Advertisement
E-Paper

আগে কে বা ত্রাণ, করিবেক দান! দুর্গতের স্বার্থে বার বার অভিনব উপায়ে মাঠে নামা বাংলায় এখন ত্রাণ বিলি ঘিরে প্রতিযোগিতা

১৯৯৯ সালের শেষ দিকে ওড়িশা ভয়াবহ ‘সুপার সাইক্লোন’-এ বিধ্বস্ত হয়েছিল। সে বিপর্যয়ে ওড়িশার পাশে দাঁড়াতে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ক্রিকেট মাঠে নামিয়েছিলেন অধুনা তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৫ ২০:৪৬
Bengal, which had a tradition of cooperation during social need, witnesses fierce competition around relief works during North Bengal disaster

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

চিত্র ১: উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বিশেষ ত্রাণ তহবিল গঠন করল। সে তহবিলে প্রথম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দিলেন এক লক্ষ টাকা। তার পরে তৃণমূলের সমস্ত বিধায়ক এক লক্ষ টাকা করে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে দিলেন পাঁচ লক্ষ।

চিত্র ২: বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ঘোষণা করলেন, রাজ্যের প্রত্যেক বিজেপি বিধায়ক উত্তরবঙ্গের ত্রাণের জন্য এক মাসের বেতন দান করছেন। সেই তহবিল থেকে ডুয়ার্সে মৃতদের পরিবারের হাতে আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দিলেন।

চিত্র ৩: টলিপাড়ার কলাকুশলীদের সংগঠনের প্রধান স্বরূপ বিশ্বাসের উদ্যোগে ৩৩ লক্ষ টাকা উঠল ত্রাণের জন্য। সে অর্থ জমা পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর তৈরি করা বিশেষ ত্রাণ তহবিলে।

চিত্র ৪: ঘাটালের সাংসদ তথা অভিনেতা দেব উত্তরবঙ্গে ত্রাণ বিলির জন্য পাঠালেন নিজের লোকজনকে। পিছনে ‘উত্তরের বন্যায় দেব’ লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে তাঁরা টেবিল পেতে বসলেন দুর্গতদের শুকনো খাবার ইত্যাদি দিতে।

চিত্র ৫: উত্তরবঙ্গে বিপর্যয়ের দিনে কলকাতায় কার্নিভালের মঞ্চে নাচগানে মেতে সমাজমাধ্যমে কটাক্ষ এবং সমালোচনার শিকার অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আসরে নামলেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জানালেন, টলিউডের শিল্পী ও কলাকুশলীদের তরফ থেকে ২০ লক্ষ টাকা ত্রাণের জন্য দেওয়া হচ্ছে।

দুর্গতদের সাহায্যার্থে ত্রাণসংগ্রহে বারবার পথে নেমেছে পশ্চিমবঙ্গ। সে এ রাজ্যে হোক বা ভিন্‌রাজ্যে। সেই ইতিহাস সুপ্রাচীন। তবে তাতে মূলত শামিল হত সরকার তথা শাসকদল। উত্তরবঙ্গে আকাশভাঙা বৃষ্টির জেরে বিপর্যয় নেমে আসার পরেও ত্রাণসংগ্রহে নেমেছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের কুশীলবেরা। কিন্তু তার পদ্ধতি সহমর্মিতার চেয়ে প্রতিযোগিতাকেই এগিয়ে রাখছে। দৃশ্যমানতার এই যুগে কাজ করলেই হয় না। সে কাজের ছবিও তুলে রাখতে হয় প্রামাণ্য দলিল হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস বলছে, অতীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিভিন্ন অভিনব উপায়ে ত্রাণসংগ্রহ হয়েছে। কিন্তু তা এত প্রকট ভাবে বিজ্ঞাপিত হয়নি।

১৯৭৮ সালের পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ বন্যার পর ত্রাণসংগ্রহের জন্য একজোড়া ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিল। একটির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। সে ম্যাচে শুধু বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ খেলেছিল। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি অন্য ম্যাচটি খেলা হয়। বাংলা এবং মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র জগৎ যৌথ ভাবে সে ম্যাচের আয়োজন করে। বাংলার অধিনায়ক ছিলেন উত্তমকুমার। মুম্বইয়ের অধিনায়ক দিলীপ কুমার। ইডেন গার্ডেন্সে আয়োজিত সেই ম্যাচের টিকিট বিক্রির টাকা বন্যার্ত মানুষের ত্রাণে খরচ হয়েছিল।

Bengal, which had a tradition of cooperation during social need, witnesses fierce competition around relief works during North Bengal disaster

ওড়িশার বিপর্যয়ে ত্রাণের জন‍্য অর্থসংগ্রহ করতে ক্রিকেট মাঠে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসু। ছবি: সংগৃহীত।

১৯৯৯ সালের শেষ দিকে ওড়িশা ভয়াবহ সুপার সাইক্লোনে বিধ্বস্ত হয়েছিল। সে বিপর্যয়ে ওড়িশার পাশে দাঁড়াতে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ক্রিকেট মাঠে নামিয়েছিলেন কুণাল ঘোষ (যিনি বর্তমানে তৃণমূল নেতা)। স্পিকার হাসিম আবদুল হালিমকে কুণাল প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ওড়িশার ত্রাণে অর্থসংগ্রহের জন্য ‘মুখ্যমন্ত্রী একাদশ বনাম বিরোধী দলনেতা একাদশ’ ম্যাচ হোক। কুণালের কথায়, ‘‘হালিম সাহেব আমাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখলাম জ্যোতিবাবু বসে রয়েছেন। তাঁর সামনেই আমাকে বললেন— আমাকে যা বোঝাচ্ছিলে, ওঁকেও তা বোঝাও।’’ ২০০০ সালের শুরুতে মোহনবাগান মাঠে সে ম্যাচ হয়েছিল। জ্যোতিবাবু শুধু প্রথম বলটি খেলেছিলেন। বোলার ছিলেন বিরোধীপক্ষের সৌগত রায়। উইকেটকিপার সত্যরঞ্জন বাপুলি। আম্পায়ার ছিলেন স্পিকার হালিম নিজে এবং মুনমুন সেন। ম্যাচটিতে জয়ী হয়েছিল বিরোধী দলনেতা অতীশ সিংহের নেতৃত্বাধীন দল। সংগৃহীত অর্থ জমা পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে।

তবে সেই ছবি এখন অতীতের অ্যালবামে ধূসর হয়ে এসেছে। হাতে-হাত মিলিয়ে ত্রাণের কাজ করা ছবি বদলে গিয়েছে প্রকাশ্য রেষারেষিতে। আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আবহ তাতে আরও চড়া মাত্রা যোগ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা দুর্গত এলাকায় পৌঁছনোর কয়েক ঘণ্টা আগে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য দুর্গত এলাকায় পৌঁছে গিয়েছেন। সেই ছবি ‘হাতিয়ার’ করেছে প্রধান বিরোধী দল। আবার বিরোধী দলের সাংসদ-বিধায়করা দুর্গত এলাকায় পৌঁছে ত্রাণ বিলির চেষ্টা করায় বাধা পাচ্ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন, রক্তাক্ত হচ্ছেন। পাথর পড়ছে তাঁদের গাড়িতে। সেই ‘ক্ষত’ মেরামত করতে মুখ্যমন্ত্রীকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে আহত বিজেপি সাংসদকে দেখতে। রাস্তায় কৌটো নাড়িয়ে ত্রাণসংগ্রহ করার ছবি দেখিয়ে বামেদের এককালে কটাক্ষ করত অন্যান্য দল। এ বার বিজেপি সে পথ নিয়েছে। আর বামেরা প্রশ্ন তুলেছে, এত কালের কটাক্ষের বিষয়ে ক্ষমা না চেয়ে বিজেপি এ ভাবে রাস্তায় নামল কোন অধিকারে?

রেষারেষি। প্রতিযোগিতা। কোন দল কখন দুর্গতদের কাছে পৌঁছেছে, কারা আগে নগদ সাহায্য ঘোষণা করল, কাদের প্রদেয় অর্থের পরিমাণ কত— সমস্তই ওজন করা হচ্ছে প্রতিযোগিতার নিক্তিতে। অমুকে ত্রাণ দেওয়া শুরু করে দিল! আমরা এখনও দিতে পারলাম না? অথবা আমরা দেওয়া শুরু করে দিলাম। কিন্তু ওরা এখনও রাস্তায় নামতে পারল না? এ উদাহরণ অবশ্য আনকোরা নয়। কোভিডকালেও বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল বাংলায়। কিন্তু শাসকদলের নেতারা বিনা বাধায় কাজ করেছিলেন।

প্রশাসনে ‘আমরা-ওরা’ আগেই প্রবেশ করেছিল পশ্চিমবঙ্গে। এ বার তা ঢুকে পড়ল ত্রাণ বিলির চৌকাঠ পেরিয়েও। যাঁরা এই দৌড়ে নেমেছেন, তাঁরা কি মনে করেন, এর খুব প্রয়োজন ছিল? বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলছেন, ‘‘রেষারেষি বা আমরা-ওরাটা শুরু করেছিল সিপিএম। যা করার আমরা করব, অন্য কারওকে করতে দেব না— এই ছিল সিপিএমের নীতি। তারই নগ্ন রূপায়ণ ঘটাল তৃণমূল। অগত্যা রেষারেষি শুরু হল।’’ তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারও বলছেন, ‘‘বামেরা এ রাজ্যে হিংসার রাজনীতির আমদানি ঘটিয়েছিল। নকশালরা সংসদীয় ব্যবস্থায় না ঢুকে আনল খতমের রাজনীতি। সিপিএম সংসদীয় রাজনীতিতে থেকে আনল বিরোধীশূন্যতার রাজনীতি। ফলে দীর্ঘদিন একটা বিশাল অংশের মানুষকে গায়ের জোরে ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে রাখা হল। তার ফল ফলছে।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সার্বিক অবক্ষয়। আর সেই অবক্ষয়ের জন্য দায়ী তৃণমূল। বাম জমানায় ফুটবল মাঠে রাজনৈতিক দল থাবা বসাত না। পুজো বা সামাজিক অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দল দখল কায়েম করত না। তৃণমূল সব দখল করতে চায় বলেই এই অবস্থা।’’

North Bengal Disaster West Bengal Politics TMC BJP Relief Fund
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy