Advertisement
E-Paper

ট্যারান্টুলা আদৌ কতটা ভয়ের

সন্ধ্যায় স্নান করছিলেন গুসকরার কাটাটিকুরির বাসিন্দা নব পাল। হঠাৎই পায়ে প্রচণ্ড জ্বালা অনুভব হওয়ায় দেখেন কালো একটি রোমশ মাকড়সা। মাকড়সাটিকে প্যাকেটবন্দি করে ছোটেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

অয়ন মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৭:৫০
এ ধরনের মাকড়সা থেকে শোরগোল পড়ে আউশগ্রামে। নিজস্ব চিত্র

এ ধরনের মাকড়সা থেকে শোরগোল পড়ে আউশগ্রামে। নিজস্ব চিত্র

সন্ধ্যায় স্নান করছিলেন গুসকরার কাটাটিকুরির বাসিন্দা নব পাল। হঠাৎই পায়ে প্রচণ্ড জ্বালা অনুভব হওয়ায় দেখেন কালো একটি রোমশ মাকড়সা। মাকড়সাটিকে প্যাকেটবন্দি করে ছোটেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে নববাবুকে ছেড়ে দেওয়া হলেও ট্যারান্টুলার আতঙ্কে বন দফতরের প্রতিনিধিরা আসার আগেই স্থানীয়রা মাকড়সাটিকে মেরে ফেলে। ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়। আর চিত্রটাও শুধু পূর্ব বর্ধমানের নয়। সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যের কোনও না কোনও প্রান্ত থেকে ট্যারান্টুলার কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার, ট্যারান্টুলা সন্দেহে অন্য প্রজাতির মাকড়সাকে মেরে ফেলার বা ট্যারান্টুলা উদ্ধারের ঘটনা প্রায়ই নজরে এসেছে। যদিও বন দফতর বা প্রাণিবিদদের মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নজরে আসা মাকড়সা ট্যারান্টুলা নয়। আর দু-একটি ক্ষেত্রে ট্যারান্টুলার অস্তিত্ব সামনে এলেও তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। ট্যারান্টুলা আদৌ প্রাণঘাতী নয়।

‘ট্যারান্টুলা’ শব্দের উৎপত্তি দক্ষিণ ইতালির সমুদ্রতীরের এক ক্ষুদ্র জনপদ, ট্যারান্টো থেকে। ১৫৬০ সাল নাগাদ এক ধরনের রোমশ মাকড়সার কামড়ে বেশ কিছু লোকের মৃত্যুর ঘটনায় আপাত অখ্যাত এই শহরটি সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে। এই ট্যারান্টো শহরের নাম থেকেই রোমশ মাকড়সার নাম হয় ট্যারান্টুলা। যদিও পরবর্তী সময়ে জানা যায়, যে মাকড়সার কামড়ে ট্যারান্টোয় আতঙ্ক ছড়ায়, তা আদতে ছিল ব্ল্যাক উইডো।

প্রায় সমস্ত মহাদেশেই এদের দেখা যায়। ভারতে ট্যারান্টুলার অস্তিত্ব প্রথম নজরে আসে সম্ভবত ১৮৯৫ সালে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গোটা বিশ্বে প্রায় ৯৭৪ প্রজাতির ট্যারান্টুলার অস্তিত্বের কথা জানা গিয়েছে। এর মধ্যে ভারতে প্রায় ৫৩ প্রজাতির ট্যারান্টুলা পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত প্রায় সাতটি প্রজাতির ট্যারান্টুলার কথা জানা গিয়েছে। তবে যে কোনও রোমশ মাকড়সাকেই ট্যারান্টুলা ভাবাটা ঠিক নয়। কামড়ের ধরন বা চিহ্ন থেকে শনাক্ত করা যেতে পারে। যদিও খালি চোখে সেই কাজটা বিশেষ সহজ নয়।

সন্ধিপদ পর্বের অন্তর্ভুক্ত থেরাপোসিয়েডি পরিবারভুক্ত মাকড়সাগুলিকেই ট্যারান্টুলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমাদের চারপাশে যে সমস্ত মাকড়সা দেখতে পাই, তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই মাকড়সা। রোমশ এই মাকড়সার প্রতিটি পায়ের শেষে ঘন রোমের স্তর থাকে। বেড়ালের পায়ের সঙ্গে মিল থাকায় এদের ‘ক্যাট লেগ্ড স্পাইডার’ও বলেন অনেকে। এদের জাল বোনার অঙ্গটি অন্য মাকড়সার তুলনায় বেশ লম্বা হয়। এদের মুখউপাঙ্গে অনেক কালো কালো বিন্দু থাকে, যা খাবার পেষাই করতে কাজে আসে। ট্যারান্টুলা তাদের বিষদাঁত উপরে ও নীচের দিকে নাড়াচাড়া করতে পারে।

এরা বিভিন্ন রকমের পরিবেশ, যেমন— পাহাড়ি এলাকা, তৃণভূমি, বনাঞ্চল, বর্ষাবন, মরুভূমি এমনকি, মানুষের বসতির আশপাশেও থাকতে পারে। তবে যেখানেই থাকুক না কেন, এরা সাধারণত গর্তে বসবাস করে। গাছেও দেখতে পাওয়া যায়। পছন্দের থাকার জায়গার মধ্যে ঝোপঝাড়ও পড়ে। তবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে, বাড়ির পাশে ঝোপঝাড় থাকলেই ট্যারান্টুলা থাকবে। তবে যে কোনও স্যাঁতস্যাতে জায়গাই ট্যারান্টুলা পছন্দ করে। ঝিঁঝি, শুঁয়োপোকা, অন্য ছোট মাকড়সা, গিরগিটি, ব্যাঙ এমনকি ছোট সাপও ট্যারান্টুলার খাদ্যতালিকার মধ্যে পড়ে। অনেক প্রাণিবিদদের মতে, কোনও কোনও প্রজতির ট্যারান্টুলা প্রায় দু’বছর পর্যন্ত না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। ট্যারান্টুলা খোলস ত্যাগ করে। স্ত্রী ট্যারান্টুলা প্রায় সারাজীবন খোলস ত্যাগ করলেও পুরুষ সদস্যেরা পরিণতি পাওয়া পর্যন্ত খোলস ত্যাগ করে।

সাধারণত যে সমস্ত ট্যারান্টুলা আমাদের নজরে আসে, সেগুলি পুরুয। নিশাচর এই মাকড়সাদের পুরুষ সদস্যেরা স্ত্রীদের তুলনায় আকারে ছোট হয়। সারা বছর নজরে না আসলেও মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত এদের খুব সহজেই দেখা যায়। কারণ, এই সময়টা হল ট্যারান্টুলার প্রজননকাল। পুরুষ ট্যারান্টুলারা রাতে স্ত্রী সঙ্গীকে খুঁজতে বেরোয়। যে কারণে আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই সময়েই ট্যারান্টুলা নজরে আসার ঘটনা সামনে আসছে। স্ত্রী ট্যারান্টুলারা, অন্য দিকে, তাদের প্রায় গোটা জীবনটাই গর্তে কাটিয়ে দেয়। ট্যারান্টুলার জীবনকাল প্রায় ১৫-২৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে, যা অন্য প্রজাতির মাকড়সার তুলনায় অনেকটাই বেশি।

প্রজননের সময়ে পুরুষ মাকড়সা তন্তু বুনে তার মধ্যে শুক্রাণু আটকে রাখে। পরে সেই শুক্রাণু তার মুখের বিশেষ অঙ্গে বয়ে বেড়ায়। উপযুক্ত সাথী পেলে পুরুষটি মুখে লেগে থাকা শুক্রাণুগুলো স্ত্রী মাকড়সার ডিম্বাণুর কাছে প্রবেশ করিয়ে দেয়। পরে নিষিক্ত ডিম নিয়ে স্ত্রী মাকড়সা কোকুন তৈরি করে। দেখা গিয়েছে, অনুকূল পরিবেশ না পেলে কোকুন থেকে পূর্ণাঙ্গ মাকড়সা সৃষ্টি হতে অনেক সময়ে প্রায় ৮-১০ বছরও সময় লেগে যায়। এক একটি কোকুন থেকে সাধারণ ভাবে ৮০০-১০০০ ট্যারান্টুলার জন্ম হয়।

আমাদের পরিচিত মাকড়সাদের মতো ট্যারান্টুলা শিকার করার জন্য জাল তৈরি করে না। এরা শিকারের জন্য অপেক্ষা করে এবং শিকার নাগালে এলে বিষদাঁতের সাহায্যে শরীরে বিষ ঢেলে দেয়। শিকার অবশ হয়ে পড়লে ট্যারান্টুলা মুখের নলের মাধ্যমে শিকারের দেহ থেকে প্রোটিন চুষে নেয়। কিছু কিছু প্রজাতির ট্যারান্টুলা শিকারের জন্য শরীরের লোম ব্যবহার করে। শিকারের দেহে বিষাক্ত লোম ছুড়ে তারা শিকারকে অবশ করে দেয়।

ট্যারান্টুলা নিয়ে জনমানসে যে ভয় রয়েছে, তা অনেকটাই ভুল ধারণা থেকে তৈরি। ট্যারান্টুলার কামড়ে মানুষের মৃত্যুর নজির নেই। এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্বে মানুষের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে এমন যে চার ধরনের মাকড়সার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে ট্যারান্টুলা পড়ে না। ট্যারান্টুলার বিষের তীব্রতা এমন নয়, যে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। মানুষের শরীরে এই বিষের প্রভাব খুব অল্প ও ক্ষণস্থায়ী। ট্যারান্টুলার রোমশ অংশ মানুষের চোখে ও ত্বকে লাগলে কিছু সময়ের জন্য জ্বালা-যন্ত্রণা হতে পারে মাত্র। বিষের প্রকৃতি নিউরোটক্সিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৌণ সংক্রমণ, হাইপারসেন্সিটিভিটি বা অ্যালার্জির কারণে সমস্যা হয়।

লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবিজ্ঞানের গবেষক

Tarantula Spider
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy