Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
National News

ধুঁকছে ‘সিল্কের মক্কা’, এনআরসি নিয়ে তপ্ত জঙ্গিপুরের মাটি

পূর্ব ভারতের ‘সিল্কের মক্কা’ জঙ্গিপুরের রেশম চাষিদের নিয়ে প্রায় কোনও রাজনৈতিক দলের তেমন হেলদোল দেখা যায় না। বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি হলেও, তুঁত চাষীদের কথা মুখেই আনেন না রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা।

সিল্কের সুতো হাতে জঙ্গিপুরের তুঁতচাষি। ছবি: প্রতিবেদক

সিল্কের সুতো হাতে জঙ্গিপুরের তুঁতচাষি। ছবি: প্রতিবেদক

সোমনাথ মণ্ডল
জঙ্গিপুর শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:৫৫
Share: Save:

বাদশাহি রোড পিছনে ফেলে পাঁচগ্রামে ঢুকতেই দূরের একটি হুড খোলা গাড়ির দিকে চোখ গেল। গাড়িতে শুধুই কালো মাথার ভিড়। আরও কাছে যেতে বুঝলাম, বিদায়ী সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় ওই গাড়ি চড়ে ভোট প্রচারে বেরিয়েছেন।

অন্য একটি গাড়ি থেকে মাইকে প্রচার করা হচ্ছে, ‘‘আপনাদের কাছের লোক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলবেন। ঘর থেকে বেরিয়ে ওঁকে স্বাগত জানান…।’’

কিন্তু কে, কাকে স্বাগত জানাবেন!পুকুরের ধারে, তাল গাছে ঠেস দিয়ে কিছু মানুষ ভিড় করেছেন ঠিকই। তাঁদের সকলের হাতেই কংগ্রেসের পতাকা। সাধারণ গ্রামবাসীদের ভিড় নেই বললেই চলে। যা দেখে মনে হল, পাঁচগ্রামের মানুষ যেন অভিজিৎবাবুকে কিছুটা হতাশই করলেন।

কিন্তু কেন? কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা-ও স্পষ্ট হয়ে গেল। পাঁচগ্রামের খড়িকাডাঙা এলাকায় ঢুকতেই এক মাঝবয়সি ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, ‘‘কাউকে খুঁজছেন?’’বললাম, এখানে তো তুঁত চাষ হয়? জবাব এল, “হ্যাঁ, আমিই তো পলু চাষি। আমার নাম সাদেকুল ইসলাম। আসুন, ঘরে আসুন। এখানকার অধিকাংশ মানুষই পলু চাষ করেন।”

সাদেকুল মাটির উঠানে চেয়ার পেতে দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, অভিজিৎবাবু আসছেন তো, দেখতে যাবেন না?

সাদেকুল গোমড়া মুখে জবাব দিলেন, “কী হবে গিয়ে কর্তা? আমাদের তো কিছুই হবে না। পলু চাষিরা এ বার না খেতে পেয়ে মরবে। ভাষণ শুনে লাভ নেই। পেটে ভাত দিতে পারবে কি?”

কথা শুরু হয়েছে, এরই মধ্যে চা এসে পৌঁছেছে। চুমক দিয়ে প্রশ্ন করলাম, এত রাগ কেন আপনাদের?

হুডখোলা গাড়িতে প্রচারে কংগ্রেস প্রার্থী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। ছবি: প্রতিবেদক

দাঁড়িয়েই ছিলেন সাদেকুল। এ বার চেয়ার নিয়ে এসে গুছিয়ে বসলেন। ‘‘শুনুন বাবু, আগেই বলে রাখি, আপনারা যাকে তুঁত চাষ বা রেশম চাষ বলে থাকেন। আমরা তাকে পলু (রেশম কীট) চাষ বলে থাকি। জানেনই তো, মুর্শিদাবাদ সিল্ক পৃথিবী বিখ্যাত। এ বার মনে হয়ে রেশম চাষই বন্ধ হয়ে যাবে। যাঁরা রেশম সুতো উৎপাদন করেন, তাঁদের কী ভাবে দিন কাটছে, কেউ খোঁজ নেয় না।”

আরও পডু়ন: এখনও উত্তপ্ত চোপড়া, তৃণমুল-বিজেপি সংঘর্ষের মাঝে গুলিবিদ্ধ স্কুলপড়ুয়া

ইতিমধ্যেই সাদেকুলের বাড়িতে ভিড় জমে গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক জনশিক্ষকও আছেন। হাতে সময় আছে তো? শুনবেন আমাদের কষ্টের কথা— বললেন সাদেকুল। তাহলে শুনুন, “তুঁত পাতা চাষ থেকে শুরু করে রেশম কীটের লালনপালন। তার পর গুটি থেকে রেশমের সুতো বার করা। গোটা পদ্ধতিতে ধৈর্য লাগে। ভাল শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। টাকা খরচও কম হয় না।”

আরও পড়ুন: শেষ টাওয়ার লোকেশন শান্তিপুর... কৃষ্ণনগরে ইভিএমের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার নিখোঁজ ঘিরে রহস্য

মিলকি, বালাসপুর, খড়গ্রামের বাসিন্দা আজফর শেখ, আব্দুল রশিদরা গালে হাত দিয়ে শুনছিলেন। রশিদ আচমকাই বলে উঠলেন, “বাবু যেটুকু সরকারি সাহায্য আসে, এখানকার নেতারাই খেয়ে নিচ্ছে। যাঁরা চাষ করেন না, তাঁদের নাম উঠে যাচ্ছে সরকারি খাতায়। কংগ্রেস এবং তৃণমূলের নেতারা এর জন্যে দায়ী। সাংসদকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। লাভ হয়নি।”

নিজেদের দুরবস্থার কথা জানিয়ে সাংসদকে চিঠি স্থানীয় চাষিদের। ছবি: প্রতিবেদক

পূর্ব ভারতের ‘সিল্কের মক্কা’ জঙ্গিপুরের রেশম চাষিদের নিয়ে প্রায় কোনও রাজনৈতিক দলের তেমন হেলদোল দেখা যায় না। বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি হলেও, তুঁত চাষীদের কথা মুখেই আনেন না রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। ফলে এখন ইস্যু বলতে, হাতে গরম জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)। এ বারের ভোটের বৈতরণী পার করতে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মুখেও বারবারই শোনা যাচ্ছে এনআরসি-র কথা। তিনি গ্রামে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, “এখানে বিভাজনের রাজনীতি করছে বিজেপি। ক্ষমতা এলে এনআরসি চালু করবে, আপনাদের তাড়িয়ে দেবে।”

যদিও এনআরসিকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন না বিজেপি প্রার্থী মাফুজা খাতুনও। এক সময়ে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জের সিপিএম বিধায়ক ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে বাম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় ভালই বোঝেন সংগঠনকে কী ভাবে চাঙ্গা করতে হয়। এমনিতেই তিনি সুবক্তা। এ রাজ্যে একমাত্র মহিলা সংখ্যালঘু প্রার্থী। ভোটপ্রচারে নেমে ‘ভোকাল টনিকে’ জমিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর কথায়, “মানুষ উন্নয়ন চায়। এত দিন এখানে কিছুই হয়নি। বিড়ি থেকে সিল্ক, উদাসীন রাজ্য সরকার। কংগ্রেস সাংসদও কিছুই করেননি। এনআরসি নিয়ে এখন ভোট চাইতে এসেছেন।”

ভোটপ্রচারে বিজেপি প্রার্থী মাফুজা খাতুন। ছবি: প্রতিবেদক

তৃণমূল প্রার্থী খলিলুর রহমান জেলা নেতা শ্রম দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জাকির হোসনের কাঁধে ভর করে প্রচারে নেমেছেন। দেখে মনে হচ্ছে, তিনি নন, ভোটে লড়ছেন যেন জাকির হোসেনই! এ দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনসংযোগে বেশি মন দিয়েছেন সিপিএম প্রার্থী জুলফিকার আলি। বামেদের আশা, এই কেন্দ্রে চমক অপেক্ষা করছে।

যদিও সব সম্ভাবনা, চমককে উড়িয়ে দিয়ে মুর্শিদাবাদের ‘বেতাজ বাদশা’ অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, “জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র এ বারও কংগ্রেস পাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE