E-Paper

নিহত তৃণমূল নেতার বাইক থানার ভিতরেই, ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ ভাঙড়ে

গত ১০ জুলাই রাজনৈতিক কর্মসূচি সেরে রাতে বাইকে বাড়ি ফেরার পথে ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারের অদূরে খালধারের রাস্তায় তাঁকে গুলি করে, কুপিয়ে খুন করা হয়।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:১৯
নিহত তৃণমূল নেতা রেজ্জাক খানের মোটরবাইক রাখা ভাঙড়ের উত্তর কাশীপুর থানার ভিতরে।

নিহত তৃণমূল নেতা রেজ্জাক খানের মোটরবাইক রাখা ভাঙড়ের উত্তর কাশীপুর থানার ভিতরে। নিজস্ব চিত্র।

মূল দরজা পেরোতেই বাঁ দিকে সিভিক ভলান্টিয়ার এবং উর্দিধারীদের বসার জায়গা। আর একটু ভিতরে ঢুকলেই সোজাসুজি গরাদের লোহার গেট। তাতে অবশ্য বন্দির দেখা নেই, বরং নানা সামগ্রী ডাঁই করে রাখা। ডান দিকে গেলে ভাঙড় ডিভিশনের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অফিসারদের বসার অলিখিত ব্যবস্থা। কিন্তু থানার এই চেহারার সঙ্গে কেমন যেন বেমানান একটি মোটরবাইক। কালো রঙের সেই ‘রয়্যাল এনফিল্ড ৩৫০ ক্লাসিক’ মাঝ ঘরে দাঁড় করানো!

থানার মধ্যে বাইক কেন? এক দুপুরে উত্তর কাশীপুর থানার পুরনো ভবনে পৌঁছে দৃশ্যটা দেখে প্রশ্ন করা হয়েছিল কর্তব্যরত সিভিক ভলান্টিয়ারকে। জিভ কেটে তিনি বললেন, ‘‘ওরে বাবা! ওটা হাই-প্রোফাইল বাইক। থানায় কেন, ওটা সিন্দুকে রাখতে পারলে ভাল হয়। চোখে চোখে রাখতে হয়, এক দিনও ধুলো না ঝাড়লে রক্ষে নেই!’’

জানা গেল, কয়েক মাস আগে ভাঙড়ে খুন হওয়া, চালতাবেড়িয়ার তৃণমূল সভাপতি রেজ্জাক খানের বাইক সেটি। গত ১০ জুলাই রাজনৈতিক কর্মসূচি সেরে রাতে বাইকে বাড়ি ফেরার পথে ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারের অদূরে খালধারের রাস্তায় তাঁকে গুলি করে, কুপিয়ে খুন করা হয়। পরে বাইকটি পড়ে থাকতে দেখা যায় রেজ্জাকের মৃতদেহের পাশে। পুলিশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে এবং খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রের পাশাপাশি বাইকটি বাজেয়াপ্ত করে। তদন্ত এখনও চলছে। কলকাতা পুলিশ ভাঙড়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরে এটাই সব চেয়ে হাই-প্রোফাইল খুনের ঘটনা। বিজয়গঞ্জ বাজার থানা ভবন এখনও তৈরি না হওয়ায় পাশের উত্তর কাশীপুর থানা থেকেই সমস্তটা করা হচ্ছে। মামলাও লেখা হয়েছে সেখানেই। কিন্তু দু’টি থানার একটিই মালখানা। ফলে, বাইকটি নিয়ে ফ্যাসাদে পড়েছে পুলিশই।

কিন্তু মামলায় যুক্ত বাইক হয় ডাম্পিং গ্রাউন্ডে রাখা হয়, নয়তো থানা চত্বরেই রাস্তায় কোথাও থাকে। কলকাতায় একাধিক হাই-প্রোফাইল ঘটনায় এমন গাড়ি বা বাইক পুলিশ বাজেয়াপ্ত করলেও কখনওই থানার ভিতরে রাখতে দেখা গিয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না
দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনও অফিসারই। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ভাঙড়ে পুলিশকে এমনটা করতে হচ্ছে কেন? পুলিশের দাবি, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় বাইকটি নিহতের পরিবারকে ফিরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আবার যেমন-তেমন করে রাখাও যাচ্ছে না, ‘প্রভাবশালী’র বাইক বলে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভাঙড়ের এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, ‘‘এ কি আর যে সে মোটরবাইক! খুনের পরে এই বাইক নিয়ে সে কী কাণ্ড! বানতলার ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পাঠানো তো দূর, সেটি নাকি বাইরে খোলা আকাশের নীচেও রাখা যাবে না। একে নেতা-দাদার বাইক। তার উপরে তিনি নাকি এই বাইকেই এলাকায় ঘুরতেন। ফলে, তিনি না থাকলেও তাঁর বাইকের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেই নির্দেশ এসেছে।’’ পুলিশ সূত্রের দাবি, যখন-তখন নিহত ওই নেতার ছেলেরা এসে বাইকের খোঁজ নিয়ে যান। ধুলো পড়লেই নালিশ যায় থানার বাবুদের ঘরে। পড়ে থাকতে থাকতে চাকার হাওয়া কমলেও প্রশ্ন ওঠে। ফলে, প্রথম থেকেই আলাদা নজর দিতে বলা হয়েছে বাইকটির উপরে। আর এক অফিসারের মন্তব্য, ‘‘সিভিক ভলান্টিয়ার যখন যে ডিউটিতে থাকেন, তাঁকেও আলাদা করে নজর রাখতে বলা হচ্ছে।’’

পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষুব্ধ থানার এই ভবনের বাড়িওয়ালা অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বললেন, ‘‘কলকাতা পুলিশ নেওয়ার পর থেকে ভাড়া পাইনি। তার উপরে পাশে একটি থানা ভবন তৈরি করে এটিকে গুদামের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসারেরা বসছেন আর হাই-প্রোফাইল বাইক ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে।’’ তিনি জানান, ২০০৩ সালের ২৮ অগস্ট ভাঙড়ের উত্তর কাশীপুর এলাকার জন্য কাশীপুর থানার উদ্বোধন করেন তৎকালীন জেলা পুলিশের কর্তারা। অরূপের শ্বশুর শম্ভুনাথ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে তাঁর দোতলা বাড়ির একতলা ভাড়ায় নেওয়া হয়। কলকাতা পুলিশের হাতে আসার পরে থানার নাম হয় উত্তর কাশীপুর থানা।

বাড়িওয়ালার দাবি, এক কালে এলাকায় খুব ডাকাতি হত। তাই থানা হবে শুনে নিজেই ঘর দিতে এগিয়ে গিয়েছিলেন শম্ভুনাথ। বাড়ি তো নিরাপদ হয়েছেই, গ্রামেও নিরাপত্তা এসেছিল। এর পরে একাধিক ঘটনার সাক্ষী এই থানা ভবন। পাওয়ার গ্রিড আন্দোলনের সময়ে থানা ভবন জ্বালিয়ে দেওয়ার ভয়েও দিন কাটাতে হয়েছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অফিস চালানোর নামে ঐতিহাসিক থানা ভবনের এখনকার চেহারায় বিরক্ত তাঁরা।

উত্তর কাশীপুর থানার কোনও অফিসারই এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি। থানার ভিতরেই তৃণমূল নেতার বাইক রাখার ব্যাপারে ডিসি (ভাঙড়) সৈকত ঘোষকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার ঠিক জানা নেই।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cossipore Bhangar

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy