আবর্জনায় ঢেকেছে খাল। জল সরবে কী ভাবে!
শহরের জন্মের ইতিহাস একশো বছরেও বেশি পুরনো। জনসংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি সবই হয়েছে। কলকাতার সঙ্গে রেল ও সড়ক পথে যোগাযোগ এখন তিন দিন নয়, তিন-চার ঘণ্টায় সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু নাগরিক স্বাচ্ছ্যন্দের অভাব বিস্তর।
কাকদ্বীপ শহরটা রীতিমতো নদীনালা ঘেরা। তা সত্ত্বেও নিকাশি নালার অভাবে একটু বৃষ্টি হলেই ভাসতে হয় বাসিন্দাদের। বহু নালা-নর্দমা বেআইনি নির্মাণের ফলে বন্ধ। যত্রতত্র দোকান, বাড়ি গজিয়ে ওঠায় শহরটা হাঁসফাঁস দশা। কাকদ্বীপ শহরের প্রাণকেন্দ্রে নিয়মিত যানজটে নাজেহাল বাসিন্দারা। অভিযোগ আছে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়েও।
স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নিকাশি সমস্যা দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রাচীন নিকাশি ব্যবস্থার উপরেই এখনও ভরসা করে আছে শহর। পরিকল্পনা মাফিক নতুন কোনও ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। তার উপরে জবরদখলের জেরে বহু নালাই বন্ধ। নিকাশি খালগুলিরও সংস্কার হয় না দীর্ঘ দিন। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বেআইনি নির্মাণ। এ সবের ফাঁদে পড়ে নিকাশি আরও বেহাল হচ্ছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাকদ্বীপ শহরের কাছাকাছি মূল প্রতাপাদিত্য, রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ পঞ্চায়েত এলাকার সংযোগ খাল ও নিকাশি নালার উপরে বেআইনি নির্মাণ হওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া উচিত।
সাগর, পাথরপ্রতিমা নামখানা এলাকার বাসিন্দারাও নিত্য নানা প্রয়োজনে মহকুমা শহরে আসেন। ভিড়ের চাপ বাড়লেও রাস্তাঘাটের সে ভাবে সংস্কার না হওয়ায় এবং যত্রতত্র বেআইনি দখল করে বাড়ি-দোকান গজিয়ে ওঠায় শহরটা যান চলাচলের পক্ষে অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কাকদ্বীপ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই যানজটে আটকে পড়েন পর্যটকেরাও। তার উপরে আছে হকারদের দৌরাত্ম্য। প্রশাসন যদি প্রয়োজন মতো ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করে এবং রাস্তাঘাট সংস্কার ও সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করে, তা হলে এই সমস্যা মিটতে পারে বলে নাগরিকদের বিশ্বাস।
স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়েও শহরবাসীর ক্ষোভ ভুরি ভুরি। কাকদ্বীপ গ্রামীণ হাসপাতালটি ২০০৪ সালে মহকুমা হাসপাতালে উন্নীত হয়। নামকরণে বড় স্বীকৃতি পেলেও পরিষেবার হাল কী হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমানে ১০০ শয্যার হাসপাতাল হলেও ডেলিভারি রোগী ছাড়া অন্য কোনও বিপজ্জনক রোগী গেলেই সোজা ডায়মন্ড হারবার বা কলকাতায় রেফার করাটা কার্যত দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। অধিকাংশ রোগের কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। একটাই মাত্র অ্যাম্বুল্যান্স। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি টাকা দিয়ে রোগীর পরিবারকে বাইরের অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করতে হয়। এখনও কোনও ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরি হয়নি। জরুরি রোগীর ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলেই নির্ভর করতে হয় প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের ডায়মন্ড হারবার জেলা হাসপাতালের উপরে। এত দিনেও তৈরি হয়নি মর্গ। পানীয় জলের ব্যবস্থা, শৌচাগার, নিকাশি সব কিছুর ক্ষেত্রেই এই হাসপাতাল স্থানীয় মানুষের সমস্যা মেটাতে ব্যর্থ বলে অভিযোগ। হাসপাতাল ভবন-লাগোয়া আবর্জনার স্তূপ থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। মশা-মাছির উপদ্রব বাড়ে। সরকারি ওষুধ প্রয়োজন মতো পাওয়া যায় না। সেলাইনটুকুও অনেক সময়ে বাইরে থেকে কিনতে হয় রোগীর পরিবারকে। স্থানীয় বাসিন্দা অমিত জানা, সমর মণ্ডলদের অভিযোগ, রোগীদের খাবার দেওয়া হয় নিম্নমানের। চিকিৎসকেরা বেশির ভাগই প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যস্ত। কাকদ্বীপ ছাড়াও সাগর, পাথরপ্রতিমা, নামখানা এলাকার বাসিন্দারা এই হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল। রোগীর চাপ প্রচুর। কিন্তু উপযুক্ত পরিষেবা মেলে কই!
এখনও কোনও কাজেই এল না স্পোর্টস কমপ্লেক্স।
হাসপাতালের পরিকাঠামো নিয়ে সুপার উজ্জ্বলেন্দু মণ্ডল বলেন, “পানীয় জলের কোন সমস্যা নেই। তবে জঞ্জাল ফেলা নিয়ে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। খাবারের গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য ঠিকাদারকে সর্তক করা হয়েছে। মর্গের পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে।” বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠানোর জন্য উপর মহলে আবেদন জানানো হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
নাগরিকদের চাহিদা আছে আরও। এলাকায় খেলাধূলার উন্নতির জন্য সুন্দরবন উন্নয়ন পর্যদ থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালে বাম জমানায় স্টিমারঘাট গ্রামের কাছে ১৩ একর জমি নিয়ে তৈরি হয়েছিল কাকদ্বীপ স্পোর্টস কমপ্লেক্স। ওই বছর ঘটা করে উদ্বোধনের দিন তৎকালীন ক্রীড়া ও সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়-সহ কলকাতার দিকপাল ফুটবলারা উপস্থিত ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, ওই কমপ্লেক্সে এলাকার ছেলে-মেয়েদের ফুটবল, ভলিবল, কবাডি, টেবিল টেনিস-সহ নানা খেলার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু উদ্বোধনটুকুই সার। এখন কমপ্লেক্সে গরু-ছাগল চরে বেড়ায়। অফিসঘর খালি পড়ে থাকায় দুষ্কৃতীরা জানালা-দরজা খুলে নিয়ে যাচ্ছে।
বহু বছরের এই শহরে সমস্যার শেষ নেই। বড় সভা, অনুষ্ঠান করার মতো কমিউনিটি হল নেই কাকদ্বীপে। বাম জমানায় বাংলোমাঠ এলাকায় একটা কমিউনিটি হল নির্মাণের কাজ শুরু হলেও তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। শিশুদের খেলাধূলার জন্য কোনও পার্ক তৈরি হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা, পেশায় আইনজীবী কল্লোল দাসের অভিযোগ সাগর, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, ঢোলাহাট পাঁচটি থানা এলাকার বাসিন্দাদের সমস্ত আইনি সাহায্যে নিতে কাকদ্বীপ আদালতে নির্ভর করতে হয়। অথচ আজ পর্যন্ত সংশোধনাগার তৈরি হল না। ভাল গ্রন্থাগারের অভাব আছে। গড়ে ওঠেনি দমকলকেন্দ্র। শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি বসেনি। চুল্লিতে শবদাহ করতে হলে ছুটতে হয় মন্দিরবাজারের দক্ষিণ বিষ্ণুপুরে শ্মশান বা কালীঘাটে।
পুরসভা হিসাবেও কাকদ্বীপের নাম প্রস্তাবিত সরকারি তালিকায় আছে। পুরসভা হিসাবে উন্নীত হলে যদি এলাকারও উন্নয়ন হয়, সে দিকেই তাকিয়ে কাকদ্বীপবাসী। সুন্দরবন উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা বলেন, “স্পোর্টস কমপ্লেক্স সংস্কার এবং বাকি সমস্ত কিছু বিষয়ে ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিছু কাজ শুরুও হয়েছে।” কিন্তু মন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা জানাতে না পারায়, হতাশ শহরবাসী।
স্পোর্টস কমপ্লেক্স সংস্কার এবং বাকি সমস্ত কিছু বিষয়ে ধীরে ধীরে
ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিছু কাজ শুরুও হয়েছে।
মন্টুরাম পাখিরা
(সুন্দরবন উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী)
কেমন লাগছে আমার শহর?
আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-কাকদ্বীপ’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১।
ফেসবুকেও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। www.facebook.com/anadabazar.abp
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy