Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Sachin Tendulkar

Sachin Tendulkar: যোগ্য প্রতিভা দেখলেই লড়ে যেত অধিনায়ক

এ নিয়ে কোনও সন্দেহই ছিল না আমার মনে। আমি জানতাম, সৌরভ-রাহুল দু’জনেই অসামান্য প্রতিভাবান।

যুগলবন্দি: সৌরভ এবং সচিন। ক্রিকেটবিশ্ব শাসন করত েয জুটি। এখনও ভক্তদের হৃদয় জুড়ে। ফাইল চিত্র

যুগলবন্দি: সৌরভ এবং সচিন। ক্রিকেটবিশ্ব শাসন করত েয জুটি। এখনও ভক্তদের হৃদয় জুড়ে। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২২ ০৭:১৬
Share: Save:

তেরো বছর বয়স থেকে তাঁদের পরিচয়। কিটব্যাগ কাঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পরবর্তীকালে ক্রিকেটবিশ্ব যাঁদের চিনবে রূপকথার জুটি হিসেবে। দাদার পঞ্চাশতম জন্মদিন পালনে লন্ডনে দেখা গিয়েছে তাঁর প্রিয় পার্টনারকে। ইনদওরের ক্যাম্পে গিয়ে দুষ্টুমি থেকে ডেনিস লিলির অধীনে চেন্নাইয়ে পেস বোলার হতে যাওয়া। প্রিয় অধিনায়ককে নিয়ে নানা মজার কাহিনির সম্ভার-সহ লন্ডন থেকে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সচিন তেন্ডুলকর। আজ প্রথম পর্ব।

প্রশ্ন: দাদার পঞ্চাশতম জন্মদিনে সব চেয়ে সুপারহিট তো কিশোর সচিনের দুষ্টুমি। বালতি ভর্তি জল ঢেলে সৌরভের ঘর ভাসিয়ে দিয়েছিলেন ইনদওরে।

সচিন তেন্ডুলকর (হাসি): হ্যাঁ, ইনদওরের ঘটনা। আমি, যতীন পরাঞ্জপে আর কেদার গোডবোলে মিলে প্ল্যান করেছিলাম। তখন কোনও না কোনও দুষ্টুবুদ্ধি আমাদের মাথায় চলেই আসত। মে মাসে ইনদওরে ক্যাম্প হচ্ছিল। অসহ্য গরমের মধ্যে। তার মধ্যে দু’বেলা প্র্যাক্টিস ছিল। সকালে প্র্যাক্টিস করে ফিরেছি। দাদাকে দেখলাম দুপুরের ঘুমটা সেরে নিচ্ছে। দেখেই আমরা ঠিক করি, কিছু একটা করতে হবে। কী করা যায়? ঠিক হল, ওর রুমটা জলে ভাসিয়ে দাও। আমরা প্রায় পাঁচ-ছয় বালতি জল ঢেলে দিয়েছিলাম। দাদা ঘুম থেকে উঠে এমন ঘাবড়ে গিয়েছিল, কী বলব!

প্র: দুপুরে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। রাতে ভয় দেখাননি কখনও? শোনা যেত, দাদার ভূতের ভয় আছে নাকি?

সচিন: (হাসি) হ্যাঁ, ওটাও প্ল্যান করেছিলাম। সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

প্র: শুনেছি, দাদা একা শুতেই চাইতেন না রাতে?

সচিন: হ্যাঁ, দাদা একা শুতে চাইত না একদম ঠিক কথা। আমরা কৈলাস ঘাটানির দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড গিয়েছিলাম। তখন টিনএজারই ছিলাম। দাদার সঙ্গে কলকাতা থেকে আসা অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় থাকত, সঞ্জয় দাস থাকত।

প্র: দাদা আর আপনি বেশির ভাগ ট্যুরেই রুম পার্টনার থেকেছেন। সেই অভিজ্ঞতা যদি বলেন...

সচিন: সব চেয়ে বেশি করে মনে আছে ১৯৯২-এর অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা। দাদার সেটা প্রথম ট্যুর ছিল ভারতীয় দলের হয়ে। সিডনিতে অনেক রাত পর্যন্ত আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাট নিয়ে শ্যাডো প্র্যাক্টিস করছিলাম। বুঝতে পারিনি, চুপটি করে শুয়ে দাদা আমাকে দেখে যাচ্ছে। আমিও শুয়ে পড়েছিলাম কিন্তু ঘুমোতে পারছিলাম না। ব্যাটিং নিয়ে চিন্তা ভিড় করে আসছিল মাথায়। তাই উঠে গিয়ে আয়নার সামনে শ্যাডো করছিলাম। ভেবেছিলাম, দাদা ঘুমিয়ে পড়েছে। পরে বুঝলাম, দাদা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে আমায় দেখছিল।

প্র: অত রাত পর্যন্ত জেগে সকালে মাঠে গিয়ে ঘুম পেয়ে যায়নি?

সচিন: পেয়েছিল তো। সকালে ড্রেসিংরুমে গিয়ে আমার রীতিমতো ঘুম পাচ্ছিল। আবার দাদার শরণাপন্ন হলাম। এখনও মনে আছে, প্যাড-ট্যাড পরে ড্রেসিংরুমের টেবলটার উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর দাদাকে বলেছিলাম, উইকেট পড়লেই আমাকে ডেকে দিয়ো।

প্র: সচিন-সৌরভ নামের দুই কিশোর ডেনিস লিলির এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে গিয়েছিল পেসার হবে বলে!

সচিন (হাসি): আমি কিন্তু কখনও বোলার হওয়ার জন্য ছুটিনি। আমি ছিলাম ব্যাটসম্যান যে বোলিংটাও শিখতে চেয়েছিল। চেন্নাইয়ে আমাদের দু’জনের দেখা হয়ে গেল। আমার মনে আছে, বাসু পরাঞ্জপে স্যর তখন ওখানে ছিলেন। উনি আমাকে বোলিং করিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু মুম্বই থেকে চেন্নাইয়ে যাওয়ার আগে আমার দাদা অজিত বলেছিল, ‘‘ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে যাচ্ছ ঠিক আছে কিন্তু ব্যাটগুলোও নিয়ে যাও। অন্যরা যখন বল করবে, তখন ব্যাট করতে পারবে। সময় নষ্ট করে লাভ কী?’’ দেখা গেল, আমি লিলির ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে গিয়ে যা বোলিং করলাম, তার চেয়ে বেশি ব্যাটিং করেছিলাম। তবে একটা যে ধারণা আছে আমি প্রথমে বোলার ছিলাম, তার পরে ব্যাটসম্যান হয়েছি, সেটা ঠিক নয়। আমি সব সময়ই আগে ব্যাটসম্যান ছিলাম যে কি না বোলিংটাও করতে চেয়েছিল।

প্র: ১৯৯৬-এর লর্ডসে আপনাকে নিয়ে যাওয়া যাক। সৌরভের সেই অভিষেক সেঞ্চুরি। চা-পানের বিরতিতে ড্রেসিংরুমে আসা নট আউট দাদাকে চা বানিয়ে দিলেন সচিন তেন্ডুলকর, তাই তো?

সচিন: একদম ঠিক। আমি সব সময় দল হিসেবে, একসঙ্গে কাজ করায় বিশ্বাস করে এসেছি। কারও সাহায্যে আসতে পারলে আমার ভাল লাগত। মনে আছে, দাদার তখন ব্যাট নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী সমস্যা হচ্ছে? বলল, তেমন কিছু নয়, ব্যাট নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। আমি বললাম, কী করতে হবে বলো, আমি করে দিচ্ছি। ওকে বলি, এখন তোমার ব্যাটিংয়ের উপর ফোকাস করা উচিত। অন্য কিছু নিয়ে ভেবোই না। কোনও সমস্যা হলে আমি ঠিক করে দিচ্ছি। ব্যাটের হ্যান্ডলে টেপ লাগানোর দরকার ছিল, সেটা করে দিয়েছিলাম আর চা বানিয়েও নিয়ে আসি। একই পরিবারের সদস্য হয়ে এটুকু তো করতেই পারি সতীর্থের জন্য।

প্র: লর্ডসের সেই টেস্টে দাদা আর রাহুল দ্রাবিড়ের আবির্ভাব কতটা উত্তেজিত করেছিল আপনাকে? ভাবতে পেরেছিলেন কি বারো-তেরো বছরের উপরে এই দু’জনের সঙ্গে ব্যাট করে যাবেন?

সচিন: এ নিয়ে কোনও সন্দেহই ছিল না আমার মনে। আমি জানতাম, সৌরভ-রাহুল দু’জনেই অসামান্য প্রতিভাবান। জানতাম, ভারতীয় ক্রিকেটকে ওরা অনেক, অনেক দিন ধরে সেবা করার জন্যই এসে গিয়েছে। ওদের সঙ্গে ব্যাট করার আনন্দটাই ছিল আলাদা। যত সময় গিয়েছে, আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া ভাল হয়েছে। ভাল জুটি তখনই তৈরি হয়, যদি আমার পার্টনার কখন কী চাইছে, সেটা আমি বঝতে পারি। সৌরভ বা রাহুলের সঙ্গে ব্যাট করার সময় ওরা যেমন বুঝত আমার মনের মধ্যে কী চলছে, তেমনই আমি ধরতে পারতাম ওরা কী করতে চাইছে। আমি জানতাম, সৌরভ কী ভাবে ব্যাট করার কথা ভাবছে, কোন কোন বোলারকে টার্গেট করবে বলে ভাবছে, কখন আক্রমণ করবে বা কখন রক্ষণাত্মক খেলবে। এই বোঝাপড়াটা থাকলে পার্টনারশিপ গড়া সহজ হয়ে যায়। কেউ দৌড়ে রান নিয়ে ইনিংস এগোতে ভালবাসে, কেউ বাউন্ডারিতে খেলতে পছন্দ করে। এগুলো পার্টনারকে বুঝতে হবে। জুটির সাফল্যে এই বোঝাপড়াটাই আসল। যেটা আমার ছিল সৌরভ বা রাহুলের সঙ্গে।

প্র: টিম ইন্ডিয়া ড্রেসিংরুমে একটা পাল্টে যাওয়া সংস্কৃতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, তাই না?

সচিন: আমার মনে হয় ২০০০ সাল থেকে পরিবর্তনটা ভাল ভাবে শুরু হয়। দলের মধ্যে একটা স্থায়িত্ব আসতে শুরু করে। তত দিনে সৌরভ, রাহুল খুব ভাল করছে। ভিভিএস লক্ষ্মণ নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেছে। সহবাগ এসে গিয়েছে। যুবরাজ এসে গিয়েছে। মহম্মদ কাইফ ছিল। বোলিংয়ে জাহির খান, আশিস নেহরা, অজিত আগরকর। সঙ্গে হরভজন সিংহের আবির্ভাব। অনিল কুম্বলের মতো অসাধারণ পারফর্মার ছিল, কিন্তু এত জন তরুণ প্রতিভার আগমন দলটাকে অনেক টগবগে করে দিয়েছিল। আর হ্যাঁ, অধ্যায়টা শুরু হয়েছিল ছিয়ানব্বইয়ে লর্ডসে সৌরভ আর রাহুলের আবির্ভাব থেকে। ২০০১ নাগাদ দলটা অনেক গুছিয়ে ওঠে।

প্র: আর এই দলটাকে গোছাতে অধিনায়ক সৌরভের অবদান, ভূমিকা কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?

সচিন: অধিনায়ক হিসেবে সবার আগে যেটা করা দরকার, তা হচ্ছে, যোগ্য প্রতিভা খোঁজা। আর যখন তুমি বুঝে গেলে এই প্রতিভা দেশের হয়ে বহু বছর ধরে ছুটতে পারে, তার পাশে দাঁড়ানো। তাদের সাহস দিতে হবে, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আনতে হবে যে, তারা পারবে। এবং, সব চেয়ে জরুরি তাদের বোঝাতে হবে এই টিমের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ তারা। সৌরভ অধিনায়ক হিসেবে এই উপলব্ধিগুলো দিতে পেরেছিল সতীর্থদের। এক বার প্রতিভার স্ফুলিঙ্গটা দেখতে পারলেই সৌরভ তাদের জন্য লড়ে যেত, ভীষণ ভাবে পাশে থাকত। তাদের স্বাধীনতা দিত, প্রতিভাকে বিকশিত হতে দিত। খেলায় উত্থান-পতন তো থাকবেই। সব সময় তো একটা খেলোয়াড় ভাল করতে পারবে না। কিন্তু নেতার দায়িত্ব হচ্ছে, কঠিন সময়েও যোগ্য প্রতিভাকে সাহসটা দিয়ে যাওয়া, সমর্থন করে যাওয়া। আমাদের টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক হিসেবে সৌরভ সেটা করেছিল। ও যেমন হার মানতে চাইত না, তেমনই সতীর্থদের পাশে দাঁড়াত, তাদের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে যেত।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sachin Tendulkar Sourav Ganguly Interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE