দুই স্কুল ছাত্রকে অপহরণ করে খুনের পর মুক্তিপণ দাবি। — নিজস্ব চিত্র।
খুনের লক্ষ্যেই বাগুইআটির দুই কিশোরকে অপহরণ করা হয়েছিল। মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে এমনটাই দাবি করলেন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান বিশ্বজিৎ ঘোষ। তাঁর দাবি, ওই দুই কিশোরকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়নি। পাশাপাশি, ২২ তারিখ অপহরণের পর থেকে ঘটনাক্রম কোন পথে এগিয়েছে, তারও ব্যাখ্যা দেন তিনি। টাকাপয়সা সংক্রান্ত কিছু বিষয় সামনে এলেও, পুলিশের ধারণা, অন্য কোনও কারণেই খুন করা হয়েছে। তবে এর সঙ্গে মুক্তিপণের কোনও সম্পর্ক নেই।
বাগুইআটির দুই স্কুল পড়ুয়া অতনু দে এবং অভিষেক নস্কর গত ২২ অগস্ট থেকে নিখোঁজ ছিল। পুলিশের দাবি, ২৪ তারিখ বাগুইআটি থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি হয়। তার পরেই পুলিশ তদন্তে নামে। নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ১৩ দিন পর মঙ্গলবার উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট হাসপাতালের মর্গে দু’টি দেহ শনাক্ত হয়। যার একটি অতনু এবং অন্যটি অভিষেকের বলে জানা গিয়েছে। বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান যদিও এক জনকে শনাক্ত করা গিয়েছে বলে জানিয়েছেন।
এই অপহরণ এবং খুনের ঘটনায় পুলিশ মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে সত্যেন্দ্র চৌধুরীর নাম উল্লেখ করেছে। বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধানের দাবি, সত্যেন্দ্রর সঙ্গে অতনুর পরিবারের পুরনো সম্পর্ক রয়েছে। ২২ অগস্ট স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পরেই সত্যেন্দ্রর ফোন পায় অতনু। কী কারণে অতনুকে ফোন করেছিল সত্যেন্দ্র? গোয়েন্দাপ্রধানের দাবি, একটি বাইক কেনার জন্য সত্যেন্দ্রকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিল অতনু। কিন্তু সত্যেন্দ্র সেই বাইক কিনতে গড়িমসি করছিলেন। ওই দিন অতনুকে ফোন করে তিনি বাইক কেনার জন্য ডাকেন। অতনু বাইক কেনার জন্য অভিষেককেও সঙ্গে নেয়। সত্যেন্দ্র একটি গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। সেই গাড়িতেই সকলে মিলে রাজারহাটে একটি বাইকের শোরুমে যান। কিন্তু বাইক পছন্দ হয়নি বলে কিনতে চাননি সত্যেন্দ্র। এর পর তাঁরা শোরুম থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে বাসন্তী হাইওয়ে ধরেন। বিধাননগর পুলিশের দাবি, রাত ৯টা-১০টার মধ্যে গাড়ির মধ্যেই দুই কিশোরকেই গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করা হয়। গাড়িতেই ছিল দড়ি। তা দিয়েই গলায় ফাঁস দেওয়া হয়।
বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধানের দাবি, ২৪ তারিখ তাঁরা অভিযোগ পেয়েই বিভিন্ন থানাকে সতর্ক করেন। কিন্তু সোমবার পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। সোমবার অভিজিৎ বসু নামে এক জনকে এই ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসাবে গ্রেফতার করা হয়। বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘অভিজিৎকে গ্রেফতার করে আমরা জানতে পারি, ওই দুই কিশোরকে খুন করা হয়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার তিনটি থানা, বারুইপুর পুলিশ জেলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং বসিরহাট পুলিশ জেলাকে সতর্ক করি। কোনও মর্গে শনাক্তহীন অবস্থায় কোনও দেহ আছে কি না! এর পরেই জানা যায় বসিরহাটে তিনটি অশনাক্ত দেহ রয়েছে। মঙ্গলবার তারই একটিকে অতনুর বলে শনাক্ত করেছে তার পরিবার। অভিষেকের দেহ শনাক্তকরণের কাজ চলছে।’’
বিশ্বজিতের দাবি, অভিজিতের কাছেই তাঁরা জানতে পারেন, ২২ তারিখ রাতে খুন করার পর ওই দুই কিশোরের দেহ বাসন্তী হাইওয়ের ধারে দু’টি জায়গায় ক্যানেলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। বসিরহাট পুলিশ জেলার সুপার জোবি থমাসও জানিয়েছেন, ২৩ অগস্ট সন্ধ্যায় ন্যাজাট থানা এলাকায় এক কিশোরের দেহ উদ্ধার হয়। অন্য এক কিশোরের দেহ ২৫ অগস্ট পাওয়া যায় মিনাখাঁ থানা এলাকায়। সেই দেহ দু’টিই বসিরহাট হাসপাতালের মর্গে রাখা ছিল। ওই দেহ দু’টি শনাক্ত করা হয়নি এত দিন।
কিন্তু খুন করার পরেও অতনুর পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসে। এসেছিল এসএমএসও। সেখানে প্রথমে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। পরে সেই অঙ্ক বাড়িয়ে ১ কোটি চাওয়া হয় বলে বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধানের দাবি। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে ৫০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। তখন ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চান পরিবারের লোকজন। এর পরে ১ কোটি চাওয়া হয়। তখনও দেখা করতে চায় পরিবার। তার পর আর ফোন আসেনি।’’ বিশ্বজিতের ব্যাখ্যা, ‘‘এটা খুনের উদ্দেশ্যেই অপহরণ। কারণ, মুক্তিপণ চেয়ে যারা ফোন করে, তারা সাধারণত এত দ্রুত পণের অঙ্ক বদল করে না।’’ তাঁর ধারণা, আসলে এ সব করা হয়েছিল পরিবার এবং পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে। বিশ্বজিতের দাবি, মোট তিন বার মেসেজ পাঠানো হয়েছিল। নিহত অতনুর পরিবারের দাবি, প্রথমে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল। পরে সেই অঙ্ক বাড়িয়ে এক কোটি টাকা করা হয়। তদন্তকারীরা মনে করছেন, ফোন করে ‘অস্বস্তিকর’ পরিস্থিতি এড়াতে চেয়েছিলেন সত্যেন্দ্র। তাই তিনি মনে করেন, মেসেজ পাঠানোই ‘নিরাপদ’ হবে।
দুই কিশোরের খোঁজ না পেয়ে থানায় অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন অতনুর বাবা অভিজিৎ দে। তিনি পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। মঙ্গলবার অভিজিৎ বলেন, ‘‘প্রথমে আমি নিউটাউন থানায় যাই। পুলিশ ফোন নম্বর ধরে ওদের ট্র্যাক করতে শুরু করে। ইতিমধ্যে মুক্তিপণ হিসাবে এক কোটি টাকা দিতে হবে বলে মেসেজ আসে। আমার ভাগ্নের বাড়িতেও মুক্তিপণ চাওয়া হয়। তবে কোনখানে টাকা দিতে হবে তা ওরা কিছু বলেনি। কারণ ওরা খালি মেসেজ পাঠিয়েছে। পুলিশ প্রথমে ভেবেছিল ওরা কোথাও ঘুরতে গিয়েছে। ১০-১২ দিন পরে আমার ছেলের মোবাইল উদ্ধার হয়। আমাদের এক কোটি টাকা অপহরণের মেসেজ আসে ফোনে। পুলিশ সে ভাবে সহযোগিতা করেনি।’’
প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা, বাইক কেনার জন্য ৫০ হাজার টাকা নিয়েই অতনুর সঙ্গে সত্যেন্দ্রর বিবাদের সূত্রপাত। কিন্তু তার মধ্যে অভিজিৎ বসু কোথা থেকে এলেন, তা বুঝতে পারছেন না তদন্তকারীরা। একই সঙ্গে অভিজিৎকে জেরা করে যে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই শামিম আলি, শাহিন মোল্লা এবং দিব্যেন্দু দাসই বা কোথা থেকে এলেন, তা নিয়ে পুলিশ এখনও ধন্দে। শুধু বাইক কেনা— অতনু-অভিষেক হত্যার পিছনে এই ‘যৎসামান্য’ উদ্দেশ্য মেনে নিতে পারছেন না তদন্তকারীরা। তাই সত্যেন্দ্রকে দ্রুত গ্রেফতার করতে চাইছেন তাঁরা। তদন্তকারীদের দাবি, আরও এক জন রয়েছেন এর পিছনে। খোঁজ চলছে তাঁরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy