Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
bjp

কোথাও বিতর্কে মুকুল ঘনিষ্ঠ নেত্রী, কোথাও অপছন্দ সঙ্ঘের লোক, প্রার্থী-সঙ্কট বহাল বিজেপিতে

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শনিবার বিশেষ বৈঠকে দলকে রীতিমতো ধমক দিয়েছেন নেতৃত্ব। শৃঙ্খলা ভাঙলে কঠোর পদক্ষেপ— হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খোদ সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন)।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৯ ২৩:৩৪
Share: Save:

ঝড় বৃহস্পতিবারই উঠে গিয়েছিল। কোচবিহারে অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। আরও বেশ কয়েকটা কেন্দ্র থেকে চাপা ক্ষোভের আঁচ পেতে শুরু করেছিলেন বিজেপির রাজ্য নেতারা। সে সব দ্রুত সামলে নিতে গোটা নেতৃত্ব যখন তৎপর, তখন আবার নতুন জট।

দল কিছু ঘোষণা করার আগেই একজন নেমে পড়েছেন ভোটের প্রচারে, নিজেকে একটি কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরে।উত্তরবঙ্গের এক আসনে মন কষাকষি শুরু হয়ে গিয়েছে বিজেপি এবং সঙ্ঘের মধ্যে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শনিবার বিশেষ বৈঠকে দলকে রীতিমতো ধমক দিয়েছেন নেতৃত্ব। শৃঙ্খলা ভাঙলে কঠোর পদক্ষেপ— হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খোদ সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন)।

মাস দুয়েক আগে বিজেপি-তে যোগ দেওয়া নিশীথ প্রামাণিক কেন কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী? জেলায় যুব তৃণমূলের অত্যন্ত দাপুটে নেতা হিসেবে বিজেপি-কে কোণঠাসা করতে গত ডিসেম্বর পর্যন্তও যিনি তৎপর ছিলেন, তাঁর হয়ে এখন বিজেপি কর্মীরা প্রচারে নামবেন কী ভাবে? বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেই এই প্রশ্ন তুলে জেলা পার্টি অফিসে তুমুল বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন বিজেপি কর্মীদের একাংশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার সকালেই দিল্লির দূত অরবিন্দ মেনন পৌঁছে যান কোচবিহারে। জেলা সভানেত্রী মালতী রাভা রায়-সহ অন্য নেতা-কর্মীদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। দুপুরে নিশীথ প্রামাণিক যখন কোচবিহারে পৌঁছন, তখন অনেকটা থিতিয়ে এসেছে বিজেপি কর্মীদের রোষ। তার পরেও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রশমিত হলেন ঠিকই, কিন্তু মন থেকে কি নিশীথের হয়ে ময়দানে নামতে পারবেন বিজেপির দীর্ঘ দিনের কর্মীরা?

আরও পড়ুন: এক ব্যক্তির সরকার চলছে, জনগণের কথা শোনা হয় না: মমতাকে তীব্র আক্রমণ রাহুলের

হবিবপুরের দীর্ঘ দিনের সিপিএম বিধায়ক খগেন মুর্মুকে উত্তর মালদহে পদ্মফুলের টিকিট দেওয়া হতে পারে, এই খবর ছড়াতেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। খগেনের বিরোধিতা করে আগাম পোস্টার পড়েছিল গাজোলে। বিজেপি নেতৃত্ব সে সবে পাত্তা দেননি। খগেনের নামই প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। তার পরে উত্তর মালদহের অন্যান্য এলাকাতেও ফ্লেক্স ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে খগেন মুর্মুকে প্রার্থী হিসেবে মানতে না চেয়ে।

বসিরহাটেও ফ্লেক্স ঝোলানো হয়েছে কয়েকটি এলাকায়। সায়ন্তন বসুকে ‘বহিরাগত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে সেই ফ্লেক্সে।

সায়ন্তন নিজে অবশ্য বলছেন, ‘‘বিজেপির কেউ নন, তৃণমূলই ওই সব ফ্লেক্স ঝুলিয়েছে। আমরা এফআইআর করেছি।’’ রাজ্য বিজেপির সদর দফতর সর্বক্ষণ সামলাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরাও উড়িয়ে দিচ্ছেন সায়ন্তনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের তত্ত্ব। বলছেন, ‘‘সায়ন্তন বসু দলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি দলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাকে প্রার্থী হিসেবে পেয়ে কর্মীরা ক্ষুব্ধ হবেন! বিজেপি-তে এমনটা হয় না।’’

বসিরহাটের বিজেপি কর্মীরা সত্যিই ক্ষুব্ধ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। বিজেপির মতো সংগঠিত কাঠামোর দলে নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ যে সাধারণত হয় না, সে কথাও ঠিক। কিন্তু বসিরহাটে না ঘটলেও, সেই বিরল ঘটনাটা যে রাজ্যের নানা প্রান্তে ঘটছে, সে কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কোচবিহারে কী ঘটেছে, তা গোটা বাংলা এখন জানে। সমস্যা অত্যন্ত জটিল আকার না নিলে অরবিন্দ মেননের মতো সর্বভারতীয় স্তরের নেতাকে যে তড়িঘড়ি কোচবিহার ছুটতে হত না, সে কথা বুঝে নিতে কারও বাকি নেই।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বিজেপি সূত্রের খবর, প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ এবং সেই সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলার আঁচ পাওয়া গিয়েছে শনিবার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আয়োজিত বিশেষ বৈঠকেও। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন আসনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে দলের বিভিন্ন স্তরের কার্যকর্তাদের আলাপ করিয়ে দিতেই ওই বৈঠক ডাকা হয়েছিল। যে হলে বৈঠকটি হয়, সেখানের একেবারে সামনের দু’সারি চেয়ার সংরক্ষিত ছিল প্রার্থীদের বসার জন্য। প্রার্থী হিসেবে যাঁদের নাম ঘোষিত হয়েছে, তাঁদের পাশাপাশি অর্চনা মজুমদার নামে এক নেত্রীও ওই চেয়ারে গিয়ে বসে পড়েন বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে।

কে এই অর্চনা? তিনি পেশায় চিকিৎসক। অসরকারি সংগঠন চালান। মুকুল রায়ের অনুগামী হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। মুকুলের নিজের জেলা নদিয়া থেকেই অর্চনা প্রার্থী হতে পারেন বলে বেশ কিছু দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। রানাঘাট কেন্দ্রের নামও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু বিজেপির নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা কমিটি অর্চনা মজুমদারকে প্রার্থী হিসেবে চায়নি। রাজ্য নেতৃত্বের একাংশও অর্চনাকে প্রার্থী করতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। কিন্তু অর্চনা মজুমদার কোনও ঘোষণার অপেক্ষা না করে নিজেই প্রচারে নেমে পড়েছেন বলে নদিয়ার বিজেপি নেতাদের একাংশ দাবি করছেন।

সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটির সভাপতি জগন্নাথ সরকার বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাইলেন না। কিন্তু অস্বীকারও করলেন না। বললেন, ‘‘লোকমুখে শুনেছি, উনি নিজেকে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে দাবি করছেন, প্রচারও করছেন। তবে আমি নিজে তেমন কিছু দেখিনি।’’ রানাঘাট থেকে অর্চনা মজুমদারকে টিকিট দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা কি রয়েছে?জগন্নাথ বললেন, ‘‘এ সব আমরা জানি না। সিদ্ধান্ত দিল্লি থেকে হবে। দল যাকে প্রার্থী হিসেবে পাঠাবে, আমরা তাঁর হয়েই কাজে নামব।’’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যে দিল্লি থেকেই হবে, সে কথা ঠিক। কিন্তু জেলা নেতৃত্ব তো নিশ্চয়ই কারও না কারও না সুপারিশ করেছেন। জেলা সভাপতি বললেন, ‘‘প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে জেলা কমিটির কাছে অর্চনা মজুমদার কোনও আবেদন করেননি। যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের থেকে তিনটি নাম বেছে নিয়ে আমরা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।’’

জগন্নাথ সরকারের কথায় স্পষ্ট যে, অর্চনার প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে কোনও খবর জেলা বিজেপির কাছে নেই। প্রার্থী হিসেবে তার নাম ঘোষিতও হয়নি এখনও। তা হলে শনিবারের বৈঠকে প্রার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে অর্চনা বসলেন কী ভাবে? প্রশ্নটা ঘুরছে বিজেপির অন্দরেই।

ক্ষুব্ধ বালুরঘাটের বিজেপি কর্মীদের একাংশও। উত্তরবঙ্গের ওই আসন নিয়ে রাজ্য বিজেপি অত্যন্ত আশাবাদী। কিন্তু বালুরঘাটের বিজেপি প্রার্থী হিসেবে যাঁর নাম ঘোষিত হয়েছে, সেই সুকান্ত মজুমদারকে পেয়ে বিজেপির জেলা নেতৃত্ব একেবারেই খুশি নন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকান্ত কিন্তু মুকুল রায়ের হাত ধরে দলে ঢোকেননি। তিনি গেরুয়া শিবিরে নবাগতও নন। দীর্ঘ দিন ধরে আরএসএস ঘনিষ্ঠ ওই অধ্যাপক। তা হলে সুকান্তকে নিয়ে ক্ষোভ কেন? জেলা বিজেপির কর্মীরা জানাচ্ছেন, দক্ষিণ দিনাজপুরের রাজনীতিতে বিজেপির মুখ হিসেবে পরিচিত যাঁরা, তাঁদের মধ্যেই কাউকে টিকিট দেওয়া হবে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু তার বদলে সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রার্থী করা হয়েছে বলে অনেকে অসন্তুষ্ট। সেই অসন্তোষের ছাপও পড়তে শুরু করেছে। প্রার্থী ঘোষণার পরে তিন দিন কেটে যাওয়া সত্ত্বেও বালুরঘাটের মতো জায়গায় বিজেপি এখনও সংগঠিত ভাবে প্রচারেই নামতে পারেনি। নিজের পরিচিত এবং সঙ্ঘের ভরসায় প্রাথী সুকান্ত মজুমদার নিজে বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকটা বৈঠক করেছেন। কিন্তু জেলা বিজেপি নেতৃত্ব এবং সঙ্ঘের স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে ফাটল বেশ চওড়া আকার নেওয়ায় একসঙ্গে হই-হই করে প্রচারে নেমে পড়ার ছবি এখনও তুলে ধরতে পারেনি বালুরঘাটের গেরুয়া শিবির।

আরও পড়ুন: রাজ্য জুড়ে বড় প্রচারের পরিকল্পনা বিজেপির, ৩ এপ্রিল ব্রিগেডে মোদীর সভা?

নরেন্দ্র মোদীর প্রস্তাবিত সাতটি জনসভার মধ্যে একটি হতে চলেছে কলকাতায় ব্রিগেড সমাবেশ, এমনটাই খবর বিজেপি সূত্রে।

এখনই লাগামটা টেনে না ধরতে পারলে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়বে, সে কথা বুঝতে পারছেন রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বও। শনিবারের বৈঠকে তাই রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সুব্রত চট্টোপাধ্যায় কড়া বার্তা দিয়েছেন। প্রার্থীদের সঙ্গে অসহযোগিতা বা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতার যে কোনও চেষ্টাকে শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে দেখা হবে বলে তিনি সতর্ক করেছেন। তাতেই থামেননি সুব্রত। শৃঙ্খলা কেউ ভাঙলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করতে দল বাধ্য হবে, তিনি যে-ই হন— এই রকম হুঁশিয়ারিও তিনি এ দিন দিয়েছেন বলে খবর।

বাংলার ৪২টি আসনের জন্য এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিজেপি। ২৮টি আসনের জন্য প্রার্থী ঘোষিত হয়েছে। এখনও ১৪ জনের নাম ঘোষণা হওয়া বাকি। তাতেই এই অবস্থা। বাকিদের নাম ঘোষণা হওয়ার পরে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কোথাও গিয়ে দাঁড়াবে না। সব ঠিকই থাকবে। কোনও কোনও প্রার্থী দলে একেবারে নতুন। সেই জন্য পুরনোদের কারও কারও একটু অসুবিধা হচ্ছে মেনে নিতে। কিন্তু এগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের সমস্যা। শুরুতে ও রকম একটু হয়। দু’এক দিনের মধ্যে সব শান্ত হয়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE