ঝাঁকে ঝাঁকে। বর্ধমান স্টেশন রোডে উদিত সিংহের তোলা ছবি।
শহর এখন টোটোময়।
যে কোনও দিন দুপুরে হোক বা সন্ধ্যা, রাস্তায় বেরোলেই দেখা যায় শয়ে শয়ে টোটো চলছে।
কখনও টোটো চালকদের সঙ্গে পথচলতি মানুষজনের কথা কাটাকাটি, কখনও চালকের অভব্য আচরণের অভিযোগে যাত্রীদের সঙ্গে বচসাও লেগেই রয়েছে। পুর প্রশাসন রুট নির্দিষ্ট করে টোটো নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দিলেও হাতেকলমে তার কিছুই হচ্ছে না বলেও অভিযোগ বর্ধমানের বাসিন্দাদের।
শহর ঘুরে দেখা যায়, জিটি রোডে টোটো চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু মেহেদিবাগান থেকে গোলাপবাগ মোড় পর্যন্ত দাপটে চলছে টোটো। স্টেশন রোড এলাকাও টোটোর দখলে। পরিস্থিতি এমনই যে বাইরে থেকে কেউ এলে শহরে অন্য যানবাহন চলে কি না, সে প্রশ্নও উঠতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অনেক দিন টোটোর জন্য জেলখানা মোড়ে কয়েদি ভর্তি পুলিশ ভ্যান আটকে পড়ে। ভ্যান থেকে নেমে পুলিশ টোটো নিয়ন্ত্রণ করছে, এমন দৃশ্যও হামেশাই দেখা যায়। পার্কাস রোডে গেলে দেখা যায় ৬ জন যাত্রীকে নিয়ে হুশ করে বেড়িয়ে যাচ্ছে টোটো। বড়বাজার এলাকায় আবার পুরসভার আবর্জনা ফেলার গাড়ির সঙ্গে টোটোর ধাক্কা লেগে যাওয়ায় আতঙ্কে টোটো থেকে নেমে ছুটতেও দেখা যায় যাত্রীদের।
টোটোর দাপাদাপি থেকে রেহাই নেই হাসপাতাল চত্বরেরও। গেটের সামনে টোটোর সারি এমনই যে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স বা অন্য গাড়ি ঢুকতেও সমস্যাও লেগেই থাকে। জিজ্ঞেস করা হলে টোটো চালকদের স্পষ্ট জবাব, ‘‘এ রকমই হয় প্রতিদিন। অসুবিধা হলে হবে, কী করা যাবে।”
টোটো নিয়ে অভাব-অভিযোগ এ শহরে নতুন নয়। বাসিন্দারা বারবার অভিযোগ জানানোয় জেলা প্রশাসন দাবি করেছিল, পুজোর পর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের দাবি, নিয়ন্ত্রণ তো দূর, বেআইনি টোটোর দাপটে শহর কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, প্রশাসন ও টোটো চালকদের মধ্যে ‘কুমিরডাঙা’ খেলা হচ্ছে। প্রশাসনের কর্তারা ও পরিবহণ দফতর অভিযান চালালেই রাস্তায় টোটোর সংখ্যা কমে যায়। অভিযান শেষ হলেই হু হু করে বাড়তে থাকে টোটো। অথচ টোটোয় রাশ টানাতে গত অগস্টে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে পরিবহণ দফতর একটি বৈঠক করে। বৈঠকে পুরসভার কর্তারাও হাজির ছিলেন। সেখানে শহরে ৭৩টি রুট ঠিক করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ওই রুটে দিনে ১০টি ও রাতে ১০টি করে টোটো চলবে। দিন ও রাতের টোটোর রং আলাদা হবে। প্রতি ৬ মাস অন্তর টোটো চালানোর সময় বদলানো, টোটো চালকদের নিজস্ব পোশাকের কথাও বলা হয়। টোটো রেজিস্ট্রেশন করানোর জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে টোটো চালকদের আহ্বানও করা হয়। তবে ১৪৬০টি টোটো রেজিস্ট্রেশনের জন্য মাত্র ২৩০০টি আবেদন পত্র জমা পড়ে। সেখান থেকে ৮৬৮ জনকে রেজিস্ট্রেশনের চিঠি দেয় পরিবহণ দফতর। তার মধ্যে আবার ৫৭৫ জন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন। শেষমেশ, ৫৬৫টি টোটোর রেজিস্ট্রেশন করায় পরিবহণ দফতর।
পরিবহণ দফতরের কর্তারা মেনে নিয়েছেন, শহরে কমপক্ষে চার হাজার বেআইনি টোটো চলছে। যার বেশির ভাগ তৈরি হচ্ছে বর্ধমান শহরেই। যেগুলিকে কোনও মতেই ‘ই-রিকশা’ বলে ছাড় দেওয়া যায় না। ফলে টোটো কারখানাতেও মাঝেমধ্যে হানাও দেয় পরিবহণ দফতর। তাতেও লাভ হচ্ছে না। বাসিন্দাদের দাবি, নির্দিষ্ট রুট মা মেনে শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে টোটো। টোটো স্ট্যান্ড সেভাবে না থাকায় রাস্তার উপরেই টোটো দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে প্রতিদিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, স্টেশন রোড, পার্কাস রোড, খোসবাগান, ফ্রেজার অ্যাভিনিউ, বড়বাজার, রাজবাটি চত্বর যানজটটাই রুটিন। বাদামতলার বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মচারী স্বদেশ রায়ের কথায়, “টোটোর জন্য যানজট বাড়ছে। নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার।” টাউনহল পাড়ার আশিস দাসও বলেন, “রাস্তায় পা রাখলেই টোটোয় হোঁচট খেতে খেতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হয়। যন্ত্রণার একশেষ।” কালনা রোডের গৃহবধূ নিলীমা পাল মনে করেন, “পরিকল্পনার অভাবের জন্য টোটো আমাদের কাছে আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে উঠছে।”
এরপরেও বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) নিখিল নির্মলের বলেন, “বেআইনি টোটো ধরার জন্য নিয়মিত অভিযান চলছে।” আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক (আরটিও) মহম্মদ আবর আলমেরও দাবি, “আমরা রুট পারমিট দিতে শুরু করেছি। রুট চালু হয়ে গেলে টোটো নিয়ন্ত্রনে আসবে।”
কিন্তু কবে, তা নিয়ে মুখে কুলুপ কর্তাদের। ততদিন ‘টোটো-রাজ’ই ভবিতব্য বর্ধমানের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy