Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Tiger Attack

ভাইয়ের সামনেই দাদাকে তুলে নিয়ে গেল বাঘ

শোকার্ত: মৃত মৎস্যজীবী হরিপদর (ইনসেটে) পরিবার। নিজস্ব চিত্র

শোকার্ত: মৃত মৎস্যজীবী হরিপদর (ইনসেটে) পরিবার। নিজস্ব চিত্র

প্রসেনজিৎ সাহা
গোসাবা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২০ ০০:২৩
Share: Save:

ফের বাঘের হানায় মৃত্যু হল এক মৎস্যজীবীর। বুধবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে সুন্দরবনের ঝিলা ১ নম্বর জঙ্গলে। নিহত মৎস্যজীবীর নাম হরিপদ মণ্ডল(৩১)। এ দিন সকালে ভাই ও অন্য দুই সঙ্গীকে নিয়ে গোসাবার কুমিরমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের লেনিন কলোনি থেকে মাছ, কাঁকড়া ধরার জন্য সুন্দরবনের জঙ্গলে গিয়েছিলেন হরিপদ। সেখানেই সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ বাঘের হামলার মুখে পড়েন হরিপদ।

এ নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে বাঘের হানায় মোট চারজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটল সুন্দরবনের জঙ্গলে। একাধিকবার সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প ও বন দফতরের তরফ থেকে মৎস্যজীবীদের সংরক্ষিত এলাকায় মাছ, কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার জন্য নিষেধ করা হলেও তাঁরা কিছুতেই শুনছেন না বলে অভিযোগ। ফলে বিপদ ঘটছেই। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ফিল্ড ডিরেক্টর তাপস দাস বলেন, “বন দফতর ও ব্যাঘ্র প্রকল্পের তরফ থেকে একাধিকবার সচেতন করা হচ্ছে মৎস্যজীবীদের। সুন্দরবনের কোর এলাকায় যাতে মৎস্যজীবীরা না যান, শুধুমাত্র নদীতে নৌকায় বসেই যাতে মাছ-কাঁকড়া ধরেন, এমন নির্দেশের পরেও মৎস্যজীবীরা জঙ্গলে নেমে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন।”

অন্য বছরের তুলানায় চলতি বছরে বাঘের হামলায় মৃত্যুর ঘটনা যথেষ্ট বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, গত ন’মাসে বাঘের হামলায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ষোলো জনের। লকডাউনের সময় থেকে গত ছ’মাসে মৃত্যু হয়েছে তেরো জনের। লকডাউন ও করোনা পরিস্থিতিতে এই সংখ্যাটা বেড়েছে। নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগ মৎস্যজীবীই সরকারি অনুমতিপত্র ছাড়াই জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের হামলার মুখে পড়েছেন বলে দাবি বন দফতরের। বন দফতর সূত্রের খবর, বুধবার যে মৎস্যজীবীদের দলটি মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও কোনও সরকারি অনুমতিপত্র ছিল না।

বন দফতর ও স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন ভোরে হরিপদ নিজের ভাই অনিল মণ্ডল ও অন্য দুই সঙ্গী ভোলানাথ মণ্ডল ও হিমাংশু মণ্ডলকে নিয়ে ঝিলা ১ নম্বর জঙ্গলে রওনা দেন। সেখানে পাখিরালয় খালে সকাল ৭টা নাগাদ পৌঁছন তাঁরা। খালের মধ্যে নৌকা নোঙর করে চারজনেই জঙ্গলের মধ্যে নেমে কাঁকড়া ধরতে শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি বাঘ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে হরিপদর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁর ঘাড়ে কামড় বসিয়ে জঙ্গলের মধ্যে টানতে টানতে নিয়ে যায়। দাদাকে বাঘে ধরেছে দেখে অনিল ও তাঁর অন্য সঙ্গীরা কাঁকড়া ধরার শিক নিয়ে বাঘের দিকে তেড়ে যান। কিন্তু সাহস করে বাঘের মুখ থেকে হরিপদকে ছাড়িয়ে আনতে পারেননি। তড়িঘড়ি সকলে নৌকা নিয়ে গ্রামে ফেরেন। গ্রামবাসীকে ঘটনার কথা জানান। এরপর গ্রাম থেকে জনা কুড়ি গ্রামবাসী ঘটনাস্থলে গিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে উদ্ধার করেন হরিপদর ছিন্নভিন্ন দেহ। চোখের সামনে দাদাকে বাঘে ধরলেও তাঁকে বাঁচাতে না পারার আফসোস যাচ্ছে না অনিলের। তিনি বলেন, “সব কিছু যেন আচমকাই হয়ে গেল। দাদাকে যখন বাঘে ধরল সকলে মিলে বাঘের দিকে তেড়ে গেলাম। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না।”

স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন হরিপদর স্ত্রী অষ্টমী। তিনি অন্তঃসত্ত্বা। তাঁদের একটি সাত বছরের পুত্র সন্তানও রয়েছে। এই অবস্থায় কী ভাবে তাঁদের আগামী দিনগুলি চলবে সেটাই বড় প্রশ্ন। ঘটনার খবর পেয়ে কুমিরমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দেবাশিস মণ্ডল হরিপদর বাড়িতে যান। তিনি পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধান বলেন, ‘‘ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ দেওয়া হয়েছে। সরকারি ভাবে রেশন থেকে বিনামূল্যে চালও দেওয়া হচ্ছে। তবুও কিছু মানুষ বাড়তি রোজগারের আশায় জঙ্গলে যাচ্ছেন।’’

মৎস্যজীবীদের দাবি, সে ভাবে বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় বিপদের ঝুঁকি জেনেও এই পেশাতেই মানুষ বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। তা ছাড়া, করোনা সংক্রমণের জেরে ভিন রাজ্য থেকে কাজ হারিয়ে এলাকায় ফিরেছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক। সংসার চালাতে তাই জল জঙ্গলের উপরেই ভরসা করছেন তাঁরা। মৎস্যজীবী সুদর্শন সর্দার, কানাই মণ্ডল, শকুন্তলা মিস্ত্রিরা বলেন, “এলাকায় কাজ নেই। কাঁকড়া ধরতে পারলে ভাল রোজগার হয়। তাই বিপদ জেনেও জঙ্গলে যাই।”

এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই বন দফতরের সঙ্গে যৌথ ভাবে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কুমিরমারি গ্রাম পঞ্চায়েত। বিনা অনুমতিতে জঙ্গলে গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tiger Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE