Advertisement
E-Paper

ফুটবলে দর্শক টানতে হবে! হাতের কাছেই উপায়, ক্রিকেটে ভারত-পাক ম্যাচের ছকেই বার বার মুখোমুখি ইস্ট-মোহন

ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান বা ভারতীয় ফুটবলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ আয়োজক, কর্তাদের কাছে সোনার ডিম দেওয়া হাঁস। প্রচার, রোজগারের প্রায় সবটাই এই দুই ম্যাচ ঘিরেই।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:২৫
sports

(উপরে বাঁ দিক থেকে) সূর্যকুমার যাদব, সলমন আঘা, (নীচে বাঁ দিক থেকে) হামিদ আহদাদ, জেসন কামিংস। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

গত জুলাইয়ের কথা। ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালের সূচি ঘোষিত হবে পরের দিন রাত সাড়ে ৯টায়। সকালবেলা কলকাতা ফুটবলের এক বড় ক্লাবের কর্তা বললেন, মিলিয়ে নেবেন কোয়ার্টার ফাইনালে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল হচ্ছেই।

মিলে গিয়েছিল। ফাইনালে শেষ পর্যন্ত কোন দুটো দল ওঠে, ডুরান্ড কর্তৃপক্ষ সেই অনিশ্চয়তার ঝুঁকি নিতে চাননি। কোয়ার্টার ফাইনালেই লড়িয়ে দিয়েছিলেন কলকাতার দুই প্রধানকে। এ বারের সুপার কাপেও সেই একই ছবি। একই গ্রুপে রাখা হয়েছে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলকে। আগামী ৩১ অক্টোবর মুখোমুখি হবে কলকাতার দুই প্রধান।

ক্রিকেটের ছবিই এখন ভারতীয় ফুটবলে। ক্রিকেটে যেমন ভারত বনাম পাকিস্তান সোনার ডিম পাড়া হাঁস, ফুটবলও নিজেকে বিকোতে চাইছে কলকাতা ডার্বির হাত ধরে। রাজনৈতিক কারণে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় বন্ধ। তাই বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, এশিয়া কাপের মতো বহুদলীয় প্রতিযোগিতাগুলিতে যত বেশি সম্ভব ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ রাখা হয়। এ বারের এশিয়া কাপে পর পর তিন রবিবার ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। একই গ্রুপে দু’টি দলকে রাখা হয়েছিল। গ্রুর পর্বে খেলার পর সুপার ফোরেও মুখোমুখি হয়েছে দু’দল। আবার ২৮ সেপ্টেম্বর, রবিবার ফাইনালে লড়াই হবে ভারত-পাকিস্তানের। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও একই গ্রুপে ছিল ভারত এবং পাকিস্তান। বাবর আজ়মের দল গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ায় একটির বেশি ম্যাচ হয়নি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) লক্ষ্যই থাকে যত বেশি সম্ভব ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ আয়োজন করা। কারণ এই ম্যাচ থেকেই আয় হয় সবচেয়ে বেশি। ক্রিকেট অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উপর। আইসিসির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বকাপ বা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির একটি ম্যাচ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ যে আয় হয়, তার থেকে অন্তত ১০ গুণ বেশি আয় হয় ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ থেকে। বিজ্ঞাপনদাতারাও এই ম্যাচের জন্য খরচ করেন হাত খুলে। তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতাগুলির সূচি তৈরি হয় পরিকল্পনা করেই।

ভারতের সম্প্রচারকারী চ্যানেলগুলি ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের জন্য আইসিসিকে প্রচুর টাকা দেয়। অন্য যে কোনও ম্যাচের থেকে সেটা অনেক বেশি। বিজ্ঞাপনদাতারাও আপত্তি করেন না। আইসিসির আয় হয় মূলত বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করে। স্বাভাবিক ভাবেই বেশি আয়ের লক্ষ্যে আইসিসিও চায় যত বেশি সম্ভব ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হোক। ২০২২ সালে শেষ হওয়া দু’বছরের সম্প্রচার স্বত্বের হিসাব দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ওই দু’বছরে সম্প্রচার স্বত্ব বাবদ ভারত থেকে আইসিসির আয় ৩.১ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৭,৪৮৭ কোটি টাকা)। ওই একই সময় বাকি বিশ্ব থেকে আইসিসির সম্প্রচার স্বত্ব বাবদ আয় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩১,০৩৪ কোটি টাকা)। ভারত থেকে যে বিপুল আয় হয়, তা হাতছাড়া করতে চায় না আইসিসি। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দিকে তাকিয়ে থাকে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ডও। বিশেষত যে সব দেশের ক্রিকেট বোর্ড আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল নয়। সম্প্রচার স্বত্ব থেকে আয়ের টাকা বিভিন্ন সদস্য দেশের মধ্যে ভাগ করে দেয় আইসিসি। সেই টাকায় ক্রিকেট চালায় বেশ কিছু দেশ। টেস্ট ক্রিকেটও টিকে রয়েছে এই টাকার উপর নির্ভর করে। স্বভাবত সেই দেশগুলিও চায় আরও বেশি ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। আরও বেশি আয়। তাদের দেশের ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি অক্সিজেন।

গত ১০ বছরে সাদা বলের ক্রিকেটে (এক দিনের ম্যাচ এবং টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে) ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছে ১৮ বার। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় সম্পূর্ণ বন্ধ। তা-ও বছরে গড়ে প্রায় দু’টি করে ম্যাচ খেলে ভারত এবং পাকিস্তান। এই ম্যাচের দিকে তাকিয়ে থাকে ক্রিকেট বিশ্ব।

ক্রিকেটের এই মডেলই দেখা যাচ্ছে ভারতীয় ফুটবলেও। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বার বার একই গ্রুপে রাখা হচ্ছে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলকে। ফুটবলেও কি তবে পরিকল্পিত সূচি হচ্ছে? সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘ইচ্ছাকৃত ভাবে এ রকম ক্রীড়াসূচি হয় কিনা জানা নেই। লটারির মাধ্যমে সূচি হয়। এবং তা লাইভ করা হয়। এই বিষয়টা ফেডারেশনের টুর্নামেন্ট কমিটি দেখে। তবে ফুটবলের প্রচার এবং প্রসার বৃদ্ধির জন্য মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলকে একই গ্রুপে খেলানো হলে ভুলের কিছু নেই। যেমন ক্রিকেটে একই গ্রুপে রাখা হয় ভারত-পাকিস্তানকে।’’ সরাসরি না মেনেও ক্রিকেটের উদাহরণেই থেমেছেন ফুটবল কর্তা।

গত সুপার কাপেও কলকাতা ডার্বি করার একটা চেষ্টা হয়েছিল। গত বার মোহনবাগান সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছিল। ইস্টবেঙ্গলকে খেলতে হয়েছিল প্রিকোয়ার্টার ফাইনাল। সেই ম্যাচ জিতলেই মোহনবাগানের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে হত ইস্টবেঙ্গলকে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল প্রথম ম্যাচেই হেরে গিয়ে আয়োজকদের ‘আশা’য় জল ঢেলে দেয়।

ডুরান্ড কাপেও একই ভাবে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দুই প্রধানকে। গত চার বছর ধরে একই গ্রুপে রাখা হচ্ছে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলকে। ২০২২ সালে দু’দলই গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে গিয়েছিল। ২০২৩ সালে গ্রুপ পর্বের পর ফাইনালেও মুখোমুখি হয়েছিল দুই প্রধান। ২০২৪ সালের ডুরান্ড ডার্বি হয়নি। আরজি কর কাণ্ডের জন্য ম্যাচ বাতিল হয় ম্যাচ। এ বারের ডুরান্ড কাপে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে জিতেছে ইস্টবেঙ্গল।

এমন ‘পরিকল্পিত’ ডার্বি নিয়ে ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার বলেছেন, ‘‘আগে বছরে অন্তত চারটে ডার্বি হত। আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্স, কলকাতা লিগ ছিল। এখন ডার্বির সংখ্যা কমে গিয়েছে। তবে ডার্বির আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। সমর্থক, দর্শকেরা উজ্জীবিত হয়। এটা ভাল। তবে অন্য প্রশ্নও আছে। এ বার সুপার কাপ গোয়াতে। সেখানে কি কলকাতা ডার্বির গুরুত্ব আছে?’’

ভাল দিকের পাশাপাশি খারাপ দিকের কথাও তুলে ধরলেন দেবব্রত। বললেন, ‘‘এখন ডার্বি করার একটা প্রবণতা দেখা গেলেও শুরুতেই একটা দলকে ছিটকে দেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।’’ এ বারের সুপার কাপেই যেহেতু প্রতিটি গ্রুপ থেকে একটি করে দল পরের পর্বে উঠবে, মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে একটি দল বিদায় নেবে গ্রুপ থেকেই।

ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান বা ভারতীয় ফুটবলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল আসলে আয়োজক, কর্তাদের কাছে সোনার ডিম দেওয়া হাঁস। প্রচার, রোজগার সব কিছু এই দুই ম্যাচ ঘিরে। সবটা না হলেও সিংহ ভাগ তো বটেই। মুনাফার এই অঙ্কের আড়ালে রয়েছে আশঙ্কাও। ভারত-পাকিস্তানের শেষ ১০টি সাদা বলের লড়াইয়ের ন’টি ম্যাচই জিতেছে ভারত। তার মধ্যে শেষ সাতটি ম্যাচেই জয়! চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা উধাও। ভারতের টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবও এশিয়া কাপের মধ্যে বলেছেন, ‘‘আমি সঠিক পরিসংখ্যান জানি না। কিন্তু একটা দলের পক্ষে যদি স্কোরলাইন ১৩-০, ১০-১ হয়, তা হলে এখন আর এটা কোনও লড়াই নয়। আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়।’’

কলকাতা ডার্বির ক্ষেত্রেও ছবিটা একই রকম। শেষ ১০টি ডার্বির (কলকাতা লিগ বাদে) সাতটি জিতেছে সবুজ-মেরুন। লাল-হলুদ জিতেছে দু’টি। একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। যে লড়াই বা রেষারেষির জন্য ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বা কলকাতা ডার্বির জনপ্রিয়তা, সেটাই দেখা যাচ্ছে না। উভয় ক্ষেত্রেই লড়াই এখন একপেশে।

হাঁস সোনার ডিম পাড়তে না পারলে লাভ কী? যতক্ষণ সোনার ডিম পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ ‘পরিকল্পিত’ সূচিই হয়তো দেখা যাবে দু’ক্ষেত্রেই। যে কোনও প্রতিযোগিতায় ভারত-পাকিস্তান বা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ এখন নিশ্চিত। অপেক্ষা থাকে শুধু ম্যাচের দিন এবং সময় ঘোষণার।

Asia Cup 2025 India vs Pakistan ICC East Bengal Mohun Bagan Kolkata Derby
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy