Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Bribes

‘পরের কিস্তি নেবেন? আগে টাকার ভাগ দিতে হবে’

কোথাও কাটমানি, কোথাও জমি দখল। কেউ আড়ালে, কেউ প্রকাশ্যে। সাধারণ মানুষকে মেজো-সেজো-ছোট নেতাদের চোখরাঙানি চলছেই।কোথাও কাটমানি, কোথাও জমি দখল। কেউ আড়ালে, কেউ প্রকাশ্যে। সাধারণ মানুষকে মেজো-সেজো-ছোট নেতাদের চোখরাঙানি চলছেই।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সৌমেন দত্ত
জামালপুর শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২০ ০৫:৪২
Share: Save:

‘‘অ্যাকাউন্টে তো টাকা ঢুকবে। ১০ হাজার আমাদের দিতে হবে। মনে রেখো’’— শান্ত ভাবে বলা কথাগুলো ভুলতে পারেন না পদ্মা ক্ষেত্রপাল। ভুলতে দেওয়াও হয়নি। যে দিন সরকারি আবাস প্রকল্পের টাকা অ্যাকাউন্টে ঢোকে, সে সন্ধ্যায় ফের তাগাদা, ‘‘টাকা চাই।’’ টাকা দিয়ে দিলে বাড়ি কী ভাবে করবেন, এলাকার সেই নেতার কাছে জানতে চেয়েছিলেন পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের শম্ভুপুর গ্রামের পদ্মাদেবী। অভিযোগ, এ বার শাসানো হয় তাঁকে। বলা হয়, ‘‘টাকা না দিলে, পরের কিস্তির টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকবে না।’’

লোকে বলে, সরকারি প্রকল্পের টাকা কার অ্যাকাউন্টে, কখন ঢুকবে, খবর থাকে ‘ওঁদের’ কাছে। ‘ওঁরা’ শম্ভুপুর গ্রামের— তাপস মণ্ডল ওরফে বাবলু, অভিজিৎ অধিকারী ও মানিক রুইদাস। অভিজিৎ ও তাপস ওই গ্রামে তৃণমূলের নেতা, আর মানিক দলের সাধারণ কর্মী বলে পরিচিত। অভিযোগ, সটান প্রাপকের বাড়িতে গিয়ে ওঁরা বলেন, ‘‘ঘরের জন্য অ্যাকাউন্টে টাকা আনিয়ে দিলাম। এ বার আমাদের ভাগটা চাই।’’ এমনকি, কে, কবে সে টাকা তুলতে যাচ্ছেন, তা খোঁজ রেখে ওঁরা পৌঁছে যান ব্যাঙ্কের সামনেও। টাকা নিয়ে বেরোলেই ‘ভাগ’ দিতে হয়। কোনও কারণে ব্যাঙ্কের সামনে যেতে না পারলে, সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি এসে ‘ভাগ’ বুঝে নেন ওঁরা।

আবাস যোজনার জনা তিরিশ উপভোক্তা সম্প্রতি ব্লক অফিসে এ নিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেন। জেলাশাসক (পূর্ব বর্ধমান) বিজয় ভারতী বলেন, ‘‘অভিযোগের সত্যতা মিললে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথও বলেন, ‘‘এই অভিযোগ দলের রাজ্য স্তরের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির নজরেও এসেছে। আমরা খোঁজ নিচ্ছি।’’ তবে তিন অভিযুক্তেরই দাবি, ‘‘আমাদের ফাঁসানো হচ্ছে।’’

আরও পড়ুন: বর্ষায় সুখবর, পাতে পড়ার অপেক্ষায় দিঘার ইলিশ

প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার জন্য তিন কিস্তিতে এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা পান উপভোক্তা। এ ছাড়া, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ৯০ দিনের মজুরি মেলে। শম্ভুপুরের ওই উপভোক্তাদের অভিযোগ, প্রথম কিস্তির ৬০ হাজার টাকা তাঁদের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ার পরেই তাপস, অভিজিৎ বা মানিক তাঁদের কারও কাছে পাঁচ, কারও কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। বিডিও-কে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে উপভোক্তারা দাবি করেছেন, ‘কাটমানি’ দিতে বাধ্য হওয়ার পরে, এখন টাকার অভাবে বাড়ি তৈরির কাজ থমকে রয়েছে তাঁদের।

জামালপুর ব্লক অফিসে জমা পড়া ‘কাটমানি’-র অভিযোগ। নিজস্ব চিত্র

গ্রামের অধর ক্ষেত্রপাল, অলোক ক্ষেত্রপালদের অভিযোগ, ‘‘বরাদ্দ থেকে পাঁচ হাজার টাকা না দিলে ওই প্রকল্পে ১০০ দিনের কাজ করে টাকা পাব না, এমনই হুমকি দিয়েছিল বাবলু। পাঁচ হাজার নিয়েছে, পরের কিস্তি থেকে আরও পাঁচ হাজার দিতে হবে বলে শাসিয়ে রেখেছে। ছা-পোষা লোক। ১০০ দিনের টাকা না পেলে খুব বিপদে পড়ব।’’ পদ্মা রুইদাস নামে এক উপভোক্তার অভিযোগ, ‘‘ওরা আগে থেকেই খবর পেয়েছিল, আমাদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছে। আমাদের বলে, ওদের ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। রাজি না হলে হুমকি দেয়, বাড়ি তৈরির বাকি কিস্তির টাকা আর মিলবে না। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার দিন এসে ওরা নিজেদের ভাগ নিয়ে গিয়েছে।’’ পদ্মা ক্ষেত্রপালের দাবি, ‘‘আমাদের ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়েছে অভিজিৎ।’’ তৃণমূল সূত্রেরই দাবি, পঞ্চায়েত ও ব্লক স্তরে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন এই তিন
জন। ফলে, কোন প্রকল্পে, কে কত টাকা পাচ্ছেন তা জানা এঁদের পক্ষে কঠিন নয়।

অভিজিৎ দামোদর নদে একটি ফেরিঘাটের কর্মী। অ্যাসবেস্টসের চাল দেওয়া বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই এলাকা তফসিলি জনজাতি প্রধান। আগে যাঁরা সিপিএমে ছিলেন, তাঁরা এখন বিজেপি করছেন। আমি যেহেতু রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত করিনি, সে আক্রোশে বিজেপি এ সব মনগড়া অভিযোগ করছে।’’ ইটভাটার অংশীদারি রয়েছে তাপস মণ্ডলের। তাঁর দু’টি বাড়ি। তাঁর দাবি, ‘‘তৃণমূল করি। তাই আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’’ মানিক রুইদাস আগে বিজেপি করতেন। মাছের ব্যবসা করেন। অ্যাসবেস্টসের চাল দেওয়া বাড়িতে থাকেন। তাঁর দাবি, ‘‘দাদাগিরি আমরা করি না। সব সময় মানুষের পাশে থাকি। হিংসায় বিজেপির লোকেরা কুকথা বলে।’’ বিজেপির সাংগঠনিক জেলা সভাপতি (বর্ধমান সদর) সন্দীপ নন্দীর অবশ্য প্রতিক্রিয়া, “মানুষ যত প্রতিবাদ করছেন, তৃণমূল তত বিজেপির ভূত দেখছে।’’

প্রশ্ন হল, তিন জনেই তো নিজেরা রোজগার করেন। এই ‘কাটমানি’ নিয়ে দৃশ্যত তাঁরা ফুলেফেঁপে উঠেছেন, তা-ও নয়। তা হলে? স্থানীয়দের বক্তব্য, এলাকায় মূলত দরিদ্র লোকের বাস। ‘দাদাগিরি’ করে তাঁদের বশে রাখার পাশাপাশি ৫-১০ হাজার টাকা দিব্যি বাড়তি রোজগার হচ্ছে এই তিন জনের। সেটাই লাভ। এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘আর টাকা কোথায় যায়, আমরা জানব কী করে? চোখের সামনে যা দেখছি, সেটাই বলছি।’’

বিডিও (জামালপুর) শুভঙ্কর মজুমদার জানান, পুলিশ ও পঞ্চায়েতকে অভিযোগের বিশদ তদন্ত করতে বলা হয়েছে।

তবে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও যাঁদের ভয় কমেনি, সেই উপভোক্তাদের কথায়, ‘‘সন্ধ্যার পরে বাড়িতে ঢুকে যে ভাবে টাকার জন্য শাসাল, না জানি কী হয়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bribes TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE