ঠুঁটো জগন্নাথ দশা হয়তো একেই বলে।
ভোটে জিতে লোকসভার সাংসদ হলে সকলেই আশা করেন, তাঁরা নিজের এলাকায় উন্নয়নের কাজে নজরদারি করবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা সাংসদদের এই উন্নয়নের কাজে নজরদারির ব্যবস্থা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি জেলায় উন্নয়নের কাজে সমন্বয় ও নজরদারির কাজে সেই জেলার লোকসভা সাংসদের নেতৃত্বে একটি ‘দিশা’ কমিটি থাকার কথা। পশ্চিমবঙ্গে গত পাঁচ বছরে একটি জেলাতেও এই কমিটির বৈঠক হয়নি। চলতি অর্থ বছরে কোনও বৈঠক ডাকা হয়নি। গোটা দেশে পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্য, যেখানে কোনও জেলায় লোকসভা সাংসদদের নেতৃত্বাধীন এই কমিটির বৈঠক ডাকা হচ্ছে না। এই কমিটিতে সাংসদদের সঙ্গে জেলার বিধায়করাও থাকেন। জেলাশাসকরা কমিটির সচিব হিসেবে কাজ করেন। ফলে সাংসদ-বিধায়কদের পক্ষে জেলা প্রশাসনের কাছে জবাব চাওয়া, কোথায় কোন প্রকল্পে কাজ আটকে রয়েছে, তা জানানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কোনও জেলায় এই ‘দিশা’ কমিটির বৈঠক ডাকা হচ্ছে না। অথচ বছরে অন্তত চারটি বৈঠক ডাকার নিয়ম রয়েছে।
এমন নয় যে বিজেপির ১২ জন এবং কংগ্রেসের এক জন সাংসদের সঙ্গে অসহযোগিতা করে রাজ্য প্রশাসন তাঁদের জেলায় ‘দিশা’ কমিটির বৈঠক ডাকেনি। তৃণমূলের ২৯ জন লোকসভা সাংসদ রয়েছেন। তাঁদের জেলাতেও বৈঠক ডাকা হয়নি। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে এই তথ্য সংসদে পেশ হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গোটা দেশে ৭৭৬টি জেলা রয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলার একটিতেও ২০২০-২১ থেকে ‘দিশা’ কমিটির বৈঠক ডাকা হয়নি। অথচ দেশের বাকি সব জেলাতেই নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। যেমন, রাহুল গান্ধী আগে বাম শাসিত কেরলের ওয়েনাড়ে গিয়ে ‘দিশা’ কমিটির বৈঠক করতেন। এখন বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলীতে এই বৈঠক করছেন।
কেন ‘দিশা’ কমিটি প্রয়োজন? কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের বক্তব্য, জেলা উন্নয়ন সমন্বয় ও নজরদারি কমিটি হিসেবে নয় বছর আগে এই কমিটি গঠন শুরু হয়। জেলার এক জন লোকসভা সাংসদের নেতৃত্বে এই কমিটিতে ওই জেলার বাকি লোকসভা সাংসদ ও এক জন রাজ্যসভা সাংসদও থাকেন। এ ছাড়া জেলার সমস্ত বিধায়ক, পাঁচজন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান, সমস্ত পুরসভার মেয়র, জেলা পঞ্চায়েতে চেয়ারপার্সন, স্বশাসিত জেলা পরিষদের প্রধান, ব্যাঙ্কের অফিসার থাকেন। জেলাশাসকের সঙ্গে রাজ্য সরকারের একজন কর্তাও থাকেন। ফলে জেলার কোথায়, কেন কাজ আটকে থাকছে, কোথায় কাজের গতি বাড়ানো দরকার, তা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হতে পারে। গ্রাম সড়ক যোজনা, আবাস যোজনা, জল জীবন মিশন থেকে ডিজিটাল ইন্ডিয়া, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের মতো কেন্দ্রের ৩৫টি মন্ত্রকের ৯৬টি প্রকল্পের কাজে এই কমিটি নজরদারি চালাতে পারে।
‘দিশা’ কমিটির বৈঠক ডাকা হচ্ছে না কেন—অতীতে বহরমপুরের সাংসদ থাকাকালীন অধীর চৌধুরী একাধিকবার এই প্রশ্ন তুলতেন। সম্প্রতি দক্ষিণ মালদার সাংসদ ইশা খান চৌধুরী কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানকে চিঠি গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, দক্ষিণ মালদা লোকসভা কেন্দ্রের কিছুটা মালদা, কিছুটা মুর্শিদাবাদের মধ্যে পড়ে। ‘দিশা’ কমিটির বৈঠক ডাকতে চেয়ে চিঠি দিলেও দুই জেলাশাসকের এক জনওজবাব দেননি।
তৃণমূলের লোকসভা সাংসদরাও বলছেন, তাঁদের জেলাতেও ‘দিশা’ কমিটির বৈঠক ডাকা হয় না। যদিও এ নিয়ে প্রকাশ্যে তাঁরা মুখ খুলতে নারাজ। তাঁদের মতে, এটা দল ও রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত। তৃণমূল নেতৃত্বের যুক্তি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই জেলায় গিয়ে রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত প্রশাসনিক বৈঠক করছেন। সেখানে সাংসদ, বিধায়ক-সহ সমস্ত জনপ্রতিনিধি হাজির থাকছেন। ফলে আলাদা করে ‘দিশা’কমিটির প্রয়োজনই নেই। বিজেপি সাংসদদের পাল্টা অভিযোগ, এই সব প্রশাসনিক বৈঠকে তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের জনপ্রতিনিধিদেরডাকা হয় না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)