আবার ফ্রি-কিক, আবার গোল। ডংয়ের কিকের নাগাল পেলেন না মোহনবাগান অধিনায়ক শিল্টন। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে রবিবার উৎপল সরকারের তোলা ছবি।
ইস্টবেঙ্গল ৪ (ডং ২, রফিক, রাহুল) মোহনবাগান ০
কত হলুদ আবির উড়ল রবি-সন্ধ্যার আকাশে! লাল আবিরে রাঙা হল কত মুখ!
শব্দবোমার আওয়াজে ক’বার কেঁপে উঠল যুবভারতী!
কত মশাল জ্বলছিল, গর্বের কত লাল-হলুদ পতাকা উড়ছিল আকাশমুখী হয়ে!
ভারতীয় ফুটবলের নতুন পোস্টারবয় হয়ে কোরিয়ান ডু ডং হিউন ম্যাচের শেষে সেগুলো ঘুরেঘুরে দেখার চেষ্টা করছিলেন। অবাক দৃষ্টি নিয়ে মিনিট তিনেক দেখলেনও। তার পর হঠাৎ-ই হাঁটতে শুরু করলেন গ্যালারির দিকে। পিলপিল করে পিছনে ছুটছে মানুষ। দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর যখন সমর্থকদের কাঁধে চড়ে ফিরলেন ড্রেসিংরুমে, তখন রীতিমতো বিধ্বস্ত ইস্টবেঙ্গল জনতার হার্ট থ্রব। কিন্তু মুখের কোণে ঝুলে আছে পরিচিত সেই হাসি। যা এতটাই চওড়া যে, রং মশাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মনে হল!
চল্লিশ বছর আগে সমরেশ-সুভাষরা যে দিন টানা ছ’বার লিগ জিতে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন, সে দিন মাঠে উৎসব করতে পারেননি। লিগ নিয়ে মামলা থাকায়। সরকারি ভাবে তা ঘোষণা না হওয়ায়। ডং-এর আলো ছড়ানোর দিনে কিন্তু উৎসব শুরু হয়ে গেল ইস্টবেঙ্গলে। পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার থেকে টুর্নামেন্টের এক ম্যাচ বাকি থাকতেই ক্লাব পতাকা তোলার দিন নির্দিষ্ট হয়ে গেল। আজ সোমবারই।
ডার্বিতে জোড়া গোল নতুন কোনও ঘটনা নয়। গতবারই তো লিগে র্যান্টি মার্টিন্সের দু’টো গোল আছে বাগানের বিরুদ্ধে। কিন্তু ডং এমন একটা মঞ্চে এমন দু’টো গোল করলেন, যার নজির বিরল। হয়তো আর কখনও আসবেও না। হেক্সা লিগ জিতে ইতিহাস ছোঁয়া। সঙ্গে ডার্বি জিতে লিগ জয়। এই মঞ্চ তো চিমা, কৃশানু, বিকাশরাও পাননি কখনও। পড়শি ক্লাবে আই লিগের হ্যাংওভার কাটিয়ে দিতে দেবদূত হয়ে আছড়ে পড়ল ডং-এর দু’টো গোল। যাঁর প্রথমটা মনে পড়াল মহম্মদ আকবরকে। ডার্বিতে দ্রততম গোলের জন্য যা এখনও অমলিন। ডং-এর শুরুর গোলটা তো এক মিনিট বাইশ সেকেন্ডে। লাল-হলুদ সমর্থকদের মনের জ্বালা জোড়ানোর জন্য এর পরেও হল আরও তিনটে। পঁচাত্তরের আইএফএ শিল্ডের ৫-০ ছোঁয়াও হয়ে যেত হয়তো এ দিন, বাগানের সঞ্জয় বালমুচু গোল-লাইন সেভ না করলে।
ইস্টবেঙ্গলের বড় ব্যবধানে ডার্বি জয়
• ১৯৭৫ শিল্ড ফাইনালে ৫-০
• ১৯৩৬ লিগে ৪-০
• ২০১৫ লিগে ৪-০
• ১৯৯৭ ফেড কাপে ৪-১
• ২০০৫ শিল্ডে ৪-১
• ১৯৭৫ ও ১৯৭৭ লিগে সব ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল।
• ১৯৭২ ও ১৯৯১-এ ইস্টবেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কোনও গোল না খেয়ে।
• ২০১৫-এ লিগে এখনও পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল অপরাজিত (একটি ম্যাচ ড্র)।
• ডার্বির ইতিহাসে দ্রুততম গোল ১৯৭৬ লিগে মোহনবাগানের মহম্মদ আকবরের। ১৭ সেকেন্ডে।
• ডু ডং রবিবার করলেন দ্বিতীয় দ্রুততম গোল, ১ মিনিট ২২ সেকেন্ডে।
তথ্য: হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
আই এম বিজয়ন আর বাসুদেব মণ্ডলরা সোয়ার্ভিং শটে অনায়াস গোল করতেন। পরের দিকে ব্যারেটোও কিছু করেছেন। কিন্তু মেসি-ভক্ত কোরিয়ান তাঁদের চেয়েও বেশি নম্বর পাবেন দু’টো কারণে। প্রথমত, তাঁর দু’টো গোলই বাগান গোলের একই জায়গা দিয়ে বল গলিয়ে। বাঁ পায়ে। যা সাধারণত হয় না। দ্বিতীয়ত, সামনে ছয় জনের (দ্বিতীয় গোলের সময় তো আট জনের!) মানব প্রাচীরকে তোয়াক্কা না করে ভয়ঙ্কর গতি আর সোয়ার্ভের সংমিশ্রণে। সদ্য আই লিগ জয়ী অধিনায়ক শিল্টন পালের দীর্ঘ ফুটবল জীবনে মনে হয় এত মর্মান্তিক দিন আর আসেনি কখনও। ‘‘আমি বিজয়ন, ব্যারেটো, ওডাফা, বাসুদাকে মনে রেখেও বলছি, ডং-এর মতো ওঁরা কেউ ফ্রিকিক মারায় একশো পার্সেন্ট পারফেক্ট ছিল না,’’ বলছিলেন উচ্ছ্বসিত মেহতাব হোসেন। ইস্টবেঙ্গলের হেক্সা লিগ জয়ের প্রতি বছরই যিনি ছিলেন টিমের মাঝমাঠের জেনারেল। পঁচাত্তরের সমরেশ-সুধীরের মতো। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে, ডং-এর ফ্রিকিকের সময় বাগানের ‘গার্ড লাইন’ কেন এত অগোছালো ছিল? কেন মানা হল না যুগ-যুগ ধরে কোচেদের ম্যানুয়ালে থাকা সেট-পিস রোখার নিয়ম? নিয়ম হল, কিপার যে পোস্টটা সামলাবেন, তার উল্টো দিকের পোস্টের দিকে দেওয়াল তোলার সময় লম্বা ফুটবলার রাখতে হবে। সেটা তো ছিলই না। ম্যাচ শেষে গজগজ করছিলেন বাগান কোচ সঞ্জয় সেন। ‘‘আরে, যে ভাবে সাজাতে বলেছিলাম সেটা করেই নি! খেসারত তো দিতেই হবে। লজ্জা, লজ্জার দিন! কি বলব? সব দায় আমার।’’
কলকাতা লিগে বাগান শেষ বার ডার্বিতে চার গোল হজম করেছিল সেই স্বাধীনতার আগে। ১৯৩৬-এ। তখন কোচ ব্যাপারটাই ছিল না। সিনিয়ররাই কোচিং করাতেন। তাঁরা সরতেন, আবার কর্তাদের ইচ্ছেয় আসতেন। কিন্তু এখন তো বিশ্বজুড়ে খারাপ ফল হলেই কোচ তাড়ানোর যুগ। গুঞ্জন চললেও সঞ্জয়কে নিয়ে সে রকম দাবি অবশ্য এখনও ওঠেনি। অন্তত প্রকাশ্যে। সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু রাতে বলে দিলেন, ‘‘কোচ সরানোর কোনও প্রশ্নই নেই। সে রকম কিছু হয়ওনি। সুভাষের ৩-১ এর পরও তো আমরা রেখে দিয়েছিলাম।’’
ইস্টবেঙ্গল কার্যত পুরো টিম নিয়ে খেলল এ দিন। উল্টো দিকে আই লিগ জেতা মাত্র দু’জন ফুটবলার ছিলেন এ দিনের বাগান টিমে। আর্থিক দৈন্যের কারণে সনি নর্ডি-সহ অন্তত বারো জন ফুটবলারকে আইএসএলের ক্লাবগুলির হাতে সরাসরি তুলে দিয়েছেন কর্তারা। ফলে সঞ্জয়কে আট জন একেবারে নতুন ফুটবলার নিয়ে নামতে হয়েছে আগুনে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে। সত্তর হাজারের শব্দব্রহ্ম আর ডং-জাদুতে অনভি়জ্ঞ আজহার-কেন লুইসরা খেই হারিয়ে ফেলেছেন। দলের এক নম্বর স্ট্রাইকার ডুডু-র বিরতির পর লালকার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়াটা আরও অন্ধকারে নিয়ে গিয়েছে সঞ্জয়ের টিমকে। ডং-২: বাগান-০। ডুডু-বিদায়ের পর এই স্কোরলাইন বদলানোর তাই কোনও সুযোগও ছিল না। বরং ফুটবলের নিয়মেই সেটা বেড়েছে। হেক্সা লিগে কালি লাগাতে গিয়ে উল্টে কলঙ্কিত হয়েছে মোহনবাগান। আই লিগ জিতে আকাশে ওঠা বাগান-কোচ একশো দিনের মধ্যেই আছড়ে পড়েছেন মাটিতে। হাতাশার রেশ এতটাই যে, খেলার শেষে রেফারি রঞ্জিত বক্সিকে দৃষ্টিকটু ভাবে ধাক্কা মেরে লালকার্ড দেখতে হয়েছে লালকমলকে।
সেপ্টেম্বর মাস মানেই কি মোহনবাগানের সর্বনাশ?
বাংলার মাটিতে ইস্ট-মোহনের রেষারেষির যে তিনটে মাইলস্টোন অক্ষয় হয়ে থাকল, তার সবই যে এই মাসে। প্রথম টানা ছয় বার লিগ জিতে ইতিহাস তৈরির দিনটা ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর। শিল্ডে সেই ঐতিহাসিক ৫-০ গোলের লজ্জার রেকর্ডটাও তো ইস্টবেঙ্গল করেছিল সেপ্টেম্বরের শেষ দিনে। আর হেক্সা লিগ ছোঁয়ার দিনটাও হয়ে থাকল ৬ সেপ্টেম্বর।
বিদেশে বিভিন্ন ক্লাবের সাফল্যের ইতিহাস গড়ার পর গান বাঁধেন টিম-সমর্থকরা। লাল-হলুদের অন্তত ছ’টি ফ্যানস ক্লাব আছে এখন। সুরজিৎ-সুধীরদের সময় এ সব ছিল না। সেপ্টেম্বর নিয়ে গান বাঁধার সুযোগ করে দিয়েছেন ডং অ্যান্ড কোম্পানি! বাগানে সূর্য অস্ত যাওয়ার দিনে, ইস্টবেঙ্গলের আকাশে সোনার আলো।
সোনাঝরা গানের অপেক্ষায় থাকা যেতেই পারে।
চল্লিশ বছর আগে নিজেদের মাঠে কালীঘাটকে ৪-০ হারিয়ে প্রথম হেক্সা ইতিহাস গড়া। কী অদ্ভুত সমাপতন! সেটা ছোঁয়ার দিনেও সেই চার গোল! ইতিহাস মনে হয় এ ভাবেই ফিরে ফিরে আসে। মুছেও যায়।
ইস্টবেঙ্গল: লুই ব্যারেটো, রাহুল, বেলো, গুরবিন্দর, রবার্ট (সৌমিক), মেহতাব (তুলুঙ্গা), বিকাশ, খাবরা, অবিনাশ, রফিক, ডং (র্যান্টি)।
মোহনবাগান: শিল্টন, সুমন, জুদেলিন (সফর), সঞ্জয়, সুখেন, তীর্থঙ্কর (পঙ্কজ), আসিফ, লালকমল, কেন, আজহার (কাতসুমি), ডুডু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy