বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। —ফাইল ছবি।
এত দিনের একসঙ্গে পথ চলা। কবে প্রথম দেখা হয়েছিল? প্রায় মনেই পড়ছিল না! অনেক ভেবে কফি হাউজ়ের কথা মনে পড়ল। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজ়ে প্রথম আলাপ। সামনে তখন ছাত্র সংসদের নির্বাচন। তিন দলের তিন জনকে পড়ুয়ারা ভোট দিয়ে বেছে নিয়েছিল। তার মধ্যে এক জন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। আর এক জন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
সেই শুরু। তার পরে নানা রকম সময়ের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে একসঙ্গে কত পথ অতিক্রম করেছি আমরা। এতটাই দীর্ঘ এবং নিবিড় সেই সঙ্গ যে, তার মধ্যে আলাদা করে কিছু তুলে ধরা মুশকিল। কত ঘটনা, কত স্মৃতি! ছাত্র ও যুব রাজনীতি, সংগঠন, দল, সরকার, আবার দল। কত কথা!
সেই সময়ের বুদ্ধ উত্তর কলকাতার বাসিন্দা। শোভাবাজার এলাকায় ওর ওয়ার্ডে (সে সময়ের কলকাতায় ওয়ার্ড বিন্যাস এখনকার চেয়ে আলাদা ছিল) যুব উৎসবে বুদ্ধ আহ্বায়ক হয়েছিল। যুব সংগঠনে ওর কাজের প্রেক্ষিতে রাজ্য স্তরে বড় দায়িত্ব পেল। ডিওয়াইএফআই তৈরির সময়ে রাজ্য সম্পাদক বুদ্ধ। সেই ছয়ের দশকের উত্তাল সময়ে একসঙ্গে অজ্ঞাতবাসে থেকেছি। আমার বরাবরের অভ্যাস, আমি একা শুই। বিছানায় অন্য কেউ থাকলে অস্বস্তি হয়। মনে পড়ছে, বুদ্ধের জন্য সেই ছক ভাঙতে হয়েছিল! বুদ্ধের জায়গায় ওর অন্য পরিচিতেরা এসে যাওয়ায় ওকে ডেকে নিয়েছিলাম। আমি আর বুদ্ধ এক জায়গায়, রাতে পাশাপাশি।
বামফ্রন্টের সরকার হল ১৯৭৭ সালে। তরুণ বুদ্ধ মন্ত্রী হল। সংস্কৃতি ওর পছন্দের বিষয়। ওই দফতরের নাম অবশ্য আগে আলাদা ছিল, আমাদের সময়ে বদলেছে। পরের বার বিধানসভা নির্বাচনে বুদ্ধ অবশ্য হেরে গিয়েছিল। তখন পার্টির কাজ করেছে। আবার পাঁচ বছর পরে সরকারে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, তাঁর ছায়াতেই বুদ্ধ কাজ করেছে। কাজ শিখেওছে। জ্যোতিবাবু মাথার উপরে থাকতে থাকতেই বুদ্ধ তৈরি হয়েছে পরবর্তী বড় দায়িত্বের জন্য।
জ্যোতিবাবু এবং বুদ্ধ, দু’জনকেই আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। অনেক সময় এক কথায় দু’জনকে বর্ণনা করতে বলেন কেউ কেউ। আমি মনে করি, এই ভাবে তুলনা হয় না। তুলনা করা উচিত নয়। দু’জনের সময় আলাদা, রাজনীতির প্রেক্ষাপট আলাদা। জ্যোতিবাবু যখন শুরু করেছেন, সে সময়ে পার্টি করতে বিশেষ কেউ আসতই না। আর বুদ্ধ যখন শুরু করেছে, পার্টিতে অনেকে আসছে। সময়টা অন্য রকম। তুলনা হবে কী করে! জ্যোতিবাবু এক রকম ভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন। দ্রুত অনেক কিছু ধরে ফেলতেন। বিরোধী দলনেতা হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে আগেই অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। তাঁর পরিধি একটু বড় ছিল। বুদ্ধ তার মতো করে ভাবতো, সিদ্ধান্ত নিত। প্রশাসন চালানোর সময়ে একটা সংবেদনশীল মনও কাজ করতো। আলাদা আলাদা সময়ে দু’জনে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ।
বলা হয়, শিল্পায়ন করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিল বুদ্ধ। কিন্তু ব্যাপারটাকে এ ভাবে দেখা ঠিক নয়। শিল্পায়ন দলের সিদ্ধান্ত ছিল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধ সেই পথে এগিয়েছিল। বাধা দেওয়ার জন্য যা যা ঘটানো হয়েছিল, তাকে কোনও ভাবেই খাটো করে দেখার জায়গা নেই। দক্ষিণপন্থী থেকে মাওবাদী, নানা ধরনের শক্তি ও সংগঠন এক জায়গায় এসে ঘোঁট পাকিয়েছিল। চক্রান্ত হয়েছিল। প্রশাসনিক শিথিলতাও কিছু ছিল ঠিকই। কিন্তু তার জন্য উল্টো দিকের ঘটনাগুলো ভুলে যাওয়া যায় না। সেখানে বুদ্ধ একা কী করবে?
আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু বুদ্ধের শরীরটা ভাল ছিল না অনেক দিনই। চোখের সমস্যা বাড়ছিল। যখন দেখতে প্রায় পাচ্ছে না, তখনও আমি সময় পেলেই পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়েছি। দেখতে না-পাওয়াটা আমাদের মধ্যে কোনও সমস্যা ছিল না। গলা শুনে বুদ্ধ বুঝে নিত। যত দিন অল্প করে কথা বলতে পারছিল, তখনও গিয়েছি। আমি কথা বুঝে নিতাম। সেটাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বুদ্ধের কাছে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম। এই বুদ্ধকে দেখা আমার কাছে বিড়ম্বনার ছিল। পাম অ্যাভিনিউয়ে গিয়ে ওর নিষ্প্রাণ শরীরটার কাছে বৃহস্পতিবারও বেশি ক্ষণ দাঁড়াতে পারিনি।
এত দিনের আরও এক বন্ধুকে হারিয়ে এখন ফের মনে হচ্ছে, রাজনীতিটা কত পাল্টে গিয়েছে! বাড়ি-গাড়ি করার জন্য আমরা রাজনীতি করতে আসিনি, বুদ্ধ আমৃত্যু সেটা দেখিয়ে গিয়েছে। পাম অ্যাভিনিউয়ের ওই স্যাঁতস্যাঁতে ঘর ওর স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক ছিল না। সেই কবে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন ঠিকানা বদলাতে, শোনেনি ও। গৌতম (দেব) সব ব্যবস্থা করে ফেলার কথা এক বার বলতে গিয়েছিল, প্রায় ভাগিয়ে দিয়েছিল ওকে! আমাকে গৌতম বলেছিল, আপনি এক বার বলুন। আমি জানতাম, আমি বললেও কাজ হবে না। কারণ, আমি বুদ্ধকে চিনতাম!
এই চেনা বুদ্ধকেই মনে রাখতে চাই।
(আলাপচারিতার ভিত্তিতে অনুলিখিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy