যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে ‘অনধিকার হস্তক্ষেপে’র অভিযোগ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বিরুদ্ধে। অভিযোগ তৃণমূলের মধ্যেই। ‘সিপিএম ঘনিষ্ঠ’ অধ্যাপককে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) পদে বসানোর চেষ্টা ঘিরে ব্রাত্যের সঙ্গে সংঘাতে তৃণমূলপন্থী অধ্যাপকদের নেতা তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসি (কার্যনির্বাহী সমিতি) সদস্য মনোজিৎ মণ্ডল। টানাপড়েনের জেরে আপাতত আটকে গিয়েছে যাদবপুরে রেজিস্ট্রার নিয়োগ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জটিলতা সামনে এসেছে ব্রাত্যকে মনোজিতের পাঠানো একটি দীর্ঘ হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তার স্ক্রিনশট প্রকাশ্যে আসায়। প্রকাশ্যে এসেছে যাদবপুরের উপাচার্য চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যকে মনোজিতের পাঠানো ইমেলের স্ক্রিনশটও। ব্রাত্যকে যে হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তা পাঠানো হয়েছে, তাতে মনোজিৎ লিখেছেন, সেলিমবক্স মণ্ডল নামে এক অধ্যাপককে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) পদে নিয়োগ করার জন্য ব্রাত্য ‘জোরদার সুপারিশ’ করেছেন এবং উপাচার্যের উপরে ‘চাপ সৃষ্টি’ করেছেন। তৃণমূলের শিক্ষক-অধ্যাপক সংগঠন ওয়েবকুপার প্রথম সারিতে থাকা মনোজিৎ সেখানে লিখেছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই এই অভিযোগ পেয়েছেন। ‘সিপিএম ঘনিষ্ঠ’ সেলিমবক্সকে রেজিস্ট্রার পদে বসানোর জন্য ব্রাত্য চাপ দিচ্ছেন বলে জেনে তিনি ‘বিস্মিত’। চিঠির আকারে লেখা হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তাটিতে মনোজিৎ লিখেছেন, ‘জুটায় (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠন) বসে থাকা সিপিএম নেতারাও যে তাঁকে (সেলিমবক্স) ওই পদে দেখতে চাইছেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ সেলিমের সঙ্গে ওঁদের গভীর সম্পর্ক এবং ওঁদের সঙ্গে যোগসাজশ। কিন্তু আপনি কেন সিপিএম-লাইন নিচ্ছেন স্যার ?’ পরের দু’টি লাইনেই ব্রাত্যের উদ্দেশে মনোজিতের সতর্কবার্তা, ‘তৃণমূলপন্থী শিক্ষক এবং কর্মীরা এইরকম কোনও সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে এবং তাঁরা বিক্ষোভ শুরু করতে বাধ্য হবেন, যদি আপনার সুপারিশে অথবা চাপে উপাচার্য এই রকম কোনও সিদ্ধান্ত নেন।’
সেলিমবক্স যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার পাশাপাশি কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা নিয়ামক পদেও রয়েছেন। সেলিম সেই পদের ‘অপব্যবহার’ করছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ‘অনিয়ম’ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তায় বিশদে লিখেছেন মনোজিৎ। রেজিস্ট্রার নিয়োগপ্রক্রিয়ায় ‘অনধিকার হস্তক্ষেপ’ না করতে শিক্ষামন্ত্রীকে মনোজিৎ অনুরোধ করেছেন।
উপাচার্য চিরঞ্জীব-সহ অন্য ইসি সদস্যদের মনোজিৎ যে ইমেল পাঠিয়েছেন, তাতে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ইসি-র অনুমোদন না নিয়ে উপাচার্য কাউকে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) পদে বসাতে পারেন না। সোমবার মনোজিৎ বলেন, ‘‘আমি একা নই, ইসির আরও অনেক সদস্যই একই কথা উপাচার্যকে লিখেছেন। প্রত্যেককেই তিনি জবাব দিয়েছেন। দ্রুত বিষয়টির সমাধান হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন।’’ তবে তাঁর হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তার কোনও জবাব ব্রাত্য দেননি বলে মনোজিৎ জানিয়েছেন।
ঘটনাচক্রে, মাস দেড়েক আগে মনোজিতের প্রাক্তন স্ত্রী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ব্রাত্যের দফতরের সংঘাত তৈরি হয়েছিল। বৈশাখী মধ্য কলকাতার মিল্লি আল-আমিন কলেজের শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি সেখানকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষাও ছিলেন। কলেজটির পরিচালন সমিতির সঙ্গে তাঁর সংঘাত চলছিল। পরে সে কলেজ থেকে তাঁকে রামমোহন রায় কলেজে বদলি করা হয়। বৈশাখী সেখানে আর কাজে যোগ দেননি। ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর শিক্ষা দফতর থেকে বৈশাখীর বাড়িতে বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে একটি চিঠি পৌঁছোয়। তাতে জানানো হয়, ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বরকে তাঁর ইস্তফার তারিখ হিসাবে ধরা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ওই তারিখে বৈশাখী প্রথম বার মিল্লি আল-আমিন কলেজ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশে শিক্ষা দফতর সে ইস্তফা গ্রহণ করেনি। বৈশাখী পরবর্তী এক বছর কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। আচমকা সেই সিদ্ধান্ত উল্টে দিয়ে ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বরেই তাঁর ইস্তফা গৃহীত হয়েছিল বলে জানিয়ে ব্রাত্যের দফতর চিঠি পাঠানোয় বৈশাখী আইনি পদক্ষেপ করার হুঁশিয়ারি দেন। বৈশাখীর চিঠি পেয়ে ব্রাত্যের দফতর জানায় যে, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। এ-ও এক ঘটনাচক্রই যে, সে ঘটনার পরে মাস দেড়েক কাটতে না কাটতেই বৈশাখীর প্রাক্তন স্বামী মনোজিৎ সংঘাতে জড়ালেন ব্রাত্যের সঙ্গে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাপ্রবাহ প্রসঙ্গে বৈশাখী বলেন, ‘‘মনোজিৎ যে বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, আমার সেই বিষয়ের সঙ্গে তার কোনও সংযোগ নেই। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু যে কোনও প্রতিবাদ বা কোনও আবেদন-নিবেদন কানেই তুলতে চান না, আমি নিজে তার সাক্ষী। আমার ইস্তফার তারিখ সংক্রান্ত জটিলতাটি বছরের পর বছর জিইয়ে রাখা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর অদ্ভুত নীরবতা আমার কর্মজীবন, আমার সম্মান, সব কিছু নষ্ট করছে।’’ বৈশাখীর সংযোজন, ‘‘আমি না-হয় গত কয়েক বছর দলের বৃত্তে ছিলাম না। কিন্তু মনোজিৎ তো একনাগাড়ে তৃণমূলই করছেন। তাঁর সঙ্গেও সংঘাত কেন ? শিক্ষামন্ত্রীর উচিত আত্মনিরীক্ষণ করা।’’