E-Paper

বাজি কারবারে কতটা রাশ, প্রশ্ন দত্তপুকুরে

বাড়িটি ভাড়া নিয়ে কেরামত আলি নামে এক ব্যক্তি বাজি তৈরির কারবার চালাত। বিস্ফোরণে সামসুল, কেরামত, তার ছেলে-সহ ন’জনের প্রাণ যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের গোটা দশেক বাড়ি।

ঋষি চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:১০
বাজি বিস্ফোরণের কয়েক বছর পরেও রয়ে গিয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপ। দত্তপুকুরের নীলগঞ্জ মোচপোলে।

বাজি বিস্ফোরণের কয়েক বছর পরেও রয়ে গিয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপ। দত্তপুকুরের নীলগঞ্জ মোচপোলে। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

২০২৩ সালের ২৭ অগস্ট দিনের স্মৃতি এখনও টাটকা আসুরা বিবি, জেসমিরা খাতুনদের। সেই স্মৃতি নতুন করে উস্কে দিয়েছে পাথরপ্রতিমার ঢোলাহাটে বাজি বিস্ফোরণে আট জনের মৃত্যুর ঘটনা। ২০২৩ সালের ওই দিন সকালে উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুর থানার মোচপোল পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা সামসুলের বাড়িতে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল ন’জনের।

বাড়িটি ভাড়া নিয়ে কেরামত আলি নামে এক ব্যক্তি বাজি তৈরির কারবার চালাত। বিস্ফোরণে সামসুল, কেরামত, তার ছেলে-সহ ন’জনের প্রাণ যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের গোটা দশেক বাড়ি।

আসুরা, জেসমিরা ফের শিউরে উঠেছেন ঢোলাহাটের ঘটনা দেখে-শুনে। জেসমিরা বলেন, ‘‘আমার শিশু সন্তান সে দিন দেওয়াল চাপা পড়েছিল। আমি বিকট শব্দ ও ধোঁয়ায় জ্ঞান হারাই।’’

এলাকায় বেআইনি ভাবে বাজি তৈরি হয়, সে কথা অজানা ছিল না আসুরাদের। গ্রামের অনেকে মনে করেন, যেখানেই বাজি তৈরি হয়, পুলিশেরও তাতে মদত থাকে।

আসুরার কথায়, ‘‘ওই ঘটনায় মৃতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেলেও যাদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি। নিজেরাই বাড়ি মেরামত করেছি আমরা।’’ সামসুল ও কেরামতের পরিবারের কেউ মন্তব্য করতে চাননি।

বাজি তৈরি নিয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ নন অনেকেই। স্থানীয় বাসিন্দা কাশেম গাজি বলেন, ‘‘কী বলতে কী বলে ফেলব, তা নিয়ে আবার চাপে পড়তে হবে!’’ কে দেবে চাপ? মুখে তালা পড়ে যায় কাশেমের।

মোচপোল পশ্চিমপাড়ায় যেখানে বিস্ফোরণে ন’জনের প্রাণ গিয়েছিল, সেখানে এখন আর বাজি তৈরি হয় না বলে জানালেন গ্রামের অনেকে। তা হলে কী বাজির কারবার পুরোপুরি বন্ধ এলাকায়? মোচপোলের কয়েক জন যুবক চাপাস্বরে জানালেন, বাজি কারখানা দেখতে চাইলে নারায়ণপুরে চলে যান, যা খুঁজছেন পেয়ে যাবেন। তবে সাবধানে কথা বলবেন। ওরা মারধর দিতে পারে। ওরা কারা? উত্তরে এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন সকলে।

মোচপোল পশ্চিমপাড়া থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে নারায়ণপুর। এলাকার অনেকে জানালেন, পুলিশ-প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বাজি তৈরি করেন। নিষিদ্ধ শব্দবাজি তৈরি করা হয় না। ঢোলাহাট কাণ্ডের পরে পুলিশ সতর্ক করে গিয়েছে আরও একবার। এক যুবকের কথায়, ‘‘এমনিতে আমরা বেআইনি কারবার কিছু করি না। তার উপরে ঢোলাহাটের ঘটনার পরে পুলিশি নজরদারি বেড়েছে। পুলিশ বলেছে, বেআইনি কোনও বাজি যেন তৈরি না করি।’’ দত্তপুকুর থানার পুলিশের একটি সূত্রেও দাবি করা হয়েছে, এলাকায় কড়া নজরদারি চলছে। লোকজনকে সচেতন করা হয়েছে। বেআইনি ভাবে বাজি তৈরির চেষ্টা করলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে এলাকায় কান পাতলে বোঝা যাবে, পরিস্থিতি এতটাও স্বচ্ছ নয়। এলাকার আম, মেহগনি, বাঁশ বাগানের ভিতরে বসে বাজি তৈরি হয়, জানালেন কেউ কেউ। তার অনেকটাই বেআইনি শব্দবাজি! বাগানগুলির বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, গাছের আড়ালে কী কাণ্ড ঘটছে। সূত্রের খবর, আনাজ খেতের ভিতরেও তৈরি করা হয় বাজি। মূলত, চকোলেট বোম, কালীপটকা-সহ বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ বাজি তৈরি হয়। সেই সব এলাকায় বাইরের অচেনা মুখের প্রবেশ নিষেধ বলে চুপিসাড়ে পরামর্শ দিলেন গ্রামেরই কেউ কেউ।

এলাকার এক যুবকের কথায়, ‘‘বাজি তৈরি করতে না দিলে বিভিন্ন দলের নেতা, পুলিশের পকেটে টাকা ঢুকবে না। তাই আড়ালে-আবডালে সবই চলছে আগের মতো।’’

বাজির বেআইনি কারবার নিয়ে বারাসত পুলিশ জেলার আধিকারিকেরা কেউ মন্তব্য করতে চাননি। এক আধিকারিক শুধু জানালেন, বেআইনি বাজির কারবারে অনেকটাই রাশ টানা গিয়েছে। নিয়মিত নজরদারি চলে।

কী বলছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা?
বিজেপির রাজ্য নেতা তাপস মিত্র বলেন, ‘‘পুলিশ ও তৃণমূলের মদতেই বাজি কারবার চলে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে তৃণমূল নেতা ও পুলিশের জন্য। বিরোধীরা এ ধরনের কোনও কারবারে জড়িত নয়।’’
বারাসত ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হালিমা বিবি বলেন, ‘‘ওখানে বেআইনি বাজি তৈরি হয়, তা বিস্ফোরণের আগে জানা ছিল না। শীঘ্রই বাজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সকলকে নিয়ে সচেতন করতে বৈঠক করব। পুলিশ-প্রশাসন সক্রিয় আছে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dattapukur

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy