বাইরে ঠা ঠা রোদ। গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন পাঁচু বৈরাগী, খগেন মণ্ডলরা। ভোটের কথা উঠতেই বললেন, ‘‘আসল কথা কি জানেন, ভোট নিয়ে অতশত ভাবি না। ভোট হল নেশার মতো। বাপ-ঠাকুর্দা দিতেন। তাই ভোট দিতে যাই।’’
এমন নিরাসক্তি অতি বড় দার্শনিককেও হার মানায়।
ঘটনা হল, হিঙ্গলগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার এই সব মানুষ বিলক্ষণ বুঝে নিয়েছেন, ভোট দিয়ে তাঁদের ভাগ্য ফেরার নয়।
কিন্তু কেন? গাঁয়ের পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বছর বছর বাজেটে রেল, সেতুর কথা ওঠে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। আর তাই দেদার ঝুঁকি নিয়ে ভবানীপুরে কাঠাখালি নদীর এক হাঁটু জলে নেমে পারাপার চলে বছরের পর বছর। কাঠাখালি সেতুর উপর থেকে খুলে নেওয়া হয় আলো। তাতে দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত। লেবুখালি-দুলদুলির মধ্যে আজও সেতু হয়নি। সেতু হয়নি হাসনাবাদ এবং পার হাসনাবাদ-সহ ন্যাজাট ও কালীনগরের মধ্যে বেতনী নদীর উপরেও। সূর্যকান্ত বৈদ্য, কাজল মণ্ডল, কমল পাত্ররা একটা সার কথা বুঝেছেন, সুন্দরবনের এই প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হলে এলাকার উন্নয়ন হবে না।
২০১১ সালের পরিবর্তনের হাওয়াতেও হিঙ্গলগঞ্জ আসনটি ধরে রেখেছিল বামেরা। এ বারও এই আসনে সিপিআই প্রার্থী আনন্দ মণ্ডলই। তাঁর বাড়ি সন্দেশখালি। আনন্দবাবুর নামের পাশে ‘বহিরাগত’ তকমা সেঁটে প্রচার চালাচ্ছে তৃণমূল।
অনুন্নয়নের অভিযোগ নিয়ে কী বলবেন? বর্ষীয়ান এই নেতা তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে সময়ে বাড়িতে যাতায়াত ছিল হেমন্ত ঘোষালের মতো নেতাদের। পার্টি তাঁকে মার্কসবাদ, লেনিনবাদ নিয়ে পড়াশোনার জন্য রাশিয়ায় পাঠিয়েছিল। সন্দেশখালি ২ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি, পঞ্চায়েতের উপপ্রধানও ছিলেন। আনন্দবাবুর কথায়, ‘‘উন্নয়ন হয়নি, সে কথা ঠিক নয়। উন্নয়নের জন্যই তো এখানকার মানুষ আমাদের দীর্ঘ বছর ধরে জয়ী করেছেন। কথা দিয়েছিলাম, ক্ষমতায় এলে নদীবাঁধ, রাস্তা, বিদ্যুৎ হবে। সবই হয়েছে। জিতলে আরও হবে।’’
বাস্তবিকই, পিচ এবং কংক্রিটের একাধিক রাস্তাঘাট হয়েছে হিঙ্গলগঞ্জের গ্রামে। নদী উপচে জল যাতে গ্রামে ঢুকতে না পারে, সে জন্য দ্বীপভূমির বহু বাঁধ উঁচু করা হয়েছে। কিন্তু বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমের জন্য যে সেতুগুলির দরকার ছিল, তার দাবি অবশ্য অধরাই থেকে গিয়েছে। হাসনাবাদ-পার হাসনাবাদের মধ্যে ২০০৬ সালে সেতু তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। পরবর্তিতে দেখা যায় তার মূল দু’টি পিলারই অকেজো। ফলে ওই পিলার ভেঙে ফের নতুন পিলারের কাজ শুরু হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ঘটা করে হাসনাবাদ থেকে হিঙ্গলগঞ্জ রেললাইনের উদ্বোধন করেছিলেন মুকুল রায়। সেই প্রকল্প বাতিলের পরে ফের গত বাজেটে একই জায়গায় রেল প্রকল্প গড়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কাজ শুরুর কোনও লক্ষণ নেই। পার হাসনাবাদ থেকে লেবুখালি পর্যন্ত বাস চলাচল এবং সাহেবখালি নদী পেরিয়ে দুলদুলি থেকে যোগেশগঞ্জ অথবা সুন্দরবন-লাগোয়া সামসেরনগর পর্যন্ত বাস-ট্রেকার-অটো চললেও সন্ধ্যার পরে যানবাহনের দেখা মেলে না।
রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত সাহেবখালি নদীর উপরে দু’দুবার শিলান্যাস করলেও আজও সেতুর দেখা নেই। তবে সেতুর পরিবর্তে সপ্তাহে তিন দিন গাড়ি পারাপারের জন্য রাখা হয়েছে ভেসেল। সন্ধে নামলে তা বন্ধ।
আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল না মেলায় ক্ষোভ আছে। এ ছাড়া, এক ফসলি সুন্দরবন এলাকায় সেচের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ফলে বছরের বেশির ভাগ সময়ে এলাকার মানুষ কাজের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিতে বাধ্য হন ভিনরাজ্যে। ২০০৯ সালে আয়লায় যে ক্ষত হয়েছিল, তা এখনও ভোগাচ্ছে হিঙ্গলগঞ্জের বহু মানুষকে। অনেকে সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। অনেকের জমিতে নোনা ভাব এখনও না সরায় চাষ বন্ধ।
এই সব কথাই উঠে আসছে তৃণমূলের প্রচারে। প্রার্থী দেবেশ মণ্ডল বলেন, ‘‘নদীবাঁধ থেকে কংক্রিটের রাস্তা— কন্যাশ্রী থেকে যুবশ্রী, সবই তো করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ছাত্রীদের সাইকেল দিয়েছেন। কৃষি বাজার তৈরি হয়েছে। তাই এ বারে মানুষ অন্য মত দেবেন হিঙ্গলগঞ্জ আসনে।’’
বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন লাবণ্য মণ্ডল। এখনও প্রচারে তেমন গা ঘামাতে দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। সাংগঠনিক দুর্বলতা এখনও ভোগাচ্ছে প্রার্থীকে। তবে তাঁর মতে, ‘‘মানুষের বহু ক্ষোভ জমে আছে বামেদের উপরে। সারদা-নারদা নিয়ে তৃণমূলও রীতিমতো ঘেঁটে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপিকেই বিকল্প হিসাবে ধরে নেবেন বলে আমার আশা।’’
ভোট নিয়ে এমন নির্বিকল্প মানুষজন শেষমেশ কোন বিকল্প বেছে নেন, তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy