ঘটনা ১: কেতুগ্রাম ২ ব্লকের বিল্লেশ্বর পঞ্চায়েতের বাসিন্দা নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে গ্রাম থেকে একটি গাড়িতে তুলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই গাড়িতে পাত্র ও তাঁর আত্মীয়স্বজনেরাও ছিলেন। ধাওয়া করে কয়েক কিলোমিটার দূরে রসুই বাসস্টপে গাড়িটিকে আটকায় পুলিশ ও পঞ্চায়েত।
ঘটনা ২: পূর্বস্থলীর অন্নদাপ্রসাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই যমজ ভাই ২০২৩ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে স্কুল থেকে ‘ট্রান্সফার সার্টিফিকেট’ (টিসি) নেয়। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়নি। বিডিও (পূর্বস্থলী ২) তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দু’জনকেই বুধবার পূর্বস্থলীর নীলমনি ব্রহ্মচারী ইনস্টিটিউশনের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তির ব্যবস্থা করেন।
ঘটনা দু’টি বিচ্ছিন্ন নয়। প্রশাসন ও চাইল্ড হেল্প লাইনের দাবি, গত কয়েক দিনে অন্তত ১২ জন নাবালিকার বিয়ে আটকানো গিয়েছে। জেলায় নাবালিকা বিয়ে ও স্কুলছুটের হার কমানোয় উদ্যোগী হয়েছেন জেলাশাসক আয়েষা রানি এ। তিনি বলেন, “নাবালিকা বিয়ে আটকাতে ও স্কুলছুট বন্ধ করতে বিশেষ পদক্ষেপ করা হয়েছে। জেলার রিপোর্ট নিয়ে পর্যালোচনা করেছি। সচেতনতা বাড়াতে বলা হয়েছে সবাইকে।” কয়েক দিন আগে জেলাশাসক বিভিন্ন আধিকারিক ও স্কুলশিক্ষা দফতরের সঙ্গে বৈঠক করছেন। জেলা চাইল্ড হেল্প লাইনকে স্টেশনের নাবালক-নাবালিকাদের উপরে বাড়তি নজর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক। বিডিও-দের বাড়তি ‘দায়িত্ব’ নিতে বলেছেন। সে কারণেই নাবালিকা বিয়ে কিংবা নাবালিকা অবস্থায় মা হওয়ার প্রবণতায় এগিয়ে থাকা কেতুগ্রাম ২ ব্লকে চলতি সপ্তাহেই তিন নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করা গিয়েছে।
কেতুগ্রামের বিল্লেশ্বর পঞ্চায়েত সূত্রে জানা যায়, দু’দিন আগে সকালে জানা যায়, একটি গ্রামের নবম শ্রেণির ছাত্রীকে বিয়ের জন্য কাটোয়ার করুই এলাকা থেকে পাত্র ও তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা এনেছেন। খবর পেয়েই পঞ্চায়েত প্রধান তৃণমূলের খান আশরাফুল আলম (লিটন) বিডিওকে ঘটনা জানিয়ে গ্রামে যান। বিডিও কেতুগ্রাম থানাকে নাবালিকার বিয়ের কথা জানান। প্রধান বলেন, “জানতে পারি পাত্রপক্ষের সঙ্গে নাবালিকা একই গাড়িতে চলে গিয়েছে। যে রাস্তা ধরে গিয়েছে, সেই রাস্তা দিয়ে ধাওয়া করে রসুই মোড়ে গাড়িটিকে আটকানো হয়।” পুলিশ, জেলা চাইল্ড হেল্প লাইনের সামনে তাঁরা ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে অঙ্গীকার করেন। ওই এলাকারই এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বিয়ে বুধবার রুখে দেন গুড়পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের কন্যাশ্রী ক্লাব ও স্কুল কর্তৃপক্ষ। এই তালিকায় জামালপুর, মঙ্গলকোট, আউশগ্রামও রয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, জেলায় ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ২০৫টি বিয়ে আটকানো হয়েছিল। পরের অর্থবর্ষে (২৩-২৪) তা কমে হয় ১২৯। চলতি অর্থবর্ষের (২৪-২৫) ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২২৫ জন নাবালিকার বিয়ে আটকানো গিয়েছে। মার্চের প্রথম পাঁচ দিনেই ১২ জন নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করা গিয়েছে। বেশির ভাগেরই বয়স ১৪-১৬ বছর। মেমারি ১, ভাতার, বর্ধমান ১ ব্লকে ১২-১৩ বছরের নাবালিকার বিয়ে আটকাতে পেরেছে প্রশাসন।
শুধু পূর্বস্থলী নয়, কালনা-সহ জেলার প্রতিটি স্কুলই ‘স্কুলছুট’দের খোঁজে নেমেছে। বিদ্যালয় পরিদর্শকদের স্কুল ধরে ধরে নিয়মিত রিপোর্ট দেওয়া ও প্রথম শ্রেণির পড়ুয়াদের শিক্ষায় দখল কেমন তা দেখার নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক। তাঁর নির্দেশ, স্কুল, বাড়ি ঘুরে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত স্কুলছুট শিক্ষার্থীদের খোঁজ করে কী ব্যবস্থা নেওয়া হল তা রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে। প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পূর্বস্থলীর ওই দুই ছাত্রকে স্কুলে ভর্তির বার বার চেষ্টা করেছিলেন শিক্ষকেরা। কিন্তু অভিভাবকেরা রাজি হননি। শেষে বিডিও-র হস্তক্ষেপে তাদের ভর্তি করানো গিয়েছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)