কোভিড পরিচয় করিয়েছে জীবনের অন্ধকার দিকের সঙ্গে। বুঝিয়ে দিয়েছে একাকিত্ব, ঘরবন্দি জীবনের যন্ত্রণা। দিনের পর দিন পরিবারে থেকেও একলা হয়ে যাওয়া মানুষগুলির কষ্ট যে কতটা ভয়ঙ্কর, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই টের পেয়েছেন অতিমারির সময়ে।
ঠিক সে কারণেই বিশ্ব জুড়ে ভাবনা বদলেছে। গত দু’তিন বছর ধরে ভ্রমণের যে নয়া ভাবনা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, তা হল ‘মাল্টিজেনারেশনাল ট্রাভেল’ বা পরিবারের বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষের একসঙ্গে ঘোরা। উদ্দেশ্য শুধু প্রকৃতি উপভোগ করা নয়, বরং এই ভ্রমণ মিলনাত্মক এক ভাবনার জন্ম দেয়। মিলিয়ে দেয় দাদু, ছেলে, নাতিকে। পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। ব্যস্ত জীবনে একছাদের তলায় থেকেও বয়স্ক বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয় না সন্তানের। নাতি-নাতনিরাও দাদু-ঠাকুরমার সান্নিধ্য সব সময় পায় না। কাকা, জ্যাঠার মতো সম্পর্কের মানুষগুলিকে ঠিক ভাবে চেনার সুযোগ হয়ে ওঠে না গতিশীল জীবনে। পরিবার এবং পরিবারের মানুষগুলি যে একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে থাকলে ভাল থাকেন, খুশিতে থাকেন, সেটাই বুঝিয়ে দেয় এমন ভ্রমণ।
বিশ্বের একাধিক দেশেই প্রজন্মের ব্যবধান ঘুচিয়ে একই সঙ্গে আনন্দ-উপভোগ করার চল জনপ্রিয় হচ্ছে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ প্রফেশনাল স্টাডিজ়-এর এম টিশ সেন্টার অফ হসপিটালিটির তরফে আমেরিকায় একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। যেখানে দেখা গিয়েছে, ৫৪ শতাংশ দাদু, ঠাকুরমা জানিয়েছেন তাঁরা ছেলে, মেয়ে এবং নাতি-নাতনির সঙ্গে সফর করেছেন। ৪০ শতাংশ বয়স্করা জানিয়েছিলেন, তাঁরা পরিবারের সকলের সঙ্গে আগামী দিনে সফর করতে চান।
পেশাগত ভাবে বিভিন্ন সফরের পরিকল্পনা করে দেন পেনসিলভেনিয়ার ক্লোয়ি জনস্টন। তিনি বলছেন, ‘‘শিশু থেকে বয়স্ক— সকলের জন্যই নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় এমন সফর। দাদু-ঠাকুরমারা তাঁদের নাতি-নাতনিদের খেলতে, নতুন কিছু শিখতে দেখেন।’’
তবে শুধু বিদেশে নয়, এমন চল ভারতেও রয়েছে। বয়স্ক বাবা-মা এবং একসঙ্গে স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে ভ্রমণ করেন অনেকেই। তবে এমন ভ্রমণের বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন বয়স্কদের নিয়ে বেড়াতে গেলে কোথায় আপদ-বিপদ হয়, সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী ভাবে সামাল দেওয়া যাবে, এমন ভাবনা মাথায় থাকেই। প্রজন্ম ভিন্ন, চাহিদাও ভিন্ন। বেড়াতে গিয়ে আনন্দই না মাটি হয়, সে আশঙ্কাও থেকে যায়। আবার তরুণ প্রজন্মের ভাবনা আলাদা। তাঁদের কাছে যা উপভোগ্য, তা বয়স্ক দাদু-ঠাকুরমার জন্য নয়। তা হলে, কী ভাবে এই সফর হবে বা করা যাবে?
আরও পড়ুন:
স্থান বাছাই: তিন প্রজন্মের ভ্রমণের ক্ষেত্রে স্থান বাছাই গুরুত্বপূর্ণ। সকলেরই নিজস্ব চাহিদা আছে। সেই চাহিদাকে মান্যতা দিয়ে এমন জায়গা বাছবেন, যেখানে লুকিয়ে থাকে ভ্রমণের সাফল্য। ভ্রমণে অভিজ্ঞেরা বলেন, এমন জায়গা বেছে নিতে হবে, যাতে সকলেই নিজস্ব পরিসর উপভোগ করতে পারেন। সেটি কোনও সৈকতশহর যেমন হতে পারে, তেমন পাহাড়ি এলাকাও হওয়া সম্ভব। হোটেলের বদলে ভিলা, রিসর্ট বা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে নিলে অনেক সুবিধা হতে পারে। অবশ্যই রিসর্টের নিজস্ব বাগান, বেশ বড়সড় উন্মুক্ত চত্বর থাকলে বয়স্ক মানুষেরা সেই জায়গা ভাল করে উপভোগ করতে পারবেন।
পরিকল্পনা: বয়স্ক মানুষ সঙ্গে থাকবেন, তাই ঝটিকা সফর এড়ানোই ভাল। বদলে এমন ভাবে সফরসূচি সাজান, তা যেন নমনীয় হয়। কেউ বেশি ক্লান্ত বোধ করলে বা কোথাও যেতে না চাইলে তাঁকে রিসর্টে রেখে যাওয়া যায়। অথবা প্রয়োজন অনুসারে পরিকল্পনা পাল্টানো সম্ভব হয়।
যোগাযোগের ব্যবস্থা: পাহাড়ের মাথায় খুব সুন্দর একটি ভিলা পছন্দ হল থাকার জন্য, কিন্তু সেখানে যেতে গেলে খাড়াই পথে খানিকটা হলেও হাঁটতে হবে। তা কিন্তু এমন ভ্রমণের উপযোগী নয়। বয়স্ক বাবা-মা সেখানে ওঠা-নামা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন কি না, জানতে হবে। তার চেয়ে এমন স্থান বা থাকার জায়গা বেছে নিন, যেখানে হোটেল, রিসর্ট বা ভিলার দোরগোড়া পর্যন্ত গাড়ি যায়। কোনও জায়গায় বেড়ানোর সময় চট করে বয়স্ক মানুষেরাও গাড়িতে উঠতে পারেন।
খুদের পছন্দ হবে কী?
সন্তানের বয়স অনুযায়ী তার কাছে উপভোগ্য হবে এমন জায়গা বেছে নিন। সৈকতশহরে গেলেও, আশপাশে তার পছন্দের কোন কোন জায়গা আছে বা থাকতে পারে, বুঝে নিন। আবার পাহাড়ি এলাকায় এমন জায়গা বেছে নিতে পারেন যেখানে রোমাঞ্চক ক্রীড়া উপভোগের সুযোগ আছে। রোপওয়ে চড়ার অভিজ্ঞতা, বোটিং ইত্যাদি ছোটদের নতুন অভি়জ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করবে।
রান্নার ব্যবস্থা: বয়স্কেরা সঙ্গে থাকলে এমন ভিলা বা রিসর্ট ভাড়া নিতে পারেন, যেখানে রান্নার ব্যবস্থা আছে। অনেক জায়গা থাকে, যেখানে বাজার এবং রান্না করে দেওয়ার লোক পাওয়া যায়। বয়স্কদের বেশি তেল-মশলার খাবারে অসুবিধা হতে পারে। ছোটরা থাকলেও একই সমস্যা হতে পারে। খাবার রেঁধে দেওয়ার কেউ থাকলে অনেক সুবিধা। হতেই পারে বয়স্ক বাবা-মা শারীরিক কারণে সেই দিনটি আর ঘুরতে যেতে চাইছেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁরা রিসর্টে থেকে যেতে পারেন। খাবার থাকলে থাকতেও অসুবিধা হবে না।
থাকার জায়গা: পরিবারের অনেকে মিলে বেড়াতে গেলে সুবিধামতো ঘর বেছে নিন এক জায়গাতেই। সেই জায়গায় একটি বড়সড় খাবার ঘর বা টেবিল থাকা আবশ্যক, যেখানে সকলে একসঙ্গে বসে গল্প করতে পারবেন এবং খেতেও পারবেন। ছোট ছোট বিষয়ই সফরকে স্মরণীয় করে তোলে।