Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

সবাই বাঁচলে আমি বাঁচব, মন্ত্র মুমতাজের

একটা আস্ত জীবন রেলরাস্তার ধারে।

নাতনির সঙ্গে মুমতাজ। নিজস্ব চিত্র

নাতনির সঙ্গে মুমতাজ। নিজস্ব চিত্র

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২০ ০৬:১০
Share: Save:

দশটা টাকার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছিল একরত্তি আদিয়া। চকলেট চাই। কাঁহা তক আর ‘বা বা ব্ল্যাকশিপটা শোনাও’ বলে তাকে ভুলিয়ে রাখা যায়!

করুণাধারার মতো বস্তাবোঝাই বিস্কুটের প্যাকেট ঠিক তখনই এসে পড়েছিল রেলধারের ঝুপড়িতে। চোখ পাকিয়ে নাতনির দিকে তাকালেন তরুণী দিদিমা মুমতাজ সর্দার। ‘‘আগে সবাই পাক, তার পরে তুই!’’

অগত্যা বস্তা খুলে গোটা মহল্লায় ভাগাভাগির তোড়জোড়! বুভুক্ষু শ্রাবস্তীপুর নয়, কলকাতার পার্ক সার্কাস। আল্লাভরসা বাজারের পিছনের রেলবস্তি। ছয় সন্তান, তিন জন নাতি-নাতনির সংসারে বটগাছ অনূর্ধ্ব ৪০ মুমতাজই। গৃহহিংসায় একদা খাদের মুখে দাঁড়ানো তরুণী পাড়ার সবার মুখে কিছুমিছু জোটানোর ভার নিয়েছেন। রেলধারের ৫৭টি পরিবারে কারা, কত জন ঠোঁটস্থ দোহারা তরুণীর। সগর্বে দেখান, নাতনির অঙ্ক খাতায় ইংরেজিতে লেখা লিস্ট। মিনা বিবি ৬ জন, রেহানা বিবি ৬ জন, নুরবানু বিবি ৮...সঙ্গে কারও কারও ফোন নম্বর। মুমতাজ সগর্বে বলেন, “আমার মেজ মেয়ে লরেটোর রেনবো স্কুলে ক্লাস থ্রি পাশ। ওর হাতের লেখা। এক জনের বড় ফোনে (স্মার্টফোন) ছবি তুলে এনজিও-র টিঙ্কু দিদিকে পাঠিয়েছি।”

একটা আস্ত জীবন রেলরাস্তার ধারে। জন্ম দক্ষিণ বারাসত রেল স্টেশনে। শিয়ালদহ প্ল্যাটফর্মে শৈশব। ভোটার কার্ডে তিলজলা রোডের ঠিকানা। ‘মা’ উড়ালপুল তৈরির সময়ে উৎখাত হয়ে এই রেলবস্তির সংসার। মহামারি, অতিমারির ব্যাপ্তি এখনও মাথায় ঢোকে না অদম্য বাঙালিনির। 'সাগরে শয়ন যার শিশিরে কী ভয় তার’ ভঙ্গিতে বলেন, “উড়ালপুল তৈরির সময়ে আরও বড় মুসিবত ছিল। ঘর গেল, মেয়েগুলো ছোট। হস্টেলে যেতে চাইল না, পটাপট বিয়ে দিয়ে দিলাম।” তখন কাগজকুড়ানি, এখন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে। রেলধারের ঝুপড়িতে মেয়েদের ইস্কুলে টেনে নিয়ে যান, পাচারের বিপদ বোঝান। জীবনে আত্মবিশ্বাস আর সাহসের পুঁজি বেড়েছে মুমতাজের। সেই সঙ্গে আরও দৃঢ় হয়েছে, সবাইকে নিয়ে
চলার প্রতিজ্ঞা।

আরও পড়ুন: শর্ত মেনে কাজ পরিযায়ীদের, নির্দেশিকা কেন্দ্রের

মালগাড়ির বাতাসে লকডাউনেও দফায় দফায় কেঁপে ওঠে পলকা ঝুপড়ি। তার পাশে মুমতাজদের কাঠের উনুনেই আশপাশের লোকের হাঁড়ি চড়ছে। শিলনোড়া ধার করে কেউ মশলা বেটে নিয়ে যাচ্ছেন। এ দুর্যোগে পার্ক সার্কাসে নিরন্নদের জন্য নানা সাহায্য এলেও রেললাইনের ধার অনেকটা উপেক্ষিত। ভোটার কার্ডধারী প্রায় সকলেই। কিন্তু রেশনকার্ডবিহীন। পুলিশি সাহায্য এখনও আসেনি এ তল্লাটে। দিন কয়েক আগে কাছেই কোনও গেটওয়ালা বাড়ি থেকে খাবার দিচ্ছে শুনে সবার জন্য চাইতে গিয়েছিলেন মুমতাজ। দেয়নি। ‘‘তোরা তো এ গলির নোস’’, বলে ভাগিয়ে দিয়েছে। আপাতত ভরসা কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্যাকেট।

আরও পড়ুন: ‘বাড়িই এখন অফিস’, বললেন নরেন্দ্র মোদীও

মুমতাজ বলছিলেন, চেয়েচিন্তে ছ’বস্তা চাল, দু’বস্তা আলু, দু’বস্তা ডাল, ছ’প্যাকেট তেল জোগাড় হয়েছে দেড় হপ্তা আগে। মেয়ে ফরিদাকে নিয়ে হাত লাগিয়ে ৭০ প্যাকেটে ভাগ করে দিয়েছেন। এখানে রিকশা চালানো, বাবুর বাড়ি কাজ সব বন্ধ। কেউ কেউ আসন্ন রমজানে বাজারে ফলের দোকান দেওয়ার চেষ্টায়। আপাতত মুমতাজ ব্যস্ত ফোন করে নানা যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সবার পরবর্তী রসদ জোটানোর লক্ষ্যে। পড়শিরা বলেন, ‘‘মুমতাজদিদি নিজের জন্য বাড়তি কিছু রাখবে না। রক্তাল্পতার জন্য এনজিও থেকে দুধ-ডিম দিলে নিজে না-খেয়ে কোনও অসুস্থ বুড়িকে খাওয়াবে, ঘরে ছেঁড়া মাদুর! নতুন পেয়েও পাশের খড়খড়ে মেঝের মসজিদে দান করেছিল!’’

মুখের ওড়নাটা পেঁচিয়ে সারা ক্ষণ টাইমের কলের জলে এত লোকের সাবানে হাত ধোয়া নিয়ে অবশ্য কিছুটা দুশ্চিন্তায় মুমতাজ। ক্যানিংয়ে বাপের বাড়ি পড়ে থাকা বৌমা আটাগোলা জল খাচ্ছে বলেও চোখ ছলছল করে। সবাই মিলে না-বাঁচলে কেউ একা বাঁচবে না! ছোঁয়াচে রোগ হানার অনেক আগেই এ দর্শনে স্থিত হয়েছেন রেলবস্তির তরুণী।


(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE