা বাড়িতে

শহরের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে ভাঙাচোরা এক চিলতে বাড়িতে সে এক আজব চিড়িয়াখানা। আসবাব-হীন ঘরে থরে থরে সাজানো ছোট-বড় খাঁচা। তাতে দিন কাটাচ্ছে ট্রেনে পা-কাটা নেড়ি কুকুর, রাস্তায় ফেলে দেওয়া বাচ্চা বেড়াল, ঘুড়ির সুতোয় ডানা-কাটা পায়রা!

চিরন্তন রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০২:২৯
নিজের বাড়িতে এক অসুস্থ কুকুরের পরিচর্যায় কাকলিদেবী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

নিজের বাড়িতে এক অসুস্থ কুকুরের পরিচর্যায় কাকলিদেবী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

শহরের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে ভাঙাচোরা এক চিলতে বাড়িতে সে এক আজব চিড়িয়াখানা।

আসবাব-হীন ঘরে থরে থরে সাজানো ছোট-বড় খাঁচা। তাতে দিন কাটাচ্ছে ট্রেনে পা-কাটা নেড়ি কুকুর, রাস্তায় ফেলে দেওয়া বাচ্চা বেড়াল, ঘুড়ির সুতোয় ডানা-কাটা পায়রা!

দুর্গন্ধে ভরে থাকা ওই বাড়িতে অসহায় সারমেয়দের নিয়ে সংসার গড়েছেন কাকলি গুপ্ত। অনেকটা অসহায় অবশ্য তিনি নিজেও। দুর্ঘটনায় জখম, বয়স্ক, অবহেলিত প্রাণীদের মুখে টাকার অভাবে দু’বেলা খাবারও তুলে দিতে পারছেন না এক সময়ের সাউথ সিটির হিসাবশাস্ত্র বিভাগের ছাত্রী।

জীবনের হিসেব ওলট-পালট হয়ে গেলেও, পোষ্যদের জন্য লড়াই সহজে ছাড়তে নারাজ তিনি। রাস্তার কুকুরদের নির্বীজকরণের কাজ করতেন কাকলিদেবীর মা কায়া গুপ্ত। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়েছিলেন তিনি। কাজের জন্য মিলেছিল রাষ্ট্রপতি ভবনের স্বীকৃতিও। বাড়িতে সারমেয়দের ভিড় দিন দিন বাড়ছিল। কলেজের পড়াশোনার পরে বাড়তি সময়ে মায়ের কাজে সাহায্য করতেন কাকলিদেবী।

শুরুটা তখনই। অসুস্থ বাবার মৃত্যু হয়েছিল আগেই। মায়ের মৃত্যুর পরে বাড়িতে থাকা প্রাণীদের দায়িত্ব যায় মেয়ের কাঁধেই। ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের পাশের গলি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে বাজার, রেললাইন টপকে ঘিঞ্জি বসতির মধ্যে কাকলিদেবীর বাড়ি। মেরামতির অভাবে জীর্ণ। গেটের সামনে পৌঁছতেই চিড়িয়াখানার হায়না, শজারুর খাঁচার কটূ গন্ধের ‘প্রতিফলন’। ভিতরে ঢুকতেই সেই দুর্গন্ধ নিমেষে বাড়ল কয়েক গুণ।

জং ধরে যাওয়া গেটের ও-পার থেকে রাতবিরেতে ব্যাগে ভরে কুকুর, বিড়ালের বাচ্চা ফেলে দিয়ে যায় অজানা, অচেনা লোকজন। খবর পেলে রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ, দুর্ঘটনায় জখম প্রাণীদের নিজেই নিয়ে আসেন কাকলিদেবী। এ ভাবে তাঁর ‘আশ্রয়ে’ এখন ৬৫-৭০টি কুকুর, বেড়াল। সংবাদ সংগ্রহে অচেনা লোকের অনুপ্রবেশে এক সুরে চিত্‌কার জুড়ে দিল সেখানকার হরেক কিসিমের সারমেয়।

বয়স এখন বছর পঁয়তাল্লিশ, শীর্ণ চেহারার অবিবাহিত কাকলিদেবী বলেন, “একটি সংস্থার কয়েক জন সদস্য প্রথম দিকে কিছুটা সাহায্য করতেন। সে টাকা শেষ হওয়ার পরে মা, আমার গয়না বিক্রি করে দিই। বাবার কেনা একটা ছোট জমিও বিক্রি করে দিতে হয়।” এখন শহরের কয়েক জন পশুপ্রেমীর কাছ থেকে সামান্য অর্থসাহায্য পান কাকলিদেবী। কেউ দেন ২ হাজার, কেউ ৫-৭ হাজার। ওইটুকু সাহায্যই তাঁর বড় ভরসা। কিন্তু তাতে খরচ কুলোয় না।

মাসকাবারির তালিকা যে অনেকটাই বড়।

চোখ না-ফোটা ‘বাচ্চা’দের জন্য বরাদ্দ দুধ। বেড়ালরা খায় ভাত, সিলভার কার্পের মণ্ড। কুকুরদের জন্য তৈরি হয় মুরগির মেটে, টেংরি মেশানো সেদ্ধ ভাত। সেই হাঁড়ি থেকে নিজের জন্যও এক মুঠো তুলে নেন চিড়িয়াখানার ‘মালকিন’।

এক বেলার ওই খাবার জোগাতেই মাসে খরচ হয়ে যায় ১২-১৫ হাজার টাকা। দু’বেলা পোষ্যদের ভরপেট খাবার দিতে হলে টাকা যে লাগবে দ্বিগুণ। তার উপরে রয়েছে ঠিকা কাজের লোকের খরচ। খাঁচা পরিষ্কার, সারমেয়দের খাবার রান্না মিলিয়ে দিনে তাঁদের পারিশ্রমিক ৩০০ টাকা। কাকলিদেবী বলেন, “ওদের কারও শরীর খুব খারাপ হলে, চিকিত্‌সায় এক দিনে ১০ হাজার টাকাও বেরিয়ে যায়।” কত দিন এ ভাবে এগোতে পারবেন, তা নিয়ে আশঙ্কায় কাকলিদেবী।

এ রকম জীবন বেছে নিলেন কেন? তাঁর জবাব, “নিজের জন্য ভেবে দেখার সময় পাইনি। চাকরি খোঁজার সময়ও মেলেনি। আমি পাশে না-থাকলে, অসহায় প্রাণীগুলো হয়তো বাঁচতেই পারত না।”

helpless animals and birds chirantan roy choudhury kolkata mini zoo
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy