Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Anubrata Mondal

পিকে-র নিদান, ম্যাডামের নির্দেশ, চেনা ‘কেষ্ট’ এখন পরিবর্তনে অচেনা

অনুব্রত মুখ খুললেই ‘হিট’। তাঁর প্রতিটি ডায়লগ সোশ্যাল মিডিয়ায় তুফান তুলেছে। এ হেন অনুব্রত হঠাৎ সংযমী।

অনুব্রত হঠাৎ সংযমী হয়ে কথাবার্তায় অনেকটাই রাশ টেনেছেন। মেজাজ মাঝেমধ্যে হারালেও শুধু দলের লোকের উপরে।

অনুব্রত হঠাৎ সংযমী হয়ে কথাবার্তায় অনেকটাই রাশ টেনেছেন। মেজাজ মাঝেমধ্যে হারালেও শুধু দলের লোকের উপরে।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২০ ১২:৫৭
Share: Save:

সাল ২০১৩। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে বীরভূম জেলা তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সভাপতির মেজাজ সপ্তমে। অন্তর্দলীয় বিবাদের জেরে জেলার বহু আসনে তৃণমূলের লোকজনই নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। আর অনুব্রত মণ্ডল সুর ততোধিক চড়িয়ে নিদান দিচ্ছেন, ‘‘কেউ নির্দল প্রার্থী হলে তার বাড়ির চালটা কেটে জ্বালিয়ে দিস।’’ অবলীলায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘‘পুলিশ বাধা দিলে পুলিশকে বম মারুন!’’

সাল ২০১৬। অনুব্রত কখনও শোনাচ্ছেন ‘চড়াম চড়াম’ বাদ্যি। কখনও বলছেন, ভোটের দিন সকলের জন্য ‘গুড়বাতাসা’ থাকবে। গুড়বাতাসার রং যে কালচে লাল, যে রংয়ের সঙ্গে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের রঙের সঙ্গে খানিক মেলে, সেটা তিনি নিজে না বললেও পার্শ্বচরদের কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ভোট মেটার পরে বলছেন, ‘‘বিরোধীদের ‘শ্রাদ্ধ হয়ে গিয়েছে! তাই ঢাক নয়, খোল-করতাল বাজছে।’’

সাল ২০১৮। পঞ্চায়েত ভোটের আগে উত্তপ্ত গোটা বাংলা। ততোধিক উত্তপ্ত অনুব্রতর বীরভূম। অধিকাংশ বিরোধী প্রার্থী মনোনয়নই জমা দিতে পারছেন না। যাঁরা পারছেন, তাঁদেরও অনেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। তার পরেও কিছু প্রার্থী টিকে রইলেন। সংখ্যায় সামান্য হলেও কিছু আসনে ভোট নিশ্চিত হল। ‘বীরভূমের কেষ্ট’ (অনুব্রতর ডাকনাম) তখন বললেন, ‘‘ভোটের দিন রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকবে।’’

কেষ্টর সেই ইঙ্গিতবহ মন্তব্যে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখলেন, ‘দেখ খুলে তোর তিন নয়ন / রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন’। যা শুনে কেষ্ট জনসভার মঞ্চ থেকে বলে বসলেন, ‘‘এ আবার কোন নতুন কবি এলেন?’’ শঙ্খ মাঙ্গলিক কাজে ব্যবহার করা হয়। অতএব ওই কবি ‘শঙ্খ নামের অপমান’— এমনও বলে ফেললেন।

অনুব্রত মুখ খুললেই ‘হিট ডায়লগ’। কোনও ভোটের আগে বলছেন বিরোধীদের জন্য ‘নকুলদানা রেডি’। কোনও ভোটের আগে দলীয় কর্মীদের হাতে ‘পাঁচন’ তুলে দিচ্ছেন। কখনও রাজনৈতিক বিরোধীর বাড়িঘর ভেঙে ‘চুরমার’ করে দেবেন বলছেন। কখনও ‘শুঁটিয়ে লাল’ করে দেওয়ার দাওয়াই বাতলাচ্ছেন। প্রতিটি ডায়লগ সোশ্যাল মিডিয়ায় তুফান তুলেছে।

এ হেন অনুব্রত হঠাৎ সংযমী হয়ে কথাবার্তায় অনেকটাই রাশ টেনেছেন। মেজাজ মাঝেমধ্যে হারালেও শুধু দলের লোকের উপরে। ধমক-ধামক যা দেওয়ার, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদেরই দিচ্ছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে থেকেই সুর নরম হওয়া শুরু হয়েছিল। প্রকাশ্য ভাষণে অনুব্রত দলীয় কর্মীদের বলেছিলেন, ‘‘কেউ চড় মারলে গালটা বাড়িয়ে দেবে। মারবে না।’’ বিজেপি বলেছিল, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটের তুমুল অত্যাচার তৃণমূলের ক্ষতি করে দিয়েছে বুঝে অনুব্রত গাঁধীবাদী সাজার চেষ্টা করছেন।’’ বিজেপির সে দাবি ঠিক কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। কিন্তু সে ভোটে বীরভূমের দু’টি লোকসভা আসনেই জিতেছিল তৃণমূল। অতঃপর ২০২১-এর বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে, অনুব্রত যেন তত বেশি করে মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন। গত কয়েক মাস ধরে বীরভূমের একের পর এক ব্লকে কর্মিসভা করছেন অনুব্রত। স্থানীয় বিধায়ক, ব্লক নেতৃত্ব, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, জেলা পরিষদ সদস্য, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান— সকলকে সেখানে হাজির হতে হচ্ছে। ডাক পড়ছে বুথস্তরের কর্মীদেরও। বুথ ধরে ধরে হার-জিত এবং সাংগঠনিক অবস্থার হিসাব নিচ্ছেন অনুব্রত। পরিস্থিতি খারাপ শুনলে কারণ জানতে চাইছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুন্নয়নের অভিযোগ উঠছে। আর অনুব্রত কড়া ধমক দিচ্ছেন পঞ্চায়েতের নেতাদের। কোথাও অভিযোগকারী বুথ সভাপতিকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কোথাও গিয়ে বলেছেন, যে গ্রামে তৃণমূল ভোট পায়নি, সেখানে উন্নয়নের কাজ বন্ধ রাখতে। কিন্তু পরের কর্মিসভাতেই আবার শুধরে নিয়েছেন সেই বুলি। বলেছেন, ভোট মিলুক না মিলুক, কাজ বন্ধ রাখা যাবে না। রাস্তা-পানীয় জল সকলের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তাঁর ধমক থেকে রেহাই মেলেনি এমনকি, রাজ্যের মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কেও।

তৃণমূল সূত্রের খবর, সর্বোচ্চ নেতৃত্বের তরফে কড়া বার্তা পৌঁছেছে কেষ্টর কাছে। কথাবার্তায় রাশ টানার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাঁকে। সূত্রের খবর, দলের প্রধান পরামর্শদাতা তথা ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোর (পিকে) তেমনই মনে করছেন। পিকে-র টিম রাজ্যের সব প্রান্তে দফায় দফায় সমীক্ষা চালাচ্ছে। সেই সব সমীক্ষাতে বীরভূম এবং অনুব্রতর বিষয়ে ‘উদ্বেগজনক’ তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। দলনেত্রীর কাছেও সেই সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তার পরেই কালীঘাট থেকে বীরভূমে বার্তা পৌঁছেছে। সেই কারণেই অনুব্রতর পরিবর্তন বলে তৃণমূলের একাধিক শীর্ষনেতা জানাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: উৎসবে বেপরোয়া মনোভাব ও ভিড়ে বিপদ হতে দেরি হবে না

জেলার রাজনীতিতে অনুব্রত-ঘনিষ্ঠরা অবশ্য বলছেন, গত জানুয়ারিতে স্ত্রী বিয়োগের পর থেকেই অনুব্রতের আচরণে সংযম এসেছে। এর সঙ্গে দলীয় নির্দেশের কোনও সম্পর্ক নেই। বস্তুত, তাঁদের দাবি, দলের তরফে এমন কোনও নির্দেশ দেওয়াও হয়নি। অনুব্রত নিজে অবশ্য ‘আচরণগত পরিবর্তনের’ কথা মানতে নারাজ। তাঁর এই উল্টোপথ ধরার কী ব্যাখ্যা? আনন্দবাজার ডিজিটালের প্রশ্নের জবাবে অনুব্রতর সোজাসাপটা মন্তব্য, ‘‘কোনও ব্যাখ্যা দেব না।’’ কিন্তু মেজাজের বদলটা তো চোখে পড়ছে! অনুব্রতের জবাব, ‘‘মেজাজ বদলের তো কিছু নেই! আগেও আমি এমনকিছু বলতাম না। এখনও বলছি না।’’

অবশ্য রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষের কথায়, ‘‘ভোট এগিয়ে আসছে। তাই অনুব্রত মণ্ডলকে এখন একটু ভাল সাজার চেষ্টা করতে হচ্ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বীরভূমে যা হয়েছিল, তা জেলার মানুষ ভোলেননি। একটা ব্লক ছাড়া কোথাও মনোনয়নই সে ভাবে জমা দিতে দেয়নি। সেই অত্যাচার এবং সন্ত্রাসের জবাব মানুষ ২০১৯-এর ভোটে কিছুটা দিয়েছেন। পুরোপুরি কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ভোট হয়নি। হলে তৃণমূল আরও কড়া জবাব পেত। অনুব্রত মণ্ডল বুঝতে পারছেন, ২০২১-এর ভোট আর সে ভাবে হবে না। তাই কয়েকটা ভাল ভাল কথা বলে মানুষকে পঞ্চায়েতের স্মৃতি ভোলানোর চেষ্টা করছেন।’’

আরও পড়ুন: জঙ্গলমহলের ক্ষোভে সিলমোহর শুভেন্দুর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anubrata Mondal TMC Leader Controvertial Comment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE