Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দুই পুলিশ জাপ্টে ধরলেন সৌভিককে 

শুক্রবার রাত থেকে টানা ছাব্বিশ ঘণ্টা ধরে তাঁকে জেরা করলেও গ্রেফতার করা হয়নি।

সপরিবারে বন্ধুপ্রকাশ। —ফাইল চিত্র

সপরিবারে বন্ধুপ্রকাশ। —ফাইল চিত্র

মৃন্ময় সরকার, বিমান হাজরা
জিয়াগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৫৮
Share: Save:

জিয়াগঞ্জ থেকে সাহাপুর ঢুঁড়েও যাঁর খোঁজ মেলেনি, পড়শি জেলা বীরভূমের রামপুরহাটে যার বাড়ি গিয়েও খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তদন্তকারীদের, সিউড়ির নিঝুম রাস্তা থেকে তাঁকেই শেষ পর্যন্ত আটক করল পুলিশ। সৌভিক বণিক ওরফে দীপ নামে ওই যুবকই জিয়াগঞ্জে সপরিবার শিক্ষক খুনের মূল সূত্র বলে মনে করছে পুলিশ।

শুক্রবার রাত থেকে টানা ছাব্বিশ ঘণ্টা ধরে তাঁকে জেরা করলেও গ্রেফতার করা হয়নি। মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, ‘‘রহস্যের জাল কাটুক, তার পরে যাকে প্রয়োজন তাকে গ্রেফতার করা হবে!’’

দশমীর সকালে জিয়াগঞ্জের লেবুবাগানে নিজের বাড়িতেই খুন হয়েছিলেন বন্ধুপ্রকাশ পাল। বাড়ির অন্য ঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাঁর স্ত্রী বিউটি ও ছ’ বছরের ছেলে অঙ্গনের দেহ। তার পর থেকেই বন্ধুপ্রকাশের পরিচিত ওই যুবককে হন্যে হয়ে খুঁজছিল পুলিশ।

শুক্রবার বিকেলে রামপুরহাটে তাঁর বাড়ি গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, মাস চারেক ধরে সিউড়িই ছিল সৌভিকের আস্তানা। জিয়াগঞ্জ পুলিশের বোলেরো গাড়ি ছোটে সিউড়ির অরববিন্দ পল্লির সেই ঠিকানায়। কিন্তু পৌঁছে দেখা যায় দরজায় তালা ঝুলছে। তদন্তকারী অফিসারদের এক জনের কথায়, ‘‘সিউড়ির অরবিন্দ পল্লিতে পড়শির সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায় সদ্যই পাড়া ছেড়েছেন ওই যুবক। নিমেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আমাদের একটা দল যাবে বাসস্ট্যান্ডে, অন্যটি নজর রাখবে সিউড়ি স্টেশনে।’’ অরবিন্দ পল্লি থেকে স্টেশন যাওয়ার সহজ রাস্তা বাণীমন্দির স্কুল রোড ধরে এগোতে থাকে সাদা পোশাকের পুলিশ। তদন্তকারীদের প্রত্যেকের পকেটে সৌভিকের একটি করে ছবি। সন্ধে হয়ে আসছে। পথচারীদের সঙ্গে ছবি মিলিয়ে দেখাও বেশ দুষ্কর। আচমকাই দেখা যায় ব্যাকপ্যাক নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এক যুবক হেঁটে আসছেন। গাড়ির আলো মুখে পড়তেই সব সন্দেহ কেটে যায়। দুই পুলিশকর্মী ছুটে গিয়ে তাঁকে জাপ্টে ধরেন। সৌভিককে গাড়িতে তুলে সটান নিয়ে আসা হয় জিয়াগঞ্জ থানায়। পরে তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী অমিতাভবাবুকেও তুনে আনা হয় থানায়। তার পর রাতভর পিতা-পুত্রকে পাশাপাশি বসিয়ে জেরা করে পুলিশ। শনিবার বাবাকে নিষ্কৃতি দিলেও জেরা চলছে সৌভিকের।

জেলা পুলিশের পাশাপাশি ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। স্পেশ্যাল সুপার সিআইডি ইন্দ্র চক্রবর্তীর নেতৃত্বে এ দিন একটি দল জিয়াগঞ্জে গিয়ে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে। পাড়া-পড়শির সঙ্গে কথা বলে, বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিআইডি সূত্রের খবর, তদন্তকারীদের অনুমান, ওই হত্যাকাণ্ডের সময় একাধিক লোক ছিলেন যাঁদের অধিকাংশই পাল পরিবারের পরিচিত। সেই তালিকায় কি সৌভিকও ছিলেন? মুকেশ কুমার বলেন, ‘‘একটু সবুর করুন, জানতে পারবেন!’’

তবে তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, বন্ধুপ্রকাশের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর নতুন নয়। প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরির পাশাপাশি বাড়তি আয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে সৌভিকই ওই শিক্ষককে বিভিন্ন ভুয়ো অর্থ লগ্নি সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। একে একে তিনটি লগ্নি সংস্থা খুলে বেশ কিছু আমানতকারীও জোগাড় করে ফেলেন তাঁরা। তবে মেয়াদ পূর্ণ হলে সে টাকা ফেরত দেওয়ার সময়ে পিছিয়ে যান সৌভিক। বাধ্য হয়ে টাকা ধার নিয়ে প্রায় সাত লক্ষ টাকা আমানতকারীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন বন্ধুপ্রকাশ। মনোমালিন্যের সূত্রপাত সেখান থেকেই। এই সময় সৌভিকের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় বলেও জানতে পেরেছে পুলিশ। তাঁর স্ত্রী এখন বোলপুরের বাসিন্দা।

বন্ধুপ্রকাশের শ্বশুরবাড়িও রামপুরহাটে। তাঁর শ্যালক সাক্ষীগোপাল মণ্ডল বলেন, ‘‘প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হলেও বন্ধুপ্রকাশ বিভিন্ন মার্কেটিং ব্যবসা এবং লগ্নি সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। আর সেই সব ব্যবসায় তাকে টেনে এনেছিল সৌভিক। লাভের গুড় অবশ্য সৌভিকই খেত! আমরা বার বার বন্ধুপ্রকাশকে সাবধান করেছি। কিন্তু সৌভিকের উপর অগাধ আস্থা ছিল তার।’’ শাশুড়ি চন্দনাও বলেন, ‘‘জামাই ওকে (সৌভিক) এতটাই বিশ্বাস করত যে নিজের স্ত্রীকে লুকিয়েও টাকা ধার দিত।’’ অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। সাক্ষীগোপাল বলেন, ‘‘গৃহঋণ নিয়ে বাড়ি করছিল বন্ধুপ্রকাশ। কিন্তু এক বছর ধরে তার ইএমআই গুনতে হত আমাদের। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌভিকের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়নি।’’

বন্ধুপ্রকাশের এক ভাই জানান, পুজোর সময়েও সাহাপুরের বাড়িতে এসে হইহই করে গিয়েছে সৌভিক। তাঁর এক আত্মীয় বলেন, ‘‘সবই দাদার প্রশ্রয়ে।’’ তবে বন্ধুপ্রকাশ খুন হওয়ার পরে এক বারের জন্যও খোঁজ নেননি সৌভিক। সন্দেহের তির গিয়ে পড়ে তার পরেই।

শুধু সৌভিক নন, এ দিন পাল পরিবারের দুধওয়ালা রাজীব দাসকেও আটক করেছে পুলিশ। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘তার কথাতেও কিছু অসঙ্গতি মিলেছে।’’ মুকেশ কুমার বলেন, ‘‘জাল গুটিয়ে আসছে ক্রমেই। দু-এক দিনের মধ্যেই সব স্পষ্ট হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jiaganj Crime Murder Jiaganj Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE