মালদহের চাঁচলের জনসভায় রাহুল। ছবি সৌজন্য: কংগ্রেসের টুইটার অ্যাকাউন্ট।
বাংলায় পা রেখেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানালেন রাহুল গাঁধী। ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’র অভিযোগ তুলে কখনও নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একাসনে বসালেন মমতাকে। কখনও ‘বাম আমলের অত্যাচার’-এর প্রসঙ্গ টেনে এনে অভিযোগ করলেন, এখনও একই রকম পরিস্থিতি বাংলায়। আর ভোটের মুখে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়া উত্তর মালদহের বিদায়ী সাংসদকে ‘প্রতারক’ আখ্যা দিয়ে তাঁর আহ্বান, ‘‘এই প্রতারণা মনে রাখুন, ভুলবেন না।’’
উত্তর মালদহ সংসদীয় কেন্দ্র থেকে টানা দু’বার কংগ্রেসের টিকিটে জিতে লোকসভায় যাওয়া মৌসম বেনজির নুর কিছু দিন আগে যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। ওই আসনে এ বার তৃণমূলেরই প্রার্থী হয়েছেন মৌসম। সেই লোকসভা কেন্দ্রেরই অন্তর্গত চাঁচল এলাকা থেকে বাংলার জন্য নির্বাচনী প্রচার শুরু করার সিদ্ধান্ত রাহুল গাঁধী যখন নিয়েছিলেন, তখনই তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একটা স্পষ্ট বার্তা চলে গিয়েছিল বলে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের মত। কিন্তু শনিবার চাঁচলের সভামঞ্চ থেকে রাহুল যা বললেন, তাতে আরও শানিত হয়ে উঠল সে বার্তা।
জাতীয় রাজনীতিতে যে বাধ্যবাধকতাই থাক, বাংলায় কংগ্রেসে ভাঙন ধরানো এবং কংগ্রেস কর্মীদের উপর নিরন্তর আক্রমণের অভিযোগকে তিনি একেবারেই হালকা করে দেখতে রাজি নন— এ দিন এমনটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন রাহুল।
আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ভাষণের শুরুর দিকেই এ দিন রাফাল ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করেন রাহুল গাঁধী। ‘‘জনগণের টাকা চুরি করে অনিল অম্বানীর পকেট ভরেছেন নরেন্দ্র মোদী,’’—এই মন্তব্য ফের শোনা যায় রাহুলের মুখে। বছরে ২ কোটি যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান, প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া, কৃষকের আয় বৃদ্ধি-সহ বিজেপির বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরে রাহুল এ দিন প্রশ্ন তোলেন, কোন প্রতিশ্রুতিটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পূরণ করেছেন?
তার পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করেন কংগ্রেস সভাপতি। মোদী এবং মমতাকে পাশাপাশি রেখে রাহুলের মন্তব্য, ‘‘এক দিকে নরেন্দ্র মোদী মিথ্যা কথা বলেন। আর অন্য দিকে আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু এখানে কিছুই হওয়ার নয়।’’ জমায়েতের উদ্দেশে রাহুলের প্রশ্ন, ‘‘মমতাজি আপনাদের জন্য কী করেছেন?’’ বাংলার সরকার কৃষকের কথা শোনে না, সাধারণ মানুষের কথা শোনে না— অভিযোগ রাহুল গাঁধীর। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এক জনের কথায় কি সরকার চলবে? আর কারও কথা শোনা হবে না?’’
আরও পড়ুন: রাজ্য জুড়ে বড় প্রচারের পরিকল্পনা বিজেপির, ৩ এপ্রিল ব্রিগেডে মোদীর সভা?
বাংলায় বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের সমঝোতা হতে হতেও ভেস্তে গিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেস একলা চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শেষ পর্যন্ত। তাই কংগ্রেস সভাপতির নিশানায় যে বামেরাও বিদ্ধ হবেন এ দিন, তা প্রত্যাশিতই ছিল। বামেদের তিনি আক্রমণ করলেন। তবে মোদী এবং মমতার বিরুদ্ধে রাহুলের আক্রমণের স্বর যতটা চড়া ছিল, বামেদের বিরুদ্ধে ততটা ছিল না। সমঝোতার চেষ্টা ভেস্তে যাওয়া নিয়ে কোনও কথা রাহুল গাঁধী বলেননি। সিপিএম-কে আক্রমণ করেছেন মূলত বামফ্রন্ট জমানায় কংগ্রেস কর্মীদের উপরে হওয়া অত্যাচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে। এবং সেই সূত্রেই বাম জমানার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছেন তৃণমূলের শাসনকালকে।
কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে রাহুল এ দিন বলেন, ‘‘আগে আপনারা বামফ্রন্টের হাতে মার খেতেন। আজ আপনারা মমতাজির দল তৃণমূলের রাজত্বে দুঃখ ভোগ করছেন।’’ এতেই থামেননি রাহুল। বাম জমানার সঙ্গে বর্তমান শাসকের তুলনা টেনে তিনি বলেন, ‘‘যে অত্যাচার সিপিএমের আমলে চলত, আজও সেই অত্যাচারই চলছে। সে সময়ে সরকারটা ছিল একটা সংগঠনের জন্য, এখন সরকারটা একজন ব্যক্তির।’’
নির্বাচনী মরসুমে বাংলায় তাঁর প্রথম জনসভা থেকে কংগ্রেস কর্মীদের উজ্জীবিত করার সব রকম চেষ্টাই রাহুল এ দিন করেছেন। ‘‘কংগ্রেস কর্মীদের দাবিয়ে রাখা হয়, মারা হয়, পেটানো হয়। এর মধ্যেই যাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে রয়েছেন, তাঁদের মন থেকে ধন্যবাদ দিচ্ছি,’’—বলেন রাহুল। তিনি আরও বলেন, ‘‘আপনারা অনেক কিছু সহ্য করেছেন, আর একটু করুন। দিল্লিতে আমাদের সরকার আসতে চলেছে। দেখে নেবেন, ভালবাসা কাকে বলে।’’
উত্তর মালদহের জনসভায় দাঁড়িয়ে এক বারের জন্যও মৌসম বেনজির নুরের নাম উচ্চারণ করেননি রাহুল। কিন্তু কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন মৌসমকে। রাহুল বলেন, ‘‘এখানে আপনারা চিরকাল কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এক ব্যক্তি আপনাদের ধোঁকা দিয়েছেন। এখানে কংগ্রেসের পুরনো প্রার্থী আপনাদের ধোঁকা দিয়েছেন। কংগ্রেসের গড়ে এসে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’’ জমায়েতের উদ্দেশে রাহুলের আহ্বান, ‘‘এই ধোঁকার কথা আপনারা মনে রাখুন, এই ধোঁকা ভুলবেন না।’’
গণিখান চৌধুরীর জমানা থেকে এ পর্যন্ত, মালদহ লোকসভা আসন কখনও হাতছাড়া হয়নি কংগ্রেসের। আসন পুনর্বিন্যাসের পরে অবিভক্ত মালদহ ভেঙে দুটো আসন তৈরি হওয়ার পরেও নয়। সেই দুর্গ যাতে এ বারেও হাতছাড়া না হয়, তা নিশ্চিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে রাহুলের বার্তা, ‘‘এ কথা আমি জীবনে কখনও ভুলব না যে, ভাল সময় হোক, খারাপ সময় হোক, আপনারা সব সময় কংগ্রেসের সঙ্গে থেকেছেন।’’
চাঁচলের জনসভা থেকে রাহুলের এই আক্রমণ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও মুখ খোলেননি ঠিকই। কিন্তু কটাক্ষ ছুড়ে দিয়েছেন ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, ‘‘বাংলায় কৃষকের আয় তিন গুণ বেড়েছে, এটা উনি জানেন না। উনি জানেন না যে, কৃষকদের নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনাগুলো কী? উনি জানেন না যে, কৃষি ক্রেডিট কার্ড কী জিনিস। উনি জানেন না যে, কৃষকদের সমর্থনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী কী কাজ করেছেন।’’ ফিরহাদ আরও বলেন, ‘‘কংগ্রেস এখানে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ এখানে ওঁদের তো কিছু নেই। সময় নষ্ট করছেন রাহুল গাঁধী। এখানে বিজেপি-কে আটকাতে পারেন একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাই সব মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে রয়েছেন। কংগ্রেসের গড় বা ওই জাতীয় সেন্টিমেন্ট নিয়ে কোনও লাভ নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy