Advertisement
E-Paper

করোনা-পরীক্ষা থেকে ত্রাণবিলি, সবেতেই দক্ষ নাজিমা

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের তিন থেকে ছ’বছরের শিশুদের অনলাইনে অক্ষরজ্ঞাণ করানো হোক বা নাবালিকা বিবাহ রুখে দেওয়া— সব কাজেই তিনি পটু।

রাজীব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২১ ০৭:৩১
নাজিমা খাতুন।

নাজিমা খাতুন। নিজস্ব চিত্র।

লোকে তাঁকে ‘ঝোলের লাউ আর অম্বলের কদু’ বলে।

সন্দেহজনক করোনা রোগীদের লালারস পরীক্ষায় রাজি করানো থেকে শুরু করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে করোনা-প্রতিষেধক নিতে নারাজ প্রবীণদের ভ্যাকসিন দেওয়া— সব কাজেই পটু ডায়মন্ড হারবার ১ ব্লকের যাটমণিশা গ্রামের নাজিমা খাতুন।

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের তিন থেকে ছ’বছরের শিশুদের অনলাইনে অক্ষরজ্ঞাণ করানো হোক বা নাবালিকা বিবাহ রুখে দেওয়া, কিংবা বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করা— সব কাজ হেলায় করেন বছর বেয়াল্লিশের ওই বধূ। ইয়াসের পরে ব্লকের দুর্গতদের ত্রাণ দেওয়ার কাজেও ঝাঁপিয়েছেন তিনি। তাঁর নাম বলতেই বিডিও (ডায়মন্ড হারবার ১) মিলনতীর্থ সামন্তের প্রতিক্রিয়া, ‘‘নাজিমার পরিচিতি অনেক দূর বিস্তৃত। পিছিয়ে থাকা মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছেন। ওঁকে অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু কোনও কিছুতেই নাজিমা দমেননি।’’

নাজিমা তাঁর শ্বশুর প্রয়াত মহম্মদ সাবদার আলি মণ্ডলের নামে তৈরি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী। প্রায় ১৪ বছর ধরে ওই পেশায় যুক্ত তিনি। গত বছর লকডাউন শুরুর পরে থেকে কেন্দ্রে আসতে পারছে না শিশুরা। এই পরিস্থিতিতে অনলাইনকে মাধ্যম করে তাদের শিক্ষাদানের কাজ চালাচ্ছেন নাজিমা।

তাঁর কথায়, ‘‘আমার কেন্দ্রের ৩-৬ বছরের শিশুদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করি বছর খানেক আগে। তখনও অনলাইনে পড়াশোনা শুরু হয়নি কোনও জেলায়।

ওই গ্রুপের মাধ্যমে খেলার ছলে বাচ্চাদের অক্ষরজ্ঞান দিই। ছড়া বা ছবি এঁকে ফলের নাম, রং এবং অন্য অনেক জিনিস চেনাই। ভিডিয়ো করে সেই গ্রুপে পোস্ট করি। শিশুদের মায়েদেরও কিছু-কিছু হোমওয়ার্ক দিই।’’

২০০০ সালে আঠেরো পেরতেই সরিষা কামারপোলের বাসিন্দা নাজিমার বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়ির অনেকেই তাঁকে পড়াশোনা করতে দিতে চাননি। কিন্তু নাজিমা পাশে পান তাঁর শ্বশুর-স্বামীকে।

তার পরে ফকির চাঁদ কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হন। একই সঙ্গে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমাজসেবায় হাতেখড়ি দেন। নাজিমার কথায়, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিপুর ক্যাম্পাসে ক্লাস করতে যেতে হত। মাঝেমাঝে যেতে পারতাম না। হাজিরা কম থাকায় স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা দিতে দেননি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাই পড়াশোনায় পূর্ণচ্ছেদ পড়ে।’’ তখন একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে পড়ানো শুরু করেন তিনি। পরে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে দর্শনশাস্ত্রের আংশিক সময়ের শিক্ষক হন নাজিমা। ২০০৭ সালে পান অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর
চাকরি।

নাজিমা বলেন, ‘‘শিক্ষা শুরুর ঠিক পরেই শিশুরা সেন্টার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাই আমি অনলাইনে তাদের প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় যুক্ত রাখার জন্য গ্রুপ খুলি। অনেকে আমার এই উদ্যোগকে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ বলেছিলেন। আমি গায়ে মাখিনি সে সব কথা।’’

বছর দুই আগে পাড়ারই এক নাবালিকার পরিবার তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে প্রতিবাদ করেন নাজিমা। পঞ্চায়েত ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হস্তক্ষেপে বিয়ে বন্ধ হয়। নাজিমার অভিযোগ, এর পরে তাঁকে হুমকি দিতে থাকে ওই নাবালিকার পরিবার। ‘‘পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি এসে থাকতে হয়েছিল অনেক দিন।’’

বিডিও বলেন, ‘‘ওই ঘটনার পরে আমরা ওঁকে নিরাপত্তা দিয়েছিলাম। নাবালিকা বিবাহ রোধে ওঁর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’
গত বছর আছড়ে পড়ে করোনার প্রথম ঢেউ। নাজিমা বলেন, ‘‘উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও অনেকে লালারস পরীক্ষা করতেন না। তাঁদের কার্যত পায়ে ধরে পরীক্ষায় রাজি করাতাম। এখনও অনেকে করোনা-পরীক্ষায় রাজি হন না। তাঁদেরও রাজি করাই। তাঁদের আস্থা অর্জনের জন্য বাড়ি জীবাণুমুক্ত করে দিই। ওষুধ এনে দিই। অনেক কষ্ট করে তাঁদের রাজি করাতে হয়।’’ এখানেই শেষ নয়।

নাজিমার সংযোজন, ‘‘ভ্যাকসিন আসার পরে বহু মানুষ তা নিতে রাজি হচ্ছিলেন না। ওঁদের ধারণা ছিল, গিনিপিগ বানিয়ে তাঁদের উপরে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চলছে। পায়ে তেল দিয়ে তাঁদের রাজি করিয়েছিলাম। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে।’’

বিডিও বলেন, ‘‘এলাকায় কোনও মহিলা অসুবিধায় পড়লে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো এবং সমস্যার সমাধান করা নাজিমার নিত্যদিনের কাজ। মানুষকে সচেতন করতে ছোট ছোট গ্রুপ করে পথনাটক করা ছাড়াও গান ও নাচের মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর কাজ বছরের পরে বছর ধরে করে আসছেন নাজিমা।’’

ইয়াসের ঝড়ে প্লাবিত হয়েছে ব্লকের কিছু এলাকা। আজ, সোমবার সেই সব জায়গায় ত্রাণ দিতে যাবেন নাজিমা।

রবিবার দুপুরে তার প্রস্তুতি নেওয়ার ফাঁকে বললেন, ‘‘আমি হলাম গিয়ে ‘ঝোলের লাউ আর অম্বলের কদু’। সবেতেই আছি।’’

coronavirus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy