Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Amit Shah

পৃথক গ্রেটার কোচবিহার রাজ্যই আসল দাবি, শাহি-সাক্ষাতের আগে সরব অনন্ত ‘মহারাজ‍’

বিজেপি-র রথযাত্রা সূচনার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছেন ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপল্‌স অ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতা অনন্ত রায়। কিন্তু তিনি আসছেন না।

অনন্ত রায় ও অমিত শাহ।

অনন্ত রায় ও অমিত শাহ। ফাইল চিত্র।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৮:৫৫
Share: Save:

কোচবিহারে বৃহস্পতিবার বিজেপি-র রথযাত্রা সূচনার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছেন ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপল্‌স অ্যাসোসিয়েশন’ (জিসিপিএ)-এর নেতা অনন্ত রায়। কিন্তু তিনি আসছেন না। বরং, তাঁর আস্তানাতেই যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অনন্তের সঙ্গে ৩০ মিনিটের বৈঠক করার জন্যই দিল্লি থেকে অসম হয়ে বাংলায় আসছেন তিনি। বুধবার রাতে অমিতের অপেক্ষায় থাকা অনন্ত আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘আমাদের কয়েকটি দাবি তিনি মেনে নেবেন ও ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু এখনও আমাদের মূল দাবি কিন্তু গ্রেটার কোচবিহার রাজ্য।’’

সামনেই অসম ও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। আর দুই রাজ্যের নির্বাচনেই রাজবংশী ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে রাজবংশী সমাজের ‘মহারাজা’ আখ্যা দেওয়া অনন্তের দাবি মতো কোচবিহার তো বটেই, উত্তরবঙ্গে আরও অনেক আসনের ফলই এ দিক ও দিক করে দিতে পারে রাজবংশী ভোট। এই দাবি যে ফেলে দেওয়ার মতো নয় তা গত কয়েকটি নির্বাচনের ফল দেখলেই বোঝা যায়। আর সেই ভোটের জন্য অনন্ত কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ অমিতের এই সফর।

বুধবার রাতেই অমিত অসমে পৌঁছেছেন। রাতে ছিলেন আমিনগাঁওয়ে পিডব্লিউডি গেস্ট হাউসে। সফরসূচি বলছে, সকালে সেখান থেকে গুয়াহাটি বিমানবন্দর পৌঁছে হেলিকপ্টারে অমিত যাবেন বঙ্গাইগাঁও। এর পরে চিরাং জেলার সতিবরগাঁও গ্রামে অনন্তের বাড়িতে। প্রাতরাশ সেরে রওনা দেবেন কোচবিহারের দিকে।

তবে প্রাতরাশ নয়, সেই সময়ে অনন্তের সঙ্গে আলোচনাই মূল লক্ষ্য অমিতের। কারণ, নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ে বিজেপি-র কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তরবঙ্গ। আর উত্তরবঙ্গে ভাল ফলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশী ভোট। এবং রাজবংশী ভোটের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনন্ত ‘মহারাজ‍’-এর মন পাওয়া।

অনেকগুলি রাষ্ট্রদোহিতার মামলা চলছে অনন্তের বিরুদ্ধে। সে জন্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চোখে ‘ফেরার’ কোচবিহারের ‘মহারাজা’কে থাকতে হয় অসমে। নিজেকে রাজা ঘোষণা করাই শুধু নয়, কোচবিহার শহরের কাছেই চকচকা গ্রামে একটি রাজবাড়িও বানিয়েছেন তিনি। রাজকীয় জীবনযাত্রাই ছিল একটা সময় পর্যন্ত। কিন্তু ২০২০ সালের অগস্ট মাসের পর থেকে তিনি আর সেখানে থাকতে পারেন না। নানা অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য সেই সময় পুলিশ রাজবাড়িতে হানা দিলে সপরিবার পালিয়ে যান অস‌মে। আর তখন থেকেই সাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করে দেন।

এখনও টেলিফোনে তাঁকে ধরা খুবই মুশকিলের। তবে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ নমিতা বর্মণের সঙ্গে যোগাযোগ হলে বুধবার অনেক রাতে কথা বলা যায় অনন্তের সঙ্গে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ টপকে ফোন পৌঁছয় ‘মহারাজ’-এর কাছে। এর পরে আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি বলেন, ‘‘অমিত শাহ আমার বাড়িতে এলেও আমি কোচবিহারে যাব না।’’ পশ্চিমবঙ্গে না ঢুকলেও বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-র জন্য প্রভাব খাটাবেন কি? অনন্তের কৌশলী জবাব, ‘‘আমরা তো এনডিএ-র শরিক দল। আমাদের সমর্থন তো আছেই। কিন্তু আমি কাউকে এটা বলি না যে, কোথায় ভোট দিতে হবে। সবাই নিজের মতো ভোট দেবে। তৃণমূলের লোকেরাও যদি এ বার বিজেপি-কে ভোট দেন তাতে আমার কিছু করার থাকবে না।’’

আচমকা অমিত কেন আসছেন তাঁর বাড়িতে? জানালেন, মোটেও আচমকা নয়। অনন্তের কথায়, ‘‘মাসখানেক আগে আমি দিল্লি গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করে আসি। তখনই উনি আমাদের কিছু কিছু দাবি মেনে নেওয়ার কথা দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে জানিয়েছিলেন, ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ আমার বাড়িতে এসে কথা বলবেন। সেই মতোই তিনি আসছেন।’’ দিল্লিতে কথা হয়ে যাওয়ার পরেও আধ ঘণ্টার আলোচনার জন্য এতটা আসছেন কেন অমিত? অনন্ত মানতে না চাইলেও রাজ্য বিজেপি নেতারা বলছেন, ‘মহারাজা’ কোচবিহারে না এলেও তাঁর বাড়িতে অমিতের সফর বড় বার্তা দিয়ে দেবে বাংলার রাজবংশী সম্প্রদায়কে।

কতটা কী খাবেন অমিত জানা নেই। কিন্তু নানা নিরামিষ রাজবংশী পদ রান্না হচ্ছে বাড়িতে। সবটাই অমিতকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। তবে সৌজন্যের এত ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের দাবি নিয়ে যে তিনি অনড় তার আভাস মিলল অনন্তের বক্তব্যে। রাজবংশী ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি, রাজবংশীদের তফসিলি জনজাতি ঘোষণা-সহ অনেক দাবি নিয়েই তিনি যে দর কষাকষির জন্য তৈরি সেটা বুঝিয়ে দিলেন। কী কী দাবি মানতে বলবেন অমিতকে? অনন্তের জবাব, ‘‘আমাদের সব দাবিই জানানো আছে। মূল দাবি, গ্রেটার কোচবিহার রাজ্য। তবে উনি কী কী প্রতিশ্রুতি দেন এবং ঘোষণা করেন সেটা শোনার অপেক্ষায় আছি। ভারতীয় সেনায় নারায়ণী রেজিমেন্ট তৈরির দাবিও রয়েছে আমাদের।’’

নারায়ণী রেজিমেন্টের দাবি অবশ্য এখন বিজেপি-র অন্দরেও রয়েছে। কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক ইতিমধ্যেই এই দাবি তুলেছেন। বিজেপি নেতৃত্বও জানে‌ন, গত লোকসভা নির্বাচনে রাজবংশী ভোটই লোকসভায় পাঠিয়েছিল তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে যাওয়া নিশীথকে। দীর্ঘ দিন রাজবংশী ভোট ছিল ফরোয়ার্ড ব্লকের দখলে। ২০১৪ সালে কোচবিহার থেকে জিতেছিলেন তৃণমূলের রেনুকা সিংহ। তাঁর মৃত্যুর পরে ২০১৬ সালে উপনির্বাচনেও জেতেন তৃণমূলের পার্থপ্রতিম রায়। এখন সেই ভোট বিজেপি-তে। অনন্তের বক্তব্য, ‘‘আমরা সব সময় কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গেই থাকতে চাই। কংগ্রেসকেও সমর্থন করেছি। কারণ, আমাদের পৃথক রাজ্যের মূল দাবি পূরণ করতে পারবে কেন্দ্রীয় সরকারই। রাজ্য নয়।’’ কিন্তু এ বার তো রাজ্য সরকার গঠনের নির্বাচন। লোকসভায় বিজেপি-কে জেতালেও বিধানসভা নির্বাচনে কেন তৃণমূল কংগ্রেস নয়? এখানকার আবেগ মাথায় রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও তো রাজ্য পুলিশে ‘নারায়ণী ব্যাটালিয়ন‍’ তৈরির কথা ঘোষণা করেছেন। অনন্তের বক্তব্য, ‘‘আমরাই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিতিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করেছি। কিন্তু এখন উনি আমাদের দেশদ্রোহী বলছেন। আমার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদোহিতার একগুচ্ছ মামলা দিয়ে রেখেছেন।’’

প্রসঙ্গত, অনন্ত রায় তথা তাঁর সংগঠনের মূল দাবি, ১৯৪৯ সালে কোচবিহারের রাজা ভারতভূক্তির যে চুক্তি করেছিলেন সেটা মানা হয়নি। ভারত সরকার কোচবিহারকে জেলা করে রেখেছে। কিন্তু এটা আলাদা রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করতে হবে। তাঁর এলাকা শুধু কোচবিহার জেলা নয়, নরনারায়ণ রাজা থাকাকালীন রাজ্যের যে আয়তন ছিল, সেটাই ফেরাতে চায় জিসিপিএ। সংগঠনের দাবি অনুযায়ী, উত্তরবঙ্গের করতোয়া নদী থেকে অসমের বেশ কিছু অংশ নিয়ে গ্রেটার কোচবিহারের দাবিদার তারা। এখন সেই দাবি পূরণের খুব বেশি আশা না থাকলেও, অন্য কিছু দাবি নিয়ে সরব অনন্তেরা।

জিসিপিএ-র অনন্ত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগও অনেক। অনন্তের অধীনে ‘নারায়ণী সেনা’ নামে পৃথক বাহিনী রয়েছে বলে খবর পায় প্রশাসন। সেই বাহিনী ২০১৬ সালের ২৮ অগস্ট (এই দিনেই কোচবিহারের ভারতভূক্তি হয়) অনন্তকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার পরিকল্পনা করলে তাতে বাধা দেয় রাজ্য সরকার। ‘নারায়ণী সেনা’কে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) প্রশিক্ষণ দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। যদিও সে অভিযোগ বরাবরই নাকচ করেছে বিএসএফ।

‘মহারাজ’ নিজে না জানালেও তাঁর ‘অনুচর’দের দাবি, অনন্ত চাইছেন গঙ্গাপারের নীলবাড়ির দখল পাক বিজেপি। তার জন্যই শাহি-সাক্ষাৎ। কিছু দাবি দাওয়া আদায় করে অনুগামীদের কাছে নিজের মুখরক্ষার পাশাপাশি তিনি নিজেও এ বার ‘অজ্ঞাতবাস’ দশা ঘুচিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরতে চান সপরিবার।

সে জন্যই বৃহস্পতিবার সকালে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর একান্ত বৈঠক। এবং সে কারণেই কোচবিহারের জনসভায় অমিত কী ঘোষণা করেন তা শোনার অপেক্ষায় থাকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE