Advertisement
E-Paper

আমাদের জীবনে আর কখনও পুজো আসবে না, বরং পুজোটা শেষ হলে বাঁচি, চার দিকের এই আনন্দ-আয়োজন সহ্য হচ্ছে না!

চোখের জল সামলাতে সামলাতেই সুমিত্রা বললেন, ‘‘আমার বাবু চুরি করেনি। ও কুরকুরে কুড়িয়ে পেয়েছিল। পরে পয়সাও দিয়েছিল।’’ বলে চললেন, ‘‘চোর-চোর করে ধাওয়া করেছিল। টাকা দেওয়ার পরেও বলেছিল পুলিশে দেবে।’’

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৫
Faded festival days of the family of Krishnendu Das the boy commits suicide after False allegation of theft in Panshkura

অসম্মানের হাত থেকে বাঁচতে মৃত্যুকে বেছে নিল কৃষ্ণেন্দু। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ছেলেটির মতি ছিল ফুটবলে। ভালই খেলত। গ্রামের মাঠে কোচিং নিত। বুট-পায়ে গোল লক্ষ্য করে তার ডান পায়ের শট দেখে মাঝে মাঝে চমকে যেতেন গ্রামীণ কোচও। বল জালে জড়াতই। কোচ ভাবতেন, খেলাটা হবে ছেলেটির। অনেক দূর যাবে এই ছেলে।

কিন্তু সেই যাত্রা আচমকা থেমে গেল। জীবন-খেলায় অন্য ‘গোল’ করে বসল ছেলেটি!

কমলা রঙের দুটো ফুটবল বুট। ‘স্টাড’ এখনও চকচক করছে। সবুজ রঙের দুটো সিনগার্ড। বারান্দার কোনা থেকে বার করে আনছিলেন সুমিত্রা। সুমিত্রা দাস। ছেলেটির মা। ছেলের জিনিস ভারী যত্নে এখনও রেখে দিয়েছেন বছর পঁয়ত্রিশের সুমিত্রা। তাঁর মাঝারি চেহারায় জড়ানো কমলা রঙের সুতির শাড়ি। সাদা ফুলেল ছাপ। বার বার লাল ব্লাউজের ছোট হাতায় মুখ চেপে চোখের জল মোছার চেষ্টা করছেন। কান্না চাপতে গিয়েও মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে গোঙানির মতো আওয়াজ। সামলাতে পারছেন না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সুমিত্রা বলছিলেন, ‘‘বাপির কাছ থেকে টাকা নিয়ে এগুলো কিনেছিল। রোজ বিকেলে প্র্যাকটিসে যেত সাইকেল চালিয়ে।’’

একে একে ক্রিকেট ব্যাট-বল, আরও নানা খেলার উপকরণ বেরিয়ে আসছিল বারান্দার নানা প্রান্ত থেকে। তখনই নজর গেল ঘরের পুরনো দরজার ফ্রেমে পোঁতা জংধরা পেরেক থেকে ঝুলতে থাকা মাঝারি মাপের প্লাস্টিকের ব্যাগের দিকে। দরজাটা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। সেই দুলুনিতে দুলে উঠছে খেলা-ভরা ব্যাগটাও।

পাঁশকুড়ার একটু আগে মেছোগ্রাম মোড় থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়ে ঘাটাল রোড। কিলোমিটার কয়েক গেলে কেশাপাট বাজার। সেখান থেকে বাঁ দিকে অপ্রসস্ত বিসর্পিল পথে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে গোঁসাইবেড় গ্রাম। ঢোকার মুখে রাস্তার উপরে রাধাবাজার। বাজারের মাঝামাঝি ‘সম্পূর্ণ নিরামিষ মিষ্টি দোকান’ ভরদুপুরে বন্ধ। শাটারে তালা। সেই ঘটনার পর থেকে দোকান বন্ধই থাকে। রোজকার নামা-ওঠা বন্ধ থাকায় শাটারে জং ধরার উপক্রম। মিষ্টির দোকান থেকে কেশাপাটের দিকে কয়েক পা পিছনে মৃৎশিল্পী রবীন্দ্র সাঁতরার গ্রামীণ ‘স্টুডিয়ো’। ঠাকুর বানানোর গড়। এ বারেও দুর্গাপ্রতিমা গড়েছেন রবীন্দ্র। ডালপাড়া হাইস্কুলের মাঠে এ বারও পুজো হচ্ছে। কেশাপাট বাজারেও এসেছেন মা দুর্গা। কাছাকাছির মধ্যে পুজো বলতে এই দুই। রবীন্দ্রের ঠাকুর-গড় আর ওই দুই পুজোয় সারা দিন ধরে সাইকেল নিয়ে টো-টো করা সেই ছেলেটিকে এ বারের পুজোয় দেখা যাচ্ছে না।

‘চোর’ বদনাম ঘোচাতে, আত্মসম্মান বাঁচাতে সে বড় ব্যস্ত ছিল!

ছেলেটির মা আপাতত খেলনাগুলো আবার সযত্নে গুছিয়ে রাখছেন। হাত লাগিয়েছেন বাবাও। জগন্নাথ বেরার পরনের সাদা শার্ট আর ধূসর রঙের ট্রাউজার্স দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন কলসির মধ্যে গোঁজা ছিল। এতটাই অবিন্যস্ত। যেমন জগন্নাথের মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বহুদিন ব্লেড বা ক্ষুরের টান পড়েনি।

‘সম্পূর্ণ নিরামিষ মিষ্টি দোকান’ থেকে শ’খানেক মিটার এগোলে রাধাবাজার শেষ হওয়ার প্রান্তে ছেলেটির এই ভাড়া বাড়ি। মাসে হাজার টাকা। এখানেই বছর দশেক ধরে সপরিবার থাকতেন জগন্নাথ। বাবা-মা-মেয়ের মধ্যে জগন্নাথ এখন থাকেন গোঁসাইবেড় গ্রামের হোসিয়ারি কারখানায়। তিনি সেখানেই কাজ করেন। মা-মেয়ে থাকেন হাউরের কাছে একটি কোচিং স্কুলের হস্টেলে।

এ বাড়িতে ওঁরা আর থাকেন না। থাকতে পারেন না।

বাড়ি ছাড়তে হয়েছে হুমকির চোটে। ‘‘না হলে তো ওরা আরজি করের মতো করে দেবে বলেছিল,’’— বলছিলেন সুমিত্রা। আরও বলছিলেন, ‘‘কোন মা চায় তার মেয়ের সঙ্গে ও সব হোক। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই বাড়ি ছেড়েছি। মেয়ে যে হস্টেলে থাকে, ওখানেই ঘর নিয়ে ওর সঙ্গে থাকি।’’

গোঁসাইবেড়ের মূল পিচ রাস্তা থেকে জংলি ঝোপে ঘেরা ঢালু পথ নেমে গেছে ছেলেটির বাড়ির উঠোনে। শ্যাওলা পড়ে পিছলের হদ্দ। তার উপর গাছের ঝরাপাতা পড়ে মাখামাখি অবস্থা। ঝাঁটার ছোঁয়া পড়েনি বহু দিন। গোটা বাড়িতে অযত্নের ছাপ। চারচালা অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। মাঝের দুটো ঘর ঘিরে তিন দিকে বারান্দা। সেই বারান্দা আবার ঘেরা ফুট দুয়েকের ইটের দেওয়াল আর কাঠের রংচঙে বেড়ায়। বাইরে থেকে দেখে পোড়োবাড়ি মনে হয়। সামনের দিকে জমির এক প্রান্তে কলতলা। সেখানেই শেষ বার দাপাদাপি করেছিল ছেলেটি।

বারান্দায় ওঠার জন্য ছোট্ট একটা কাঠের গেট। সেটা সরিয়েই দাওয়ায় ওঠার চেষ্টা করতেই সুমিত্রা বললেন, ‘‘একটু দাঁড়িয়ে যান। অনেক দিন ঝাঁট পড়েনি তো। বড্ড ধুলো।’’ খেজুরপাতার ঝাড়ু দিয়ে বারান্দা ঝাঁট দিলেন। একটু আগেই হস্টেল থেকে ডেকে আনা হয়েছে তাঁকে। জগন্নাথ গিয়ে নিয়ে এসেছেন। ছেঁড়া কার্ডবোর্ডের ভাঁজ করা একটা বাক্স পেতে দিলেন সুমিত্রা। ওটাই অতিথি-আসন! জগন্নাথ-সুমিত্রা দাঁড়িয়ে রইলেন। বারান্দার দেওয়ালের সুইচবোর্ডটা তস্য ময়লা। বোঝা যায়, অনেক দিন হাত পড়েনি। এ বাড়ির আলো বোধহয় পাকাপাকি ভাবে নিবেই গেছে।

প্রশ্নের জবাবে কোনওমতে সুমিত্রা বললেন, ‘‘ফুটবল খেলতে খুব ভালবাসত।’’ খেলাধুলো পর্ব পেরিয়ে জানা গেল, ছেলেটি পড়াশোনায় ভাল ছিল। বাকুলদা হাই স্কুলে সব বিষয়েই ভাল নম্বর পেত। নাটকও করত স্কুলের অনুষ্ঠানে। খেলাধুলো করে ফিরে নিজের সময়মতো পড়তেও বসে যেত। দিদির সঙ্গে খুব ভাব ছিল ছেলেটির। দিদি মধুরিমা দাস এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।

চোখের জল সামলাতে সামলাতেই সুমিত্রা বললেন, ‘‘আমার বাবু চুরি করেনি। ও কুরকুরে কুড়িয়ে পেয়েছিল। পরে পয়সাও দিয়েছিল।’’ থামানোর চেষ্টা করেও লাভ হল না। সুমিত্রা বলে চললেন, ‘‘চোর-চোর করে ধাওয়া করেছিল। টাকা দেওয়ার পরেও বলেছিল পুলিশে দেবে। আমরা পুলিশে যেতেই বাড়িতে এসে হুমকি। অভিযোগ তুলে নিতে হবে। না তুললে মেয়েকে আরজি করের মেয়েটার মতো করে দেবে!’’ একটু সামলে নিয়ে, ‘‘বাবু আমাকে বলত, আমি ডাক্তার হব। তোমার এত শরীর খারাপ হয়। আমি চিকিৎসা করব। আমার সেই ছেলেকে ডাক্তাররা বাঁচাতে পারলেন না।’’

সুমিত্রার বাবুর কাহিনি জেনে গিয়েছে গোটা রাজ্য। ‘সম্পূর্ণ নিরামিষ মিষ্টি দোকান’-এর সিঁড়িতে পড়ে ছিল তিনটি চিপ্‌সের প্যাকেট। চিপ্‌স কিনতে গিয়ে দোকানিকে না-দেখে যা কুড়িয়ে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে এসেছিল ছেলেটি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই দোকানদার মোটরসাইকেল চেপে এসে তাকে পথের মাঝে ধরে। প্রথমে কানধরে ওঠবস। তারপরে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি। কারণ, দোকানদার সিভিক ভলান্টিয়ার। ছেলেটি পকেটে থাকা কুড়ি টাকার নোট দিয়েছিল। তাতে ছাড় মিলেছিল। কিন্তু তত ক্ষণে বেশ কয়েক বার ‘চোর’ অপবাদ শুনে ফেলেছিল ছেলেটি।

পড়শিদের কাছে ঘটনা জেনে মা ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মিষ্টির দোকানে। বাজার ভর্তি লোকের সামনে ছেলেকে ধমক দেন। একটি চড়ও মারেন গালে। ছেলেটি বার বার মাকে বলেছিল, সে চুরি করেনি। কেউ ছিল না বলে কুড়িয়ে নিয়েছিল। মায়ের কথায়, ‘‘কিন্তু দোকানদারের ‘চোর’ বলাটা ও মেনে নিতে পারেনি। বার বার বলেছিল, কাকু আমি কিন্তু চুরি করিনি!’’

হাতের চেটোয় চোখ মুছতে মুছতে জগন্নাথ বললেন, ‘‘গত পুজোয় সাদা পাঞ্জাবি নিয়েছিল। তার আগের পুজোয় নীল। আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে অনলাইনে অর্ডার করত। পুজোর আগে থেকে সারা দিন সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াত। পুজোর আগেই ওর পুজো শুরু হয়ে যেত। বার বার রবীনদার ওখানে গিয়ে ঠাকুর বানানো দেখত। পুজো শুরু হতেই এক বার ডালপাড়ার মাঠ আর এক বার কেশাপাট বাজার। সন্ধে হলেই সেজেগুজে দিদি বা বন্ধুদের সঙ্গে পুজো দেখতে বেরোত। আমার কাছ থেকে ৩০ টাকা করে নিত।’’

সে সব কুর্তা-পাঞ্জাবি অন্যান্য পোশাকের সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সুমিত্রা বলছিলেন, ‘‘আমাদের জীবনে আর পুজো-টুজো নেই। ছ্যানাটা সব নিয়ে গেছে। আমাদের সব আনন্দ, সব উৎসব শেষ। আমাদের জীবনে আর কখনও পুজো আসবে না। বরং পুজোটা শেষ হলে বাঁচি। চার দিকের এত আনন্দ আর সহ্য হচ্ছে না!’’

বারান্দার পাশের একটা ঘরের দরজা হাট করে খোলা। সেখানে ছোটখাটো নানা বস্তা। চাষ-আবাদের জিনিসপত্র। সেখানেই ছিল ঘাস মারার তেল। বিষ! সদ্য কেনা সেই তেলই ঢকঢক করে খেয়ে নিয়েছিল সাড়ে ১২ বছরের কৃষ্ণেন্দু। প্রায় ৩০০ মিলিলিটার।

পাশের ঘরে পড়াশোনা করত কৃষ্ণেন্দু। সেই ঘরে রাখা স্কুলের খাতাতেই কৃষ্ণেন্দু লিখে গিয়েছিল, ‘মা, আমি বলে যাচ্ছি যে আমি কুরকুরেটা রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। চুরি করিনি।’

ঝুপুস অন্ধকার সেই ঘরের ভিতর। এই ঘরেই কৃষ্ণেন্দুর সাড়ে ১২ বছরের জীবনের নানা স্মৃতি। জীবনের শেষ পাতাটিরও। মা সুমিত্রা বলছিলেন, ‘‘গত পুজোতেও এই ঘরে বসেই ডালপাড়ার পুজোর প্রসাদ খেয়েছিল দিদির সঙ্গে।’’ তার পরে এক নিশ্বাসে, ‘‘ও চোর নয়! চুরি ও করেনি! বদনামটা নিতে পারল না। নিজেকে শেষ করে দিল। সারা জীবনের মতো হারিয়ে গেল। কত যুদ্ধ করে মানুষ করেছিলাম। যার সন্তান চলে গেছে, তার কি আর বেঁচে থাকার কারণ থাকে কোনও!’’

জীবনীশক্তি ফুরোলেও জীবন থেমে থাকে না। বেঁচে থাকতে অনাগ্রহী বাড়ির উঠোনেও দোটানা পদক্ষেপে সপ্তমী এল!

Bhinno Pujo Panskura Suicide Case
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy