Advertisement
E-Paper

পেরেকবিদ্ধ গাছের ক্ষত সারান মানিক ‘ডাক্তার’

গাছের গায়ে ক্ষত দেখলেই তা নিরাময়ের কাজে লেগে পড়েন। মই বেয়ে গাছে উঠে যান। সর্ব ক্ষণের সঙ্গী কাঁধব্যাগে সবর্দাই রাখা থাকে রেঞ্জ, কামড়ি-র হরেক সরঞ্জাম। সে সব দিয়েই অনেকটা ডাক্তারের মতো জখম গাছের শরীর থেকে সাবধানে পেরেক, লোহার শিক বার করে আনেন মানিক।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৯ ০২:০০
ব্যস্ত: স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে গাছ পরিষ্কার করছেন বিশ্বজিৎ ঘোষ (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র

ব্যস্ত: স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে গাছ পরিষ্কার করছেন বিশ্বজিৎ ঘোষ (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র

তিনি থাকেন নীরবেই।

বিশ্বজিৎ ঘোষ ওরফে মানিককে ক’ জন চেনেন? খুব অসুবিধা হবে না যদি বলা হয় খুব বেশি জন চেনেন না উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার বছর চল্লিশের এই বাসিন্দাকে। জগদ্দল পাথরের মতো বহু বছরের এক সামাজিক বদভ্যাসকে ঠেলে সরানোর মরীয়া চেষ্টা করছেন মানিক। গত বিশ বছর ধরে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীনও হচ্ছেন। তবু চুপচাপ নিজের কাজ করে চলেছেন মানিক।

কী বদভ্যাস?

সস্তায় প্রচারের কাজ সারার প্রয়োজন। অত এব দরকার একটি গাছের শরীর। শাখা হোক কিংবা কাণ্ড—গাছের গায়ে পেরেক পুঁতে তাতেই ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাইনবোর্ড। নিজেদের কর্মকাণ্ডের প্রচারের কাজে কোনও রকম ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই লোহার শিকে দলীয় পতাকা ঝুলিয়ে তা গাছের গায়ে গেঁথে দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি। নাইলনের দড়ি পেঁচিয়ে ডালে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে ‘তুক-তাক বশীকরণের’ পোস্টার। ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে গাছের শরীর। শুকিয়ে মরে যায় গাছ।

এমন কাজকর্মের বিরুদ্ধেই লড়ছেন মানিক। গাছের গায়ে ক্ষত দেখলেই তা নিরাময়ের কাজে লেগে পড়েন। মই বেয়ে গাছে উঠে যান। সর্ব ক্ষণের সঙ্গী কাঁধব্যাগে সবর্দাই রাখা থাকে রেঞ্জ, কামড়ি-র হরেক সরঞ্জাম। সে সব দিয়েই অনেকটা ডাক্তারের মতো জখম গাছের শরীর থেকে সাবধানে পেরেক, লোহার শিক বার করে আনেন মানিক। আবার পোষ্টার, পতাকা খুলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকে তা ফিরিয়েও দেন কম কথার মানুষটি।

বিনিময়ে প্রশংসার চেয়ে বেশি জোটে কটু বাক্য আর শাসানি-হুমকি। পার্টির ছেলেরা বাড়ি এসে হুমকি দেন। কলার চেপে নেতা বলেন, ‘‘আমাদের পতাকা খুলেছিস। এত সাহস! গাছ কী তোর বাপের।’’ সে সব শুনে নীরবে গাছের ‘চিকিৎসা’ করা মানিক সচরাচর প্রত্যুত্তর করেন না। ফেসবুকে সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করায় সবুজপ্রেমীরা গর্জে ওঠেন। পুরসভার চেয়ারম্যান মানিককে ঘরে ডেকে আশ্বাস দেন যে গাছে কেউ পতাকা লাগাবেন না। বিনা বাধায় নিজের কাজ করতে পারবেন মানিক। এতে খানিকটা আশ্বস্ত হন একটি বেসরকারি সংস্থার চাকুরে মানিক।

তবে উল্টো ঘটনাও ঘটে।

মানিক জানান, গাছতলায় অনেক জায়গাতেই ভ্যান কিংবা রিকশা স্ট্যাণ্ড থাকে। ওই চালকদের এক সময়ে বোঝানো হয়েছিল যে পেরেক, পলিথিন, নাইলনের দড়ি গাছের ক্ষতি করে। প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেননি। মানিক বলেন, ‘‘ এখন এমনই হয়েছে যে গাছের গায়ে কেউ কিছু বাঁধতে কিংবা পুঁততে এলে, তাঁদের রীতিমতো শাসানি দিয়ে তাড়া করছেন ভ্যান-রিকশার চালকেরা।’’

নিজের বাড়িতে দেখেছিলেন জবাফুল গাছের ডালে নাইলনের দড়ি বেঁধে কাপড় মেলা হত। দড়ি বাঁধা জায়গাটি পচে এক দিন সেই গাছ মরে গেল। শিশুর মতো কষ্ট পেয়েছিলেন মানিক। তার পর থেকেই আহত গাছের শুশ্রূষা করার নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। আপত্তি করেননি মানিকের মা গীতারানিদেবীও। ছেলেবেলা থেকেই ‘রেনেসাঁ’, ‘গবেষণা পরিষদ’ এর মতো বিজ্ঞান ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মানিক। দুই সংগঠনের কর্ণধার দীপককুমার দাঁ বলেন, ‘‘মানিকের মতো এখানে অনেকেই পরিবেশ রক্ষার কাজ করছেন।’’

মানিকের কথায়, ‘‘দিনে দিনে গাছের উপরে আঘাত বেড়েই চলছে। এত গাছের শুশ্রূষা একার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ তাই ভবিষ্যতে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে দলও গড়েছেন। অরিন্দম দে, নন্দদুলাল বসুর মতো শিক্ষকদের নিয়ে তৈরি দলের নাম, ‘পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি।’ আর স্কুল, কলেজ পড়ুয়াদের দলের নাম, ‘ইউথ ফোরাম।’

গত সপ্তাহে পঞ্চগ্রাম হাই স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে গাইঘাটায় যশোর রোডের দু’পাশের গাছ পরিষ্কার করছিলেন মানিক। মগডালে উঠে প্রবল উৎসাহে গাছের গা থেকে পেরেক তুলছিল ছেলেরা। এর পরের লক্ষ্য কী? এ দিক-সে দিক ছুটে গাছের শুশ্রূষার কাজের তদারকি করছিলেন মানিক। ব্যস্ত মানিকের সংক্ষিপ্ত জবাব,‘‘কাজ করছি। পরে কথা বলব।’’

অন্য রকম ব্যস্ততা।

Tree Gobardanga
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy