Advertisement
E-Paper

পাহাড়ি ঢালের গাঁয়ে হোম-স্টে

ঘড়ি কাঁটা ধরে অফিস বেরনো। না হলেই যে ট্রেন মিস। আর দিনের শেষে ধুঁকত ধুঁকতে বাড়ি ফেরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ১৭:১৮

ঘড়ি কাঁটা ধরে অফিস বেরনো। না হলেই যে ট্রেন মিস। আর দিনের শেষে ধুঁকত ধুঁকতে বাড়ি ফেরা।

নিত্যদিনের এই ধরাবাঁধা রুটিনে যে ছন্দপতন ঘটতে চলেছে, সেটা শুনেই লাফিয়ে উঠেছিলাম। জায়গাটার নাম জেনে অবশ্য ততধিক মুষড়ে পড়ি। ‘চটকপুর’।

—সেটা কোথায়? এ নাম তো শুনিনি।

—সাড়ে আট হাজার ফিট। চলবে?

আর কোনও প্রশ্ন করিনি। ঠোঁটের কোণে উছলে ওঠা হাসিটা দেখেই খুশি হয়ে যান প্রশ্নকর্তাও। তিনি জানেন, পাহাড় আমি বড্ড ভালবাসি।

রওনা হয়ে গেলাম। শিয়ালদহ থেকে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস ছাড়ল দুপুর ১টা ৪০-এ। এনজেপি পৌঁছলাম পরের দিন মাঝরাতে। সেখানে পরিচিত এক ভদ্রলোকের হোটেলে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে, একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে জিপ ভাড়া করলাম। গন্তব্য সোনাদা।

ইতিমধ্যে বলে রাখি, চটকপুর একটি পাহাড়ি গ্রাম। সোনাদা থেকে ৭ কিলোমিটার। হোটেল-রিসর্ট বলতে একমাত্র সরকারি ফরেস্ট বাংলো। আর না হলে, হোম-স্টে।

আমরা দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল, পাহাড়িদের সঙ্গে ওদের মতো করেই থাকব। সোনাদা বাজারে পৌঁছে দেখি ওদের গাড়ি অপেক্ষা করছে (আগে থেকে বলা ছিল)। এ বার আর সাধারণ গাড়িতে যাওয়া যাবে না। রাস্তা খুব খারাপ। চাই ল্যান্ড রোভার।

কারণটা হাড়ে-মজ্জায় টের পেলাম। খাড়াই রাস্তা। সে এতটাই খাড়াই, খালি মনে হচ্ছিল, এই বুঝি গাড়িটা উল্টে যায়। যত না এগোয়, তার থেকে বেশি এ পাশ-ও পাশ দোলে।

সাত কিলোমিটার যেতে কত ক্ষণ লেগেছিল, ঘড়ি দেখিনি। গাড়ি থামল একটা বাঁকের মুখে। একটা শ্যাওলা ধরা কাঠের তক্তায় লাল রঙে লেখা ‘চটকপুর ভিলেজ’। কিন্তু গ্রামটা কই? এক দিকে খাদ। তাতে পাইন-বার্চের জঙ্গল। অন্য দিকে, পাহাড় উঠে গিয়েছে। সিঞ্চল রিজার্ভ ফরেস্ট। এর মধ্যে তো জনমনিষ্যি চোখে পড়ে না!

বলা হয়নি, আমাদের বুক করা হোম স্টে-র মালিক নিজে এসেছিলেন সোনাদায় আমাদের নিতে। গাড়ি থামতেই তিনি ঝটপট মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লেন। এত ক্ষণে চোখে পড়ল, একটা ছোট্ট রাস্তা উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। পাহাড় কেটেই রাস্তাটা তৈরি। এ-ই বড় বড় ধাপ। একটা ধাপই আমাদের বাড়ির দু’টো সিঁড়ির সমান।

কথা না বাড়িয়ে ফলো করলাম তাঁকে। দু’তিনখানা ধাপ উঠেই বেশ টের পেলাম, ফুসফুস ‘ছেড়ে দে মা’ বলছে। জিভ বেরিয়ে যাওয়ার দশা। গৃহস্বামী ভদ্রলোককে দেখলাম, আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে দিব্য লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এগিয়ে চলেছেন। আমি আর বর, তাঁর পিছু পিছু।

খানিক যেতেই একটা বাঁশের ছোট্ট দরজা। ঠেলে ঢুকতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল গোটা গ্রামটা।

পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ধাপ চাষ হয়েছে। সবুজের মাঝে ইতিউতি রোদ পড়ে ঝলমল করছে লাল-নীল চালার ছোট ছোট পাহাড়ি ঘর। সব বাড়িতেই নিজস্ব বাগান আছে। নাম-না-জানা বাহারি ফুলের টব। সে কত রং!

আমাদের হোম স্টে-টাও চমৎকার। দু’টো বেডরুম, বসার ঘর, ডাইনিং রুম, লাগোয়া বাথরুমে গিজার, এলাহি ব্যবস্থা। আর আমরা সাকুল্যে দু’জন। বেডরুমের জানলা দিয়ে দেখা যায় টাইগার হিল। আমাদের পাহাড়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে। গৃহস্বামী জানালেন, কপাল ভাল থাকলে ওই জানলা দিয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘারও দর্শন পাবেন।

এখানে উনিশটি পরিবারের বাস। প্রত্যেকেরই হোম স্টে আছে। অতিথি এলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক জনের হোম স্টে-তে ওঠেন। ব্যবস্থাপনায় গ্রামের মোড়ল বিনোদ রাই। তিনিই জানালেন, ব্রিটিশ আমলে সিঞ্চল ফরেস্টে গাছ লাগাতে তাঁদের পূর্বপুরুষদের আনা হয়েছিল। তার পর থেকে তাঁরা ওখানেই থেকে যান। ‘‘বর্ষাকালে ফরেস্টে ঢোকা বারণ।
তাই ওই সময়ে পর্যটক আসে না। বছরের বাকি সময়টা পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে। গরমে এক রূপ, শীতে বরফ-ঠান্ডা। পিকচার পোস্টকার্ডের মতো গ্রামটায় একবার কেউ ঘুরে গেলে, ফিরে আসতে বাধ্য। তাই লোকমুখে ছড়িয়েও পড়ছে আমাদের কথা,’’ খানিক গর্বের সঙ্গে বললেন বিনোদ।

সন্ধ্যায় হাতে গরম মোমো বানিয়ে দিলেন গৃহকর্ত্রী। গ্রামেরই একটি লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। নিজেরাই আগ বাড়িয়ে নিমন্ত্রণ নিয়েছিলাম। হাতে একটা টর্চ বাগিয়ে চললাম। বাড়িটা কাছেই। গিয়ে দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সদ্য তৈরি ধোঁয়া ওঠা মাংস। হাত বাড়াতেই ধেয়ে এল প্রশ্নটা, ‘‘ছাং খাবেন নাকি? আমরা বাড়িতেই বানাই।’’

কনকনে ঠান্ডায় মন্দ লাগল না। তার থেকেও ভাল লাগল গ্রাম্য সারল্য আর ওদের আতিথেয়তা।

পরের দিনটাও চটকপুরেই ছিলাম। দু’চোখ ভরে দেখেছি। বুক ভরে নিয়েছি বিশুদ্ধ অক্সিজেন। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মেঘের হুটোপাটি, পাইন-বার্চে হাওয়ার শোঁ-শোঁ আর ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা রইল আমাদের সঙ্গেই।

কী ভাবে যাবেন?

শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে ট্রেনে এনজেপি। বাসেও যাওয়া যেতে পারে। সেখান থেকে সোনাদা জিপে বা বাসে। চটকপুরে হোম স্টে-তে থাকতে হলে আগে থেকে জানাতে হবে। ওদেরই গাড়ি নিতে আসবে। যোগাযোগের নম্বর: ৭৫৮৩৯৭১৫১৭

কখন যাবেন?

বর্ষায় জঙ্গলে ঢোকা নিষেধ। বরফ-ঠান্ডা শীত ভাল লাগলে যাওয়া যেতেই পারে। গরমে অপূর্ব।

কোথায় থাকবেন?

হোম স্টে বা ফরেস্ট বাংলো

ছবি: কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

Home Stay North Bengal Hill Stations Travel Attractions
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy