ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়ে ধোঁকা খেয়ে গিয়েছিলেন আকাশদীপ। বাংলার পেসার ভেবেছিলেন, ইংল্যান্ডের মাঠে সবুজ উইকেট দেখতে পাবেন তিনি। তার বদলে তিনি পেয়েছেন পাটা, নিষ্প্রাণ উইকেট। কিন্তু সেই উইকেটেই ইংরেজ ব্যাটারদের ধোঁকা খাইয়ে দিয়েছেন বাংলার পেসার। হেডিংলেতে বসে বসে দলের হার দেখতে হয়েছিল। এজবাস্টনে সুযোগ পেয়ে দুই ইনিংসে মোট ১০ উইকেট নিয়েছেন আকাশ। তিনি নতুন বলে উইকেট নিয়েছেন। আবার পুরনো বলেও ব্যাটারদের সমস্যায় ফেলেছেন। এজবাস্টনে জয়ের কৃতিত্ব যতটা না শুভমন গিলের, ততটাই আকাশের। তিনি না থাকলে ভারত এই উইকেটে ২০ উইকেট নিতে পারত কি না সন্দেহ। আকাশ বুঝিয়ে দিয়েছেন, লাল বলের ক্রিকেটে লম্বা রেসের ঘোড়া তিনি।
ইংল্যান্ডের মাটিতে এক টেস্টের দুই ইনিংসেই ৪ বা তার বেশি উইকেট নেওয়ার নজির রয়েছে ভারতের পাঁচ বোলারের। চেতন শর্মা, জাহির খান, জসপ্রীত বুমরাহ, মহম্মদ সিরাজের দলে জায়গা করে নিয়েছেন আকাশ। এই পাঁচ জনের মধ্যে সিরাজ বাদি বাকি চার জনই এই কীর্তি করেছেন এজবাস্টনে। আকাশ বাদে বাকি চার জন তাঁদের টেস্ট কেরিয়ারে বেশ কিছু ম্যাচ খেলার পর ইংল্যান্ডে এই কীর্তি করেছিলেন। সেখানে আকাশ ইংল্যান্ডে নিজের প্রথম টেস্টেই তা করে দেখিয়েছেন। কেরিয়ারে এই প্রথম এক ইনিংসে ৫ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন তিনি।
এজবাস্টনে পঞ্চম দিনের শুরুতে যখন মহম্মদ সিরাজের বদলে আকাশদীপের হাতে বল তুলে দেন শুভমন, তখন প্রশ্ন তোলেন রবি শাস্ত্রী। ধারাভাষ্যকার শাস্ত্রী বলেন, “ভারতের এই পরিকল্পনা আমি বুঝতে পারছি না। এই টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছে সিরাজ। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ বোলার ও। সেখানে ওকে বসিয়ে রেখে নতুনদের দিয়ে বল করানো হচ্ছে।” স্পেলের দ্বিতীয় ওভারেই শাস্ত্রীকে জবাব দিয়ে দেন আকাশ। ওলি পোপকে বোল্ড করে। কয়েক ওভার পর তাঁর যে বলে হ্যারি ব্রুক আউট হন তাকে চোখ বন্ধ করে এই সিরিজ়ের সেরা বল বলা যেতে পারে। গুড লেংথে বল পরে যে ভাবে ভিতরের দিকে ঢুকে এসেছে, তাতে হতবাক হয়ে গিয়েছেন আগের ইনিংসে ১৫৮ রান করা ব্রুক। তিনি ভাবতেই পারেননি বল এতটা ভিতরে ঢুকতে পারে। শুধু তাই নয়, তার পরে যে ভাবে আগের ইনিংসে ১৮৪ রান করা জেমি স্মিথকে দু’বার তিনি বোকা বানিয়েছেন তা আকাশের কলার আরও তুলে দিয়েছে। বল কোথায় যাচ্ছে, তার কোনও ধারণাই ছিল না স্মিথের। ভাগ্য ভাল বলের বাউন্স তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
আকাশদীপের বল দেখে অবাক হয়েছেন ইংল্যান্ডের দুই প্রাক্তন ক্রিকেটার নাসের হুসেন ও মাইকেল আথারটন। ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে হুসেন বলেছেন, “আকাশদীপ এই টেস্টের সেরা বোলার। ওর ধারেকাছে কেউ নেই।” আথারটন বলেন, “দেখে মনে হচ্ছে আকাশদীপ অন্য পিচে বল করছে। ও পিচ থেকে এত সুবিধা পাচ্ছে। বাকিরা সেখানে কিছুই পাচ্ছে না।” সত্যিই আকাশদীপ যে ছন্দে প্রথম স্পেল করেছেন, তা অনেক দিন মনে থাকবে। পিচের একই জায়গা থেকে ইনসুইং ও আউটসুইং দুটোই করিয়েছেন। তাঁর সামনে ব্যাটারেরা বুঝতে পারছিলেন না, কী ভাবে খেলবেন।
ভারতীয় জার্সিতে আকাশদীপের কেরিয়ার এক বছর পাঁচ মাসের। প্রথম পাঁচটা টেস্ট তিনি খেলেছিলেন দেশের মাটিতে। নিয়েছিলেন মোট ১০ উইকেট। একমাত্র পুণেতে নিউ জ়িল্যান্ড টেস্ট ছাড়া বাকি সবগুলোতে উইকেট পেয়েছিলেন। তাঁর প্রথম বিদেশ সফর গত বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে দুটো টেস্টে খেলেন। পাঁচ উইকেট নিলেও প্রচুর রান দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে নতুন জীবন পেলেন আকাশ। প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই নিলেন ১০ উইকেট। শেষ বার ১৯৮৬ সালে এই মাঠে চেতন শর্মা ১০ উইকেট নিয়েছিলেন। ৩৯ বছর পর সেই কীর্তি করলেন বাংলার আকাশ।
অস্ট্রেলিয়ায় নজর কাড়তে না পারলেও কেন ইংল্যান্ডে সফল হলেন আকাশ? তার প্রধান কারণ তাঁর লাইন ও লেংথ। অস্ট্রেলিয়ার পিচে তিনি অনেক বেশি বাউন্সের উপর ভরসা করছিলেন। পিচে জোরে বল ফেলছিলেন। লেংথে বল করছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে লেংথ বদলেছেন আকাশ। অনেক বেশি গুড ও ফুল লেংথে বল করছেন। স্টাম্প আক্রমণ করে বল করছেন। ব্যাটারকে খেলানোর চেষ্টা করছেন। সেই কারণেই তাঁর বেশির ভাগ উইকেট ব্যাটারকে বোল্ড করে। নিষ্প্রাণ উইকেটেও প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন আকাশ। তাঁর একটা বড় গুণ টানা বল করার ক্ষমতা। প্রতিটা স্পেলে অন্তত সাত ওভার করে বল করেছেন আকাশ। এক বারও বলের গতি কমতে দেননি। পাশাপাশি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে বল করেছেন। সেই পরিকল্পনা কাজে লেগেছে। এই ধরনের বোলার কোনও অধিনায়কের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট।
আরও পড়ুন:
এজবাস্টনে পাটা পিচে যখনই উইকেটের প্রয়োজন হয়েছে, আকাশের হাতে বল তুলে দিয়েছেন শুভমন। অধিনায়ককে নিরাশ করেননি তিনি। পুরনো বলেও সুইং করিয়েছেন। সুযোগ তৈরি করেছেন। এক, দু’বার ফিল্ডারের পাশ দিয়ে বল বেরিয়েছে। তাঁর কত বল যে ব্যাট ঘেঁষে বেরিয়েছে তার হিসাব নেই। আকাশদীপকে দেখে নিজের কথা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন শাস্ত্রী। বলেছেন, “আকাশদীপ যে এনার্জি নিয়ে বল করছে তা বাকিদের শেখা উচিত। এই উইকেটেও ও সুযোগ তৈরি করছে।” পাশে বসে থাকা মাইকেল ভন বলেছেন, “একটা কথা বলতে পারি। পরের টেস্টগুলোতে আকাশদীপ নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছে। এর পরেও ওকে বাইরে বসতে দেখলে অবাক হব।”
দু’বছর আগেও ভারতের ক্রিকেট মানচিত্রে আকাশদীপ ছিলেন বাংলার এক পেসার। জন্মসূত্রে বিহারের হলেও ঘরোয়া ক্রিকেট তিনি খেলেছেন পড়শি রাজ্যে। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে ভাল খেলেছেন। ২০২০ ও ২০২২ মরসুমে বাংলা রঞ্জির ফাইনালে উঠেছিল। তাতে বড় ভূমিকা ছিল আকাশের। কিন্তু তার পরেও জাতীয় দলের দরজা খোলেনি। জসপ্রীত বুমরাহের চোট, ইশান্ত শর্মা, উমেশ যাদবেরা বয়সের ভারে পিছিয়ে পড়ায় ভারতীয় দলে সুযোগ পান আকাশ। তাঁর আগে অবশ্য বাংলার আরও এক পেসার মুকেশ কুমার ভারতের টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু আকাশ তাঁকে টপকে গিয়েছেন। ভারতের গত চারটে টেস্ট সিরিজ়ে দলে জায়গা পেয়েছেন। এটা তাঁর পঞ্চম সিরিজ়। এ বার হয়তো ভারতের টেস্ট দলে পাকাপাকি জায়গা পাবেন তিনি। মহম্মদ শামি কবে লাল বলের ক্রিকেটে ফিরবেন জানা নেই। সে ক্ষেত্রে বুমরাহ ও সিরাজের পর তৃতীয় পেসারের দৌড়ে এগিয়ে আকাশ।
এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন জো রুট। টেস্টে ১৩,০৮৭ রান ও ৩৬ শতরানের মালিককে বোকা বানিয়ে বোল্ড করেছেন আকাশদীপ। তার পর ঘুরে সাজঘরের দিকে তাকিয়ে বুকে ঘুষি মেরেছেন। হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন এখানে থাকতে এসেছেন। সেই জায়গাটা হয়তো পাকা করে নিয়েছেন আকাশ। তাঁর উপর অধিনায়ক শুভমনের ভরসা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।