Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
CPM

CPM: আন্দোলন-বিক্ষোভে বিরোধী পরিসরে সিপিএম কি বিজেপি-কংগ্রেসের চেয়ে এগিয়ে?

আনিস খান হত্যাকাণ্ড থেকে বগটুই, শিক্ষা ও চাকরি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রতিবাদে মাটি কামড়ে পড়ে আছে সিপিএম।

বিরোধী পরিসরে এগোচ্ছে সিপিএম?

বিরোধী পরিসরে এগোচ্ছে সিপিএম? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২২ ১৭:৫৪
Share: Save:

মন্ত্রী পরেশ অধিকারী কোথায়? এক হাতে পোস্টার। অন্য হাতে টর্চ। বুধবার বিকেলে রাজ্য জুড়ে নেমে পড়েছিল সিপিএম। তার পিঠোপিঠিই একটি মিছিল এগচ্ছিল নিজাম প্যালেসের দিকে। যেখানে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জেরা করছে সিবিআই।
রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপি তখন কোথায়! কোথায়ই বা কংগ্রেস!
যেমন সম্প্রতি বালিগঞ্জের উপনির্বাচনে দেখা গিয়েছিল। তৃণমূল জেতা আসন জিতেছিল ঠিকই। কিন্তু বিরোধী সিপিএম ভোট বাড়িয়েছিল প্রায় ২০ শতাংশ। সেখানে বিজেপি এবং কংগ্রেসের জামানত বাজেয়াপ্ত!

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বাংলায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল সিপিএম-সহ বামেরা। ১১ বছর আগেও যে রাজ্যের শাসনভার ছিল সিপিএমের, তাদের একটিও জনপ্রতিনিধি নেই বিধানসভায়! নির্বাচনী ময়দানে কিছু তরুণ মুখকে এগিয়ে দেওয়ার নিরীক্ষাও জলে গিয়েছে।

সিপিএমের মতো কংগ্রেসও রাজ্যে শূন্য হয়ে গিয়েছিল বিধানসভা ভোটে। আর ঈপ্সিত লক্ষ্যের ধারেকাছে পৌঁছতে না-পারলেও প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছিল বিজেপি।

কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেখা যাচ্ছে, লাগাতার আন্দোলন-বিক্ষোভ এবং রাস্তায় নামার রাজনীতিতে বিরোধী পরিসরে নিজেদের জায়গা তৈরি করছে সিপিএম। মহম্মদ সেলিম দলের রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর সাম্প্রতিক অতীতে কিছু ‘ঝাঁকুনি’ দিতে শুরু করেছে সিপিএম। সেলিম যেমন নিজে মোটরসাইকেলের পিছনে চড়ে পুলিশি নজরদারি এড়িয়ে পৌঁছেছেন বীরভূমের বগটুই গ্রামে। তাঁদের দলের কোন নেতা শেষ বার এমন করেছেন, তা মনে করতে পারছেন না আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারাই।

রাজ্যে আবার ভোট ২০২৪ সালে। পাঁচবছর আগের লোকসভা ভোটে রাজ্যে শূন্য হয়েছিল সিপিএম। দু’বছর পরে তারা আবার একটি লোকসভা ভোটের মুখে।

রাজ্যে আবার ভোট ২০২৪ সালে। পাঁচবছর আগের লোকসভা ভোটে রাজ্যে শূন্য হয়েছিল সিপিএম। দু’বছর পরে তারা আবার একটি লোকসভা ভোটের মুখে। —ফাইল চিত্র।

সংখ্যালঘু নেতা সেলিমকে রাজ্য সম্পাদক করাও সিপিএমের পক্ষে ‘ইতিবাচক’ হয়েছে বলেই দলের নেতাদের অভিমত। সে কারণেই সেলিম যখন আনিসের পরিবারের সঙ্গে ইদ কাটাতে যান, সেটা ‘রাজনৈতিক পদক্ষেপ’ বলে মনে হয় না। সেলিম রাজনৈতিক বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ। খানিক হালকাচালেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী— দু’জনের চেয়েই বয়সে ছোট।’’ তবে রসিকতা করে বলেও সেখানেই সেলিমের সুবিধা। কারণ, তিনি কথা বলেন তরুণ প্রজন্মের ভাষায়। দলের সভায় তিনি নির্দ্বিধায় পুলিশকে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেন। তা নিয়ে বিতর্ক হলে একটি পা-ও পিছু না-হটে বলেন, ‘‘ঠিকই। ভুল করেছি। এই পুলিশ কুকুরের সঙ্গেও তুলনীয় নয়। এই পুলিশকে কুকুর বললে সেটা কুকুরেরও অপমান!’’

একই সঙ্গে তিনি নেটমাধ্যমেও অত্যন্ত সক্রিয়। হোয়াট্সঅ্যাপে সাবলীল।

বিধানসভা ভোটে বিপর্যয় হলেও বিভিন্ন সামাজিক পরিসরে ‘শ্রমজীবী ক্যান্টিন’-এর মতো কর্মসূচি নিয়ে (দলের একাংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও) কলকাতা শহরে মাটি কামড়ে পড়েছিল সিপিএম। ঠিক যেমন কোভিডের সময় রেড ভলান্টিয়ারদের বাহিনী নামানো হয়েছিল। তার ফল অবশ্য ভোটে পাওয়া যায়নি। যার কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, সিপিএমের ‘সরকারে নেই, দরকারে আছি’ স্লোগানও খানিকটা দায়ী। দলের একাংশ এবং দলের হিতৈষীদের অনেকের মতে, ওই স্লোগান খানিকটা বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল। সরকারে না-থাকলেও যখন দরকারে সিপিএমকে পাওয়াই যাচ্ছে, তখন আর খামোখা সরকারে এনেই বা কী হবে! ওই স্লোগান নিয়েও এ বার আলোচনা শুরু হয়েছে। যা থেকে অন্তত একটি বিষয় স্পষ্ট— সিপিএম মতামত গ্রহণের ব্যাপারে আর ততটা ‘কৌলীন্য’ দেখাচ্ছে না।

ঘটনাচক্রে, বিধানসভা ভোটের বিপর্যয়ের পর রাজ্য জুড়ে পুরভোটে কিন্তু কংগ্রেস-বিজেপির তুলনায় সিপিএম ভাল ফল করেছে। প্রবল তৃণমূল ঝড়ে অন্যেরা যখন একেবারে ধরাশায়ী, তখন সিপিএম নদিয়ার তাহেরপুরে নিজেদের পুরসভার দখল ধরে রাখতে পেরেছে। যা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কম কৃতিত্বের নয়। পাশাপাশি, শতাংশের হিসেবেও পুর নির্বাচনে ভোট বেড়েছে তাদের।

সেখানে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ঘর সামলাতেই ব্যতিব্যস্ত। ভোটের বিপর্যয়ের পর থেকে একের পর এক ওজনদার নেতার তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন, দলের অন্দরে বিভিন্ন শিবিরে বিভাজন এবং নেতৃত্বের রাশ হাতে রাখার অন্তর্দলীয় লড়াইয়ে বিজেপি আপাতত দিশাহারা। প্রদেশ কংগ্রেসের আন্দোলন মূলত বহরমপুর-কেন্দ্রিক। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আনিস-মৃত্যুর সময় পথে নামলেও তা সামগ্রিক ভাবে দলের মঞ্চে ছাড়ায়নি। দলের চেয়ে তা অনেকটাই ব্যক্তি উদ্যোগে বলে মনে হয়েছে।

পক্ষান্তরে, কলকাতা পুরনিগম-সহ অন্যান্য পুরসভা এবং বালিগঞ্জে বিধানসভা উপনির্বাচনের ফল সিপিএমের হারানো জমি পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে করেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। সেই ‘অক্সিজেন’ পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে রাস্তায় নেমেছে সিপিএম। দলের ছাত্র এবং যুবফ্রন্টের সদস্য-কর্মীরা প্রায় প্রতি দিনই কলকাতার রাজপথে মিছিল-বিক্ষোভ করছেন। যেমন করেছেন বৃহস্পতিবারেও। এসএসসি বিতর্কে সিপিএম লাগাতার আন্দোলন করে আসছিল। তার সঙ্গেই যোগ হয়েছিল আনিস-মৃত্যু, বগটুইয়ের গণহত্যা বা নদিয়ার হাঁসখালিতে ধর্ষণের মতো ঘটনা। যা শাসকের বিরোধিতার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। হাওড়ার আমতায় আনিসের মৃত্যুর পর সিপিএম রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে সামনে রেখে সিপিএম পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েছিল। যার পরিণতিতে লাঠি চালায় পুলিশ। মিনাক্ষী-সহ আরও কয়েক জন আহত হন। তাঁদের বেশ কিছু দিন জেলেও থাকতে হয়। কিন্তু সিপিএম বা তাদের শাখা সংগঠন আনিস-কাণ্ডে আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরে আসেনি। বস্তুত, আনিসের ঘটনাটি ‘বিষয়’ হিসেবে রাজ্য রাজনীতিতে এখনও জিইয়ে রেখেছে সিপিএমই।

উল্টো দিকে, আনিসের মৃত্যুর ঘটনায় রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ময়দানে নামতেই পারেনি। আনিসের বাড়িতে অধীর গিয়েছিলেন বটে। কিন্তু তা-ও কার্যত ব্যক্তি উদ্যোগ বলেই পরিগণিত হয়েছে।

আবার বগটুইয়েও প্রথম পৌঁছেছিল সিপিএম। সেলিম যখন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গ্রামে ঢুকেছিলেন, তখন অশীতিপর নেতা বিমান বসু পুলিশের কাছে বাধা পেয়ে গ্রামের বাইরে অবস্থানে বসে পড়েছিলেন। তার ধারেপাশে বিজেপি বা কংগ্রেসের নেতাদের দেখা যায়নি। বিজেপি পরে কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়েছিল বটে। কিন্তু তত ক্ষণে বিরোধী হিসেবে প্রচারের আলো টেনে নিয়েছে সিপিএম।

কলকাতা পুরনিগম-সহ অন্যান্য পুরসভা এবং বালিগঞ্জে বিধানসভা উপনির্বাচনের ফল সিপিএমের হারানো জমি পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে করেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা।

কলকাতা পুরনিগম-সহ অন্যান্য পুরসভা এবং বালিগঞ্জে বিধানসভা উপনির্বাচনের ফল সিপিএমের হারানো জমি পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে করেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। —ফাইল চিত্র।

তার অব্যবহিত পরেই ছিল বালিগঞ্জে উপনির্বাচন। সেখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রার্থী হেরে গেলেও তাদের ভোট অনেকটাই বাড়ে। এক বছর আগে ওই আসনে অধুনাপ্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় জিতেছিলেন ৭০ হাজারেরও বেশি ভোটে। উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়ের জয়ের ব্যবধান তার ধারেপাশেও পৌঁছতে পারেনি। যদিও এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছিল, এমনিতেই উপনির্বাচনে ভোট কম পড়ে। তার উপর প্রচণ্ড গরমে ভোটাররা ভোট দিতে বেরোননি। একটি অংশের এমনও ব্যাখ্যা যে, যে ভোট তৃণমূল পায়নি, তা আসলে বাবুল-বিরোধী। কিন্তু সেই ভোট বিজেপিতে যায়নি! কংগ্রেসেও যায়নি। গিয়েছে সিপিএমে। ফলাফল বলছে, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একটি ওয়ার্ডে হেরেছে তৃণমূল। যা শাসক শিবিরের প্রতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘বার্তা’ বলেই মনে করছে সিপিএম।

রাজ্যে আবার ভোট ২০২৪ সালে। পাঁচ বছর আগের লোকসভা ভোটে রাজ্যে শূন্য হয়েছিল সিপিএম। দু’বছর পরে তারা আবার একটি লোকসভা ভোটের মুখে। বিরোধী পরিসরে অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ বিজেপি এবং রক্তাল্পতায় ভোগা কংগ্রেসকে আপাতত খানিকটা পিছনে ফেলেছে তারা। কিন্তু ভোটের নিক্তিতে তা মাপার উপায় এখন নেই। রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারবে সিপিএম?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE